সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর:

(মূল লেখক: ভাইকম মুহাম্মদ বশীর)

[মালয়ালম ভাষায় গল্পের নাম 'থেনমাভু']

“ও আপনি যা কিছু শুনেছেন সব বাজে কথা। আমি কোন গাছকে পুজো- টুজো করি না, প্রকৃতির আরাধনা তো করিই না। কিন্তু এই আমগাছটার ওপর আমার বিশেষ টান আছে। আমার স্ত্রী আসমা'ও এটাকে খুব ভালবাসে। এই গাছটা অসাধারণ একটা প্রচেষ্টার ফল। আমি আপনাকে বুঝিয়ে বলছি”।

আমরা সেই আমগাছটার নীচেই বসে ছিলাম। গাছটা ফলে ফলে ভরন্ত। গাছটার চারপাশে গোল করে অনেকটা জায়গা জুড়ে সাদা বালি ছড়ানো আছে। তার চারপাশে সিমেন্টের ঘেরা করা আছে যেটিকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য গোলাপ গাছ। নানা রঙের অন্য অনেক ফুল গাছও রয়েছে। তাঁর নাম রশিদ। স্ত্রী আর ছেলেকে নিয়ে পাশের বাড়িটায় বসবাস করেন। স্বামী–স্ত্রী দুজনেই কাছেই একটা স্কুলে মাস্টারি করেন। তাঁর স্ত্রী তাঁদের ষোল বছরের ছেলের হাতে একটা রেকাবিতে ছাল ছাড়িয়ে সুন্দর করে কেটে আম পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমরা সেগুলির সদ্ব্যবহার করলাম। আম তো নয় যেন মধু। 

“কেমন লাগল?”

“নিঃসন্দেহে গাছটা মধুগুলগুলি”।

“এই যে আমরা গাছটার ফল এত আনন্দ করে খাচ্ছি – ভাবলেও অবাক লাগে”।

“কে লাগিয়েছিল গাছটা?”

“আসমা আর আমি এই জায়গাটায় গাছটাকে লাগিয়ে ছিলাম। গাছটার গল্প আপনাকে বলছি শুনুন। এটা আমি অনেককেই বলেছি কিন্তু ঘটনাটা কেউ মনে রাখেনি আর এটাকে বৃক্ষপূজা বলে প্রচার করেছে। এটার সঙ্গে পুজো- টুজোর কোন যোগ নেই, শুধু রয়েছে একটা দারুণ কাজের স্মৃতি।

আমার ছোট ভাই ছিল পুলিসের ইন্সপেক্টার। এই জায়গাটা থেকে প্রায় ৭০ মাইল দূরে একটা শহরে পোস্টেড ছিল। আমি সেখানে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। একদিন বাইরে রাস্তায় পায়চারি করছিলাম। কাঠফাটা গরম। চারপাশে গরম বাতাসের হলকা। সে সময়ে জলের মারাত্মক আকাল চলছিল। ঘুরতে ঘুরতে হটাৎ একটা গলিতে গাছের নীচে একজন বুড়ো লোককে শুয়ে শুয়ে ধুঁকতে দেখলাম। 

তার বড় বড় চুল আর দাড়িগোঁফ, বয়েস মনে হ’ল আশির কাছাকাছি। দুর্বল, হা-ক্লান্ত, অবসন্ন শরীরে মৃত্যুর জন্য নীরবে অপেক্ষা করছে।

আমাকে দেখতে পেয়েই বুড়োটা বলল “আলহামদুলিল্লাহ্‌! বাবা, আমাকে একটু জল এনে দিতে পার?”

আমি দৌড়ে সবথেকে কাছের বাড়িটায় গেলাম, দেখলাম একজন মহিলা চেয়ারে বসে খবর কাগজ পড়ছেন। তাঁর কাছেই একটু জল চাইলাম। সেই সুন্দরী মহিলা একটা তামার ঘটিতে করে খানিকটা জল এনে দিলেন। সেটা নিয়ে আমাকে বেরিয়ে যেতে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করলেন যে জলটা নিয়ে আমি কোথায় যাচ্ছি। আমি তাঁকে জানালাম যে রাস্তার ধারে একজন বুড়ো মানুষ পড়ে আছে, এটা তার জন্যই। তখন ওই মহিলাও আমার সাথে সাথে সেখানে গেলেন। আমি বুড়ো মানুষটিকে ঘটিটা দিলাম।

ধীরে ধীরে উনি উঠে বসলেন। তারপর এক আশ্চর্য ব্যাপার করলেন! অতিকষ্টে তিনি পথের ধারে একটা শুকিয়ে যাওয়া, গরমে নুয়ে পড়া আমের চারার কাছে গিয়ে বিসমিল্লাহির রাহমানির-রাহিম বিড়বিড় করতে করতে ঘটির অর্ধেকটা জল তার ওপরে ঢালতে থাকলেন।

আম খেয়ে আঁটিটা কেউ রাস্তার পাশে ফেলে দিয়েছিল। তার থেকে চারাগাছ বেরিয়েছে। তার বেশিরভাগ শিকড় মাটির ওপর দেখা যাচ্ছে। বুড়ো লোকটি নিজেকে টেনে হিঁচড়ে আবার গাছের ছায়ায় নিয়ে এল। আবার বিসমিল্লাহির রাহমানির-রাহিম আওড়াতে আওড়াতে বাকী জলটা মুখে ঢালল। আবার আল্লার নাম নিল।

তারপর বলল, “আমার নাম ইউসুফ সিদ্দিক। আমার বয়স আশির বেশি। আমার কেউ নেই। আমি ফকির হয়ে সারা দুনিয়া ঘুরেছি। আমার এন্তেকাল উপস্থিত। তোমাদের নাম কি বাবা?”

আমি বললাম, “আমার নাম রশিদ। আমি একটা ইস্কুলে পড়াই”। মহিলা বললেন, “আমি আসমা। আমিও ইস্কুলে পড়াই”।

বৃদ্ধ বললেন, “আল্লাহ্‌ আপনাদের মঙ্গল করুন”। তারপর আবার মাটিতে শুয়ে পড়লেন। ইউসুফ সিদ্দিক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন আমাদের দুজনের চোখের সামনে। আমি আমার ভাইকে ডাকতে গেলাম, আসমা মৃতদেহ আগলে রইলেন। আমরা একটা ঠেলাগাড়ি ভাড়া করলাম মুর্দাটাকে মসজিদে নিয়ে যাওয়ার জন্য। মৃতদেহটিকে গোসল করানোর পর একটি নতুন কাপড় দিয়ে কাফন পরালাম আর দাফনের সব নিয়ম মেনে কবরস্থ করা হল।  

বৃদ্ধটির ঝোলাতে ছ’টি টাকা ছিল। আসমা আর আমি পাঁচ টাকা করে দিলাম। আসমাকেই ভার দেওয়া হল ওই টাকায় মিষ্টি কিনে ইস্কুলের বাচ্ছাদের মধ্যে বিলি করার জন্য।

পরে আমি আসমাকে বিয়ে করি। ও গাছটাকে জল দিতে থাকে। পরে আমরা এই বাড়ীটায় চলে আসি। আমগাছটাকে খুব সাবধানে মাটি থেকে তুলে শিকড়ের কোন ক্ষতি না করে একটা মাটি ভর্তি বস্তার মধ্যে রাখি। দু’দিন এইভাবেই এটা ছিল – আসমার শোবার ঘরে - দেয়ালে ঠেসান দেওয়া। তারপরে আমরা ওটাকে এখানে নিয়ে এসে একটা গর্ত করে তাতে গোবর সার আর ছাই মিশিয়ে সেখানে পুঁতে ফেলি। নিয়ম করে প্রতিদিন জল দেওয়াতে চারাটার নতুন পাতা গজাল, তারপর আমরা হাড় গুঁড়ো আর পাতাপচা সার দিলাম। আস্তে আস্তে সেই চারা গাছটা এই বড় গাছে পরিণত হল”।

“সত্যিই অসাধারণ। বুড়ো মানুষটি মারা যাওয়ার আগে একটা আমের চারাকে জলদান করলেন, যার নিজের জল চাওয়ার ক্ষমতা নেই। এটা সারা জীবন আমার মনে থাকবে”।

আমি সবে বিদায় জানিয়ে হাঁটা শুরু করেছি এমন সময় পেছন থেকে কে ডাকল। আমি পিছন ফিরে দেখলাম।

রশিদের ছেলে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। চারটে আম কাগজে মুড়ে আমার দিকে এগিয়ে দিল – “আপনার স্ত্রী এবং বাচ্ছাদের জন্য”।

“তুমি পড়াশোনা কর?”

“হ্যাঁ, কলেজে”।

“তোমার নাম”?

“ইউসুফ সিদ্দিক”।

“ইউসুফ সিদ্দিক?”

“হ্যাঁ,‘ইউসুফ সিদ্দিক’”।

(www.theoffnews.com - The Honey Mango Tree Vaikom Muhammad Basheer)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours