সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিকও অনুবাদক, দুর্গাপুর:
মূল লেখক নাজির জাহাঙ্গীর (কাশ্মীরী গল্প)
সেদিন চলন্ত বাসের মধ্যে হটাৎ চিৎকার শোনা গেল - “বেচারা!” যাত্রীরা দেখল একটা ছেলে অজ্ঞান হয়ে গেছে। তারা বাসটাকে দাঁড় করাল, তারপর তাকে চাগিয়ে বাসের বাইরে নিয়ে এল। একজন তার পায়ের পাতার তলা ঘষতে লাগল, একজন তার হাতের তালু মাসাজ করতে থাকল, তৃতীয় জন তার মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিল, চতুর্থ জন তার রুমালটা দিয়ে হাওয়া করতে লাগল। আর একজন জল নিয়ে এসে তার মুখে জল ছিটিয়ে দিল। এত যত্নআত্তিতে ছেলেটার জ্ঞান ফিরে এল। তারপর সে আস্তে আস্তে উঠে বসল। তার সহযাত্রীরা খুব খুশী হল।
তাদের মধ্যে একজন জিগ্যেস করল - কী হয়েছিল? আর একজন বলল - এই প্রথমবার অজ্ঞান হলে না প্রায়ই এরকম হয়? তৃতীয় ব্যক্তি তার সহযাত্রীদের বলল - সত্যি, বাসটাতে খুব ভীড় ছিল। বেচারার দম আটকে গিয়েছিল নিশ্চয়ই। বাসের মধ্যে এই ঠেলাঠেলি ধাক্কাধাক্কিতে শক্তপোক্ত জোয়ানও অজ্ঞান হয়ে যাবে। কাছেই দাঁড়ানো আর একজন ছেলেটিকে শুধলো - ভগবান না করুন, তোমার মৃগী নেই তো? এতসব কথা শুনে ছেলেটার দু’চোখ জলে ভরে উঠল তারপর সে ঠোঁট ফোলাল। ভেতরের কোটের পকেটটা বের করে সে জনতাকে দেখিয়ে বলল - মহাশয়রা, আমার পকেটমার হয়েছে। অবাক হয়ে তারা পকেটটা পরীক্ষা করে দেখল। পরোপকারী সহযাত্রীদের টানাটানিতে কোটের পকেটটা ফালাফালা হয়ে গেল। গভীর মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করে একজন মতামত দিল - মহাশয়রা, পকেটটা কাঁচি দিয়ে কাটা হয়েছে।
আর একজন সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানাল - না, মহাশয়, এটা পরিষ্কার ব্লেড দিয়ে কাটা হয়েছে।
- দয়া করে আমার কথা শুনলেই ভাল করবেন স্যার, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই - লোকটা ব্যঙ্গ করে বলল - দয়া করে বলুন ব্লেডে কাটা ছেঁড়া অংশগুলো কোথায় গেল?
- তার কোনও দরকার নেই - অন্যজন গোঁ ধরে বলল - এই কাটাটা - আমাকে ক্ষমা করবেন - একটা সরল রেখায় কাটা হয়েছে আর সেটা ব্লেডের দ্বারাই সম্ভব। প্রিয় বন্ধু, কাঁচি দিয়ে যদি এটা কাটা হতো তাহলে একটা বাঁক থাকত, বলতে আমার দ্বিধা হচ্ছে - সেটা নেই।
এই যুক্তিতে চুপ করে থাকার পাত্র নয় প্রথম জন - সে তার যুক্তিতে অটল থাকল। এরমধ্যে দুই প্রতিপক্ষের যুক্তির স্বপক্ষে বেশ কিছু সমর্থক জুটে গেছে। উভয় পক্ষই তাদের যুক্তির স্বপক্ষে উন্নততর যুক্তি আর মন্তব্য পেশ করতে লাগল। ক্রমে প্রবল তর্কাতর্কি শুরু হয়ে গেল আর যাত্রীরা দুটো দলে বিভক্ত হয়ে গেল - কাঁচি বনাম ব্লেড।
এই ঝগড়ার মাঝে কাঁচি-লোকটি গলা তুলে বলল - তুমি এত ছোটলোক, অসভ্য, বর্বর! গলার জোরেই তুমি জিতে যাবে ভেবেছ? এই শুনে ব্লেড-লোকটি মেজাজ হারাল আর চীৎকার করে বলল - আপনার কোন ভদ্রতাই নেই। আসলে তোর মত ছোটলোকের কাছ থেকে আর কী আশা করা যায়!
ঝগড়া ক্রমশ বাড়তে লাগল, তর্কাতর্কি চরমে পৌঁছাল, ছোট একটা ঘটনা পুরো দস্তুর ঝগড়াতে পরিণত হল। ঝগড়াটা আর প্রধান দুই বক্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না - দুপক্ষের সব লোক তাতে জড়িয়ে পড়ল। অবশেষে কাঁচি-পক্ষ একটা কমিটি গঠন করল আর ব্লেড-পক্ষ অবিলম্বে একটা পার্টি গঠন করল। দুপক্ষই আলাদা আলাদা মিটিং করল। এরপর যথেচ্ছ দোষারোপ শুরু হল আর কার কী স্বার্থ বার করা হতে লাগল। ব্লেড-ম্যান কাঁচি-পার্টিকে বলল - এরাই সেই লোক যারা দেশের সঙ্গে গদ্দারি করেছে। এরা নিজেদের পকেট ভরেছে, নিজেরা ফুলেফেঁপে উঠেছে আর সাধারণ লোকের গলা টিপে ধরেছে। আমরা দাবী করছি এরা যা করেছে তা সবার সামনে পেশ করুক। আমরা এখানে এই মুহূর্তে স্পষ্টভাবে জানাতে চাই যে ৩৭০ ধারার পবিত্রতা নিয়ে যদি কেউ ছেলেখেলা করতে চায় তাহলে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে। আমরা কখনই সেটা হতে দেব না।
জনতা এর পূর্ণ সমর্থনে হর্ষধ্বনি করে উঠল আর প্রধান বক্তা অবিরাম বলেই চলল, বলেই চলল।...
হার না মেনে কাঁচি-ব্যক্তি একইরকম সেন্টিমেন্টে তার সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা পেশ করল। এইরকম চলতে চলতে মেজাজ উচ্চ গ্রামে উঠতে লাগল আর দুটো দল হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ল। তারপর ঢিল ছোঁড়াছুঁড়ি শুরু হল আর বেশ কয়েকজন আহত হল, তার মধ্যে কয়েকজনের আঘাত বেশ গুরুতর। এরপর পুলিশ এল, কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটালো আর লাঠি চার্জ করল। শেষে তারা গুলি ছুঁড়তে বাধ্য হল।
রাস্তা জনশূন্য হয়ে গেল। চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। বাস বহুদূরে রয়ে গেল। দাঙ্গা বাধানোর অভিযোগে ছেলেটাকে গ্রেফতার করা হল।
(www.theoffnews.com - Story Kashmir Nazir Jahangir)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours