সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর:
(মূল লেখক অ্যারেস মহামদ)
- ১ -
তার কিছুতেই মনে পড়ছে না ঠিক কোন মুহূর্ত থেকে তার নিজের নামটা সে মনে করতে পারছে না – কিংবা সময়টা কখন, সেই সময়ে সে ঠিক কী করছিল, কিংবা তার মাথায় কি ভাবনা ঘুরছিল। কিন্তু একটা বিষয়ে সে নিশ্চিত যে সেই সময়ে হয় সে দৌড়াচ্ছিল কিংবা দৌড়ানোর কথা ভাবছিল। মনে মনে সে হাজার মাইল দৌড়েছে যদিও তার ষোল বছরের জীবনে গ্যারিশা শহরের দুশো মাইল উত্তর পশ্চিমে ছোট্ট, স্থায়ী গ্রাম বালাম্বালার চৌহদ্দির বাইরে পা রাখার মত সৌভাগ্য তার হয়নি। এটাও সে নিশ্চিত যে সে সময়ে সে সজল চোখে হাউহাউ করে কিংবা শুকনো চোখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। তার নিশ্চয়ই ভীষণ ভয়ও করছিল, এতটাই ভয়ঙ্কর সেই আতঙ্ক যে তার নিজের সম্বন্ধে সব স্মৃতি মুছে গেল, ঘূর্ণিঝড়ে একটা শহর যেমন ওলটপালট হয়ে গিয়ে অচেনা হয়ে যায়।
কিন্তু সে এটা বেশ মনে করতে পারে যে ঠিক কোন মুহূর্তে সে বুঝতে পারল যে তার নিজের নামটাই মনে নেই – দু’মিনিট আগে খট বিক্রি করা মেয়েমানুষটা যখন তার নাম শুধিয়েছিল। সে তখুনি তখুনি বালাম্বালা থেকে একটা ল্যান্ড ক্রুজারের পিছনে চেপে তিন ঘন্টা ধরে সফর করে গ্যারিশা টাউনের রাহোল বাস স্টপে এসে পৌঁছেছে। সাকা-র মাটির মত ধুলোতে মুখ লাল করে সে ঝুপড়ি দোকানগুলোর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল, কি করবে, কোথায় যাবে কিছুই জানা ছিল না।
ইয়ে ... আমার নাম?
সে পানীয়টা খেতে ইতস্তত করছিল যদিও তার গলা শুকিয়ে কাঠ। তারপর ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে গিলবার সময় তার মুখটা কুঁচকে গেল।
ও, আমার নাম ... ইয়ে ... আমার নাম হল গিয়ে ...
ঠিক আছে, সোনা, যদি তোমার নাম না বলতে চাও বলো না।
ওর মনে হ’ল কিছুক্ষণের জন্য তার মাথাটা জ্যাম হয়ে গেছে, একটু পরেই আবার ঠিক হয়ে যাবে। ও ভাবল আমি নিশ্চয়ই আমার নাম জানি। সারা জীবন জেনে এসেছি। নিজের নাম কেউ ভুলে যায় না। হটাৎ করেই আমার মনে পড়ে যাবে।
- ২ -
সে বাসস্ট্যান্ড থেকে বেরিয়ে রাস্তার ওপর নাক বরাবর হাঁটতে শুরু করল, পাছে তাকে সেখানে তাকে কেউ চিনে ফেলে। মসজিদগুলো থেকে দুপুরের আজানের শব্দ ভেসে আসছে। সে হাঁটতেই থাকল যদিও প্রতি পদক্ষেপে সে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার দিকে আরও এক পা এগিয়ে যেতে লাগল। বাপরে, কত লোক! জীবনে সে এত লোক দেখেনি। সে যত হাঁটছে তত বেশি বাড়ি চোখে পড়ছে। বালাম্বালাতে যে কোন দিকেই তুমি দু’মিনিট হাঁটো না, সোজা জঙ্গলে গিয়ে ধাক্কা খাবে। এখানে বাড়ির কোন শেষ নেই।
বোধহয় যেদিন তার বাবা-মা তাকে খবরটা দিল সেদিনই সে তার নিজের নামটা মন থেকে মুছে গেল। তখন দুপুরবেলা, আর সে তার বন্ধু নাজমা আর আয়ানের সঙ্গে তখনই স্কুল থেকে ফিরেছে। সেদিনই ছিল স্কুলের শেষ দিন। বাড়ি ফেরার সময় তারা একটা দোকান থেকে চকলেট কিনেছিল। দোকানের বাইরে একটা কাঠের বেঞ্চে তারা বসেছিল।
- তোর মুখ থেকে এত মুক্তোর মত হাসি ঝরে পড়ছে কেন রে? নাজমা তাকে শুধল।
- মোটেই আমার মুক্তো ঝরছে না।
- কোন ছোঁড়ার চক্কর? আয়ান এবার মুখ খুলল। আরে ভাই পেট থেকে কথাটা খসা। যদি আমাদের বলিস তোকে এক্সট্রা একটা চকোলেট বার কিনে দেব, প্রমিস।
নাজমা বলল কোন ছোঁড়ার সঙ্গে লটঘট যে নয় সেটা আমি দিব্যি কেটে বলতে পারি। ও লজ্জাতেই মরে যাবে।
ছেলেরা ভীষণ বোরিং, ও বলল।
সে আর বলিস না ভাই – আয়ান বলল। তারা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল লোকেরা দোকানটার সামনের ফাঁকা জায়গাটা পেরিয়ে বাজারে যাচ্ছে কিংবা বাজার থেকে ফিরছে।
যাই হোক, তোর রেজাল্ট কেমন হয়েছে? নাজমা মেয়েটার হাত থেকে রিপোর্ট কার্ডটা ছিনিয়ে নিল। দেখা যাক কী করেছিস। ওরে বাবা, তুই পুরো ক্লাসের মধ্যে সেকেন্ড হয়েছিস?
ও এই জন্য ওর এত খুশি খুশি ভাব, সখের প্রাণ গড়ের মাঠ! – আয়ান বলে উঠল।
মেয়েটি বলল, ওটা ফেরত দে। ওটা কিছু নয়।
এটা “কিছু নয়” নয়। এখানে লেখা আছে তুই “একজন প্রচুর সম্ভাবনাপূর্ণ স্ব-প্রণোদিত মেয়ে” – নাজমা বলল।
মাশাআল্লাহ – আয়ান বলে উঠল। তোর ব্যাপারে বলতে পারব না কিন্তু আমাকে দিয়ে কিছু করাতে হলে আমাকে খুব ঠেলা লাগাতে হয়। এত বাজে ভাবে ফেল করেছি যে আমার রেজাল্ট কার্ডটা কুঁকড়ে গেছে।
মেয়েরা হো হো করে হেসে উঠল আর চকোলেট খেতে থাকল। ছুটিতে কী কী করবে তার প্ল্যান করতে লাগল আর শেষে কথা হল যে পরের দিন সকালে লাইব্রেরীর কম্পিউটার সেন্টারে আবার তিনজনের দেখা হবে।
তারপর তারা বাড়ি চলে গেল। মেয়েটি যখন বাড়ি পৌঁছল তার বাবা-মা সে ব্যাগটা নামিয়ে রাখার আগেই তাকে বসতে বলল আর খবরটা দিল।
কিন্তু আবো [সোহেলি - বাবা], হুয়ো [সোহেলি - মা], ওটা আমি করতে পারব না।
তুমি একটা ধাড়ী মেয়ে, বাচ্চার মত আচরণ করো না।
কিন্তু আমি ওটার জন্য প্রস্তুত নই।
চোদ্দ বছরে তোমার একজন দিদিমা হয়ে যাওয়ার কথা।
তোমরা আমার ওপর দয়া কর।
তুমি আশীর্বাদ চাও না অভিশাপ?
আশীর্বাদ।
আল্লা কুরআনে বলেছেন যদি তুমি স্বর্গে যেতে চাও তাহলে তোমার আল্লাহ্কে সমীহ কর আর বাবা-মাকে মান্য কর। তুমি স্বর্গে যেতে চাও না কি?
অবশ্যই চাই।
তাহলে আমরা যা বলি তাই কর।
ওই মূহুর্তের আগে মানসিক টানাপোড়েন বা অসহায় অবস্থা কাকে বলে সে সম্বন্ধে তার এতদিন কোন ধারণাই ছিল না। কিন্তু স্কুলে যাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে খেলা করা আর ঘরকন্নায় মা-কে সাহায্য করার বাইরে সে আর কী–ই বা জানত? তার কোন কোন বন্ধুর দিরা (কাফতান - আফ্রিকার পোশাক) তার থেকেও কেন সুন্দর - এই মনঃকষ্ট ছাড়া তার আর কী দুঃখ থাকতে পারে? এটার জন্য সে তৈরি ছিল না। তার বাবা-মা তাকে দিয়ে যা করাতে চাইছে সেটাতে সে নিজেকে কিছুতেই রাজী করাতে পারছে না। কিন্তু মা-বাবাকে সে ভালবাসে আর তাদের কথার অবাধ্য সে হতে চায় না। চাইলেই কি পারবে? তাহলে সে জাহান্নমে যাবে না?
- ৩ -
সে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে লাগল, রিক্সা আর মোটর বাইকের ওড়ানো ধুলো থেকে বাঁচবার জন্য তার হিজাবের ওড়না দিয়ে মুখটাকে ঢেকে। দাড়িতে হেনা করা একটা লোক একবার তার নজরে এল। সঙ্গে সঙ্গে সে পড়ি কি মরি করে ছুটতে শুরু করল। দম নিঃশেষ হওয়ার পরই সে থামল। সে পেছন ফিরে দেখল কেউ ধাওয়া করছে না।
একটা ইমারতের সামনে সে হাঁফ নেওয়ার জন্য বসল।
সে আর একটা সম্ভাব্য ঘটনা খতিয়ে দেখতে শুরু করল যখন হয়ত সে তার নামটা ভুলে গেছে। এটা ঘটেছিল তার মা-বাবা যখন তাকে এটা বলেছিল তার ঠিক এক মাস পর। একটা উট কাটা হয়েছিল। পাড়া প্রতিবেশী তাদের উঠোনে ভীড় করেছিল। তারা পেট পুরে খেয়েছিল। নাজমা আর আয়ান ইস্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে হাঁটতে হাঁটতে সেখানে পৌঁছেছিল। বেড়ার ধার থেকে তারা দেখছিল। মহিলারা তাকে নতুন জামাকাপড় পরিয়ে দিয়েছে, গায়ে সুগন্ধি স্প্রে করেছে, তার হাতে পায়ে মেহেন্দি করে দিয়েছে আর তার মাথা ঢেকে দিয়েছে কালো স্কার্ফে। এটা ছিল তার বিয়ের দিন, তার চরম আতঙ্কের দিন। শহরের প্রান্তে একটা নতুন বাড়িতে বুড়ো লোকটা অপেক্ষা করছিল। কনের দল শোভাযাত্রা করে ওই বাড়ির দিকে রওনা হল, অসাধারণ চাঁদের আলোয় সারা রাস্তা ভেসে যাচ্ছিল। তারা ঢোল বাজাচ্ছিল, বাঁশি ফুঁকছিল আর উলুলু দিচ্ছিল। সেখানে পৌঁছালে মহিলারা পুরুষদের ঘিরে বুরামবুর গাইতে লাগল।
ব্যাটাছেলেরা সার নাচ করতে লাগল – হাততালি দিতে দিতে, লাফিয়ে, ফুর্তির চোটে মুখে আওয়াজ করতে করতে। তারা তার গলায় ঝলমলে মালা পরিয়ে দিয়ে তার রূপের প্রশংসা করে গান করতে লাগল। তারা যখন বিদায় নিল সে তার বোন আর মা-কে আঁকড়ে ধরল।
আমাকে ছেড়ে যেও না।
কোন ভয় নেই। খুব ভাল থাকবি। শুধু আমরা যেমন বলেছি তেমনটা করবি।
আমার ভীষণ ভয় করছে।
ও যা বলবে শুধু তাই করবি।
সম্ভবত এই সময়েই যখন সে আয়নাতে তার মুখ দেখল আর যে মুখটা তার দিকে তাকিয়ে আছে তাকে সে চিনতে পারল না তখনই সে তার নাম ভুলে গিয়েছিল। কিংবা যে মুহূর্তে সে তার জামাকাপড় খুলে এই প্রথম একজন পুরুষের সামনে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে তার লজ্জা ঢাকার জন্য মরমে মরে যাচ্ছিল, যদিও সে বুঝতে অক্ষম ছিল সেটা তার বসন না নাম খোয়ানোর জন্য। সম্ভবত এটা হয়েছিল যখন সে তার ভেতরে প্রবেশ করল, মৃদু আলোয় তার হেনা করা দাড়িটা চক্চক্ করছিল, যখন তার শরীরের ভারে তার নরম তুলতুলে শরীরটা নিষ্পেষ্ট হচ্ছিল, তার হাত দু’টো শক্ত করে ধরা ছিল, তার নড়ার উপায় ছিল না, তার ঊরুর ভেতরটা অসহ্য যন্ত্রণায় জ্বলে যচ্ছিল, বিছানার চাদরটা দাঁতে চেপে ধরেও তার নাভিশ্বাস আর ব্যাথার কান্না চাপা দিতে পারছিল না, তার চোখের জল গড়িয়ে এসে তার কানের ফুটো ভরিয়ে দিচ্ছিল, দপদপে লম্ফটার দিকে সে তাকিয়ে ছিল, মাটির বাড়ির দেওয়ালে ছায়াগুলোর দিকে, একটা কাঠের তক্তার ওপর একটা টিকটিকির একা ছুটে যাওয়ার দিকে, দূরে একটা পুরুষের ঘোঁত ঘোঁত আওয়াজ আর মেয়েদের গান শুনতে পাচ্ছিল।
কিংবা এটা ঘটেছিল সেই সময়ে, এর কিছুদিন পরেই, যখন সারাদিন তাকে ঘরের কাজ করতে হ’ত আর রাত্রে বেদম ঠ্যাঙানি খেতে হ’ত, এমনকি তার মুখের কালশিটে দাগগুলোর মত তার পেট ফুলতে শুরু করার পরও আর একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থায় সে চলে যাবার পরও যখন নিজেকে বিছানা থেকে টেনে হিঁচড়ে নামাতে হ’ত আর সে ভুলে যেত সে কি করছিল, অর্ধ-অচেতন অবস্থা, তার চলাফেরা মন্থর হয়ে এল, স্যুপ তৈরি করার সময় চামচটা নাড়াতে নাড়াতে মাঝপথে থেমে যেত, টেবিলটা মুছতে ভুলে যেত, বোবা চোখে তাকিয়ে থাকত, শুকনো চোখে কাঁদত, রাত্তিরে বিছানার চাদরটাকে এতো জোরে কামড়াত যে সেটাতে তার বিয়ের সময়ে পরা ওড়নার থেকেও বেশি ফুটো হয়ে গেছে, ছায়া ছায়া শরীরগুলোকে চোখের সামনে নাচতে দেখত আর টিকটিকির হাই তোলা দেখত আর পালিয়ে যাবার কথা ভাবতে থাকত।
- ৪ -
সে একটা বড় মোড়ের মাথায় এসে দাঁড়াল যেখানে রাস্তা দু’ভাগে ভাগ হয়ে ডান দিকে আর বাঁদিকে চলে গেছে। ডানদিকের রাস্তাটা পিচের আর বাঁদিকের রাস্তাটা ধুলোয় ভরা ফুটিফাটা পায়ে হাঁটার মেঠো পথ। সে ওই মোড়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল যে কোন রাস্তাটা ধরা যায় যদিও দুটো রাস্তাই কোথায় গেছে সে বিষয়ে তার বিন্দু বিসর্গও ধারণা ছিল না। তার একটা অদ্ভুত অনুভূতি হ’ল যেটা তার আগে কখনও হয়নি। একটা রোমাঞ্চ! জীবনে এই প্রথমবার সে নিজের থেকে কিছু একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। যেমন, সে বাঁয়ে না ডাইনে কোন দিকে যাবে সেটা সে নিজেই ঠিক করতে পারবে, অন্য কেউ সেটা পাল্টাতে পারবে না। আবার কোনদিকেই না বেঁকে যে দিক থেকে সে এসেছিল সেদিকেই ফিরে যেতে পারে। সারা জীবনে সে যা যা করতে চেয়েছে তার কোনটাই সে করতে পারেনি। কিন্তু তাও সে অবাধ্যতা করার অপরাধবোধে ভুগেছে, যদিও সে জানে না কেন। একই রকম মনে হয়েছে যখন সে তার বাবার কাছ থেকে টাকা চুরি করেছে বা তার বন্ধুকে পরীক্ষার সময় তার খাতা দেখে একটা প্রশ্নের উত্তর টুকতে দিয়েছে।
দুটো রাস্তার দিকে দেখে তার প্রথম সহজাত ইচ্ছে হ’ল ধুলোভরা পায়ে চলা রাস্তা দিয়ে যাবার কারণ পিচের রাস্তাটা বড্ড ঝক্ঝকে বড্ড বড় যেটা দিয়ে মরদ আর বেটাছেলেদেরই যাওয়ার উচিৎ কিন্তু তার ওটা দিয়ে যাওয়ার যোগ্যতা নেই। নিজের জন্য নতুন নাম নেওয়ার কথা ভাবতেই তার একই রকম নিজেকে দোষী মনে হতে লাগল আর এই শহরে কোনও কাজ খোঁজার কথা ভাবতেই তার মাথা ঘুরতে লাগল। বাড়িতে মেয়েরা সব সময় হাঁড়ির তলার ভাত খেত আর পুরনো ছেঁড়াখোঁড়া বিছানায় শুতো। অন্যদের জন্য তারা নিজেদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিত আর বিধিনিষেধের আগড়ে তারা সব সময় বাঁধা থাকত। নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে তার মনে হল সে যেন অন্যায় করছে কারণ তার জানা ছিল না যে ‘নিষিদ্ধ’ আর ‘ভুল’ এ দুটোর মধ্যে কোন তফাৎ আছে।
- ৫ -
সূর্য ডোবার পরে পথ হারিয়ে ক্লান্ত হয়ে সে ব্যস্ত হাইওয়েতে উঠে এল। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার কিন্তু তার পায়ে ময়দার মত সাদা ধুলো নজরে পড়ছে। রাস্তার যে দিকে সে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে সার সার দোকান আর খোলা ফুটপাথে কফির দোকান যেখানে ব্যাটাছেলেরা বসে খট চিবোচ্ছিল। একটু দূরে যেখানে অ্যালগ্যারোবো গাছগুলো ঝুঁকে পড়েছে সেখানে ট্রাক সারাই মিস্ত্রিদের সিলুয়েট দেখা যাচ্ছে। ও একটা নড়বড়ে ঝুপড়ি খুঁজে পেল যেটা পুরনো চাদর আর পর্দা দিয়ে কাজ চলা গোছের বানানো হয়েছে, দেখে মনে হলো সেটাতে বোধহয় দিনের বেলা চায়ের দোকান চলে। এতক্ষণে হাঁটা থেকে রেহাই পেয়ে তার খুব আনন্দ হোল, আরও আনন্দ হলো মেঝেতে একটা মাদুর দেখতে পেয়ে যদিও সেটার জরাজীর্ণ আর কন্টকিত অবস্থা। আগের বৌটা তাকে যে জল দিয়েছিল সেটা এখনও সে ছোঁয়নি পর্যন্ত। ভয় তাকে আস্টে-পিষ্টে জড়িয়ে ধরেছিল, রাতের অন্ধকার সব কিছুকে যেমন গ্রাস করে তেমনি তার শরীরের প্রতিটা খাঁজখোঁচে ভয় ঢুকে পড়েছে। রাত্তিরে সে কখনও একা বাড়ির বাইরে পা রাখেনি। এমনকি বালাম্বালাতেও ‘নিরাপত্তা’ সমার্থক ছিল ‘বাড়ি’ আর ‘দিবালোক’-এর সঙ্গে। হুয়ো (মা) তাকে সন্ধ্যে ছ’টার পর গ্রামের শেষ প্রান্ত থেকে তাদের উটগুলো থেকে কখনও দুধ আনতে দেয়নি কিন্তু তার ছ’বছরের ভাইয়েরও কোন বারণ ছিল না। মা তাকে বুঝিয়ে বলেছিল। একজন মেয়েমানুষ হ’ল রান্না করা সুস্বাদু মাংস, তুমি জান না? সে বাইরে উঁকি মারল তার চারপাশের বিল্ডিং আর দোকানগুলোতে যত নাম লেখা আছে সেগুলো পড়তে। যত লোককে সে চেনে সবার নাম সে মনে করতে পারছে। যেমন তার বাচ্চার নাম – উডগুন (সোমালি – সুরভি)। তার জন্য খুব মন কেমন করে যাকে তারা তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল শেষ বার যখন সে পালিয়ে গিয়েছিল আর বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর থেকে অন্য কিছু নিয়ে ভাবার আর অবকাশই নেই। বাচ্চাটা যেহেতু মাত্র সাত মাসের তাই সে দুশ্চিন্তায় থাকে যে তারা তাকে ভুলভাল খাবার দিয়ে দিতে পারে কিংবা তার দোলনা খাটে পিঁপড়ে ঢুকে পড়তে পারে। এটার জন্ম দিতে গিয়ে সে তো প্রায় মরতে বসেছিল আর ব্যাথার জন্য কয়েকবারই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল কিংবা অবিরাম রক্তপাতের জন্য যেটা কিছুতেই বন্ধ হচ্ছিল না। অথবা দু’টো কারণেই। হাত দুটোকে বালিশ করে মেঝেতে শুয়ে শুয়ে সে খুব মিস করছে ও যেভাবে হাসত আর আধো-আধো ভাবে কথা বলত – তার বাচ্চা – যার কোন ধারণাই ছিল না তার মাকে দুর্ভাগ্য কীভাবে গ্রাস করছে। তার ভীষণ হতাশ লাগে পৃথিবীতে আর একটি ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে আসার জন্য যে পৃথিবী বাচ্চা মেয়েদের প্রতি চরম নির্মম; আর একটি সুস্বাদু রান্না করা মাংসের টুকরোকে সেখানে নিয়ে আসার জন্য যেটা এটাকে চেটেপুটে খাওয়ার জন্য অসম্ভব দক্ষ; আর একটি ছোট্ট দিয়াকে সেখানে নিয়ে আসার জন্য যেটা দীপ নেভাতে মস্ত বড় ওস্তাদ। সে নিজের নাম মনে করতে পারছে না। কিন্তু সে তার মা, বাবা, ভাইদের, বোনেদের, তুতো ভাইবোনেদের, বন্ধুদের, শিক্ষিকাদের, গাঁয়ের লোকদের কারোর নাম ভোলেনি। তার টলমলে হাঁটার বয়স যখন তখন থেকে তার সবার নাম মনে আছে। মাত্র একবার যাদের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে তাদের নামও তার দিব্যি মনে আছে। যেমন গেদি বলে একটা লোক তার মাকে একবারই কাঠকয়লা বিক্রি করেছিল যখন তার বয়েস ছিল তিন। যখন তার বয়েস পাঁচ তখন হাইবো নামে একজন বহু দূরসম্পর্কের আত্মীয় তাদের বাড়িতে মাত্র একরাত্রি বাস করেছিল। কিন্তু সে কিছুতেই তার নিজের নাম মনে করতে পারছে না। তার জানা সব মেয়েলি নাম সে মনে করার চেষ্টা করে, সে নিশ্চিত যে তার নামটা কানে গেলেই সে নিজের নামটা চিনে নিতে পারবে। ফাতুমা। নাঈমা। খাদিজা। হাওয়া। মালিউন। জয়নাব। আম্বিয়া। বাতুলা। রুকিয়া। ইফরা। কুরেশা ... একটারও নামের আওয়াজের সঙ্গে তার নামের আভাসটুকুও খুঁজে পেল না। মাঝে মাঝে তার মনে একটা চিড়িক দিয়ে ওঠে আর সে বুঝতে পারে যে শেষ পর্যন্ত সে তার নিজের নামটা মনে করতে পেরেছে, কিন্তু প্রত্যেকবারই পরে বোঝা যায় যে সে গুড়ে বালি, ঠিক মতো মনে রাখার আগেই সেটা মনের গভীরে ডুব দিয়েছে আর রয়ে গেছে স্মৃতিটুকুর একটা স্মৃতি – কিছুর যেন রেশ যার উৎস কেউ মনে করতে পারে না। ও মনে করার চেষ্টা করতে করতে এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে।
- ৬ -
রাত্রি ক্রমশ নির্জন নিস্তব্ধ হয়ে উঠল। যে শব্দগুলো শুধু সে শুনতে পাচ্ছিল তা হলো খটের ঝুপড়িগুলো থেকে ভেসে আসা ক্ষীণ গানের আওয়াজ, তার পেটের গুড়গুড় শব্দ আর তার বুকের ঢিপ ঢিপ শব্দ যখন একটা মাত্র লোক পা ঘষে ঘষে পাশ দিয়ে পেরিয়ে গেল। পুরনো বন্ধুদের সে খুব মিস করে। সে মিস করে নাজমা-র একগুঁয়েমি আর আয়ানের রসিকতা আর সে নিজের মনেই ভাবে তারা এখন কী করছে আর সে নিজেকে প্রশ্ন করে তাদের কপালেও তার মতই দুর্ভাগ্য নাচছে। তখন তার মনে পড়ল - ঠিক কোন মুহূর্তে সে তার নামটা ভুলে গিয়েছিল। এটা ঘটেছিল ঠিক চারদিন আগে। তার বাচ্চাটাকে পিঠে বেঁধে সে আবার পালিয়েছে। একটা নৌকোয় নদীটা পেরিয়ে হাসাকো পৌঁছেছে। পরের দিন ভোরবেলা যখন সে গ্যারিসা যাওয়ার জন্য একটা গাড়িতে ওঠার চেষ্টা করছে পেছন থেকে কেউ একজন তাকে টেনে নামিয়ে আনল। হেনা করা দাড়িটা তার প্রথম চোখে পড়ল। ফেরার পথে, নদীটা পার হবার পর, লোকটা তার ঘাড়টা টিপে ধরে আবার তাকে নদীর ধারে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। সে তার মাথাটা জলের মধ্যে টিপে চুবিয়ে দিল। তারপর তার ফুসফুসে জল ঢুকছিল আর তার মাথায় অক্সিজেন যাচ্ছিল না সে বাতাসে মরীয়া হাত ছুঁড়ছিল সে তখন তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছিল। তার মনে হয়েছিল সে মরে যাচ্ছে।
হয়তো তাই।
কেন না সে যখন তাকে জল থেকে উঠতে দিল সে তার নাম মনে করতে পারল না।
(এটি একটি সুপরিচিত গল্প। যেসব নাবালিকাদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে তারা জানেই না ‘বিয়ে’ কী, যখন বিয়ে দেওয়া হচ্ছে তখন তাদের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা হোমওয়ার্ক আর ছেলেদের ঠেকিয়ে রাখা। ‘কেরো ইয়ুথ মেন্টরশিপ ইনিসিয়েটিভ’-এর মুখ্য কাজ ইসিওলো (যেখানে এটির মুখ্যকেন্দ্র) এবং সন্নিহিত অঞ্চলে এফ জি এম বা ‘ফোর্সড আর্লি ম্যারেজ’ এবং ‘কাউন্টারিং ভায়োলেন্ট এক্সট্রিমিজম’-এর শিকার মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা। ২৩৫ জন ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রী এটির ছত্রছায়ায় থেকে বিস্তৃত সম্প্রদায়ের উন্নতিসাধন আর এই মেয়েগুলিকে বাঁচাবার জন্য কাজ করে। প্রতি বছর মোট ছাত্রীদের ৩০% এই জনহিতকর কাজে উপকৃত হচ্ছে। ‘নোটোজেটু উইশ ফুলফিলমেন্ট’-এর সঙ্গে যৌথ প্রচেষ্টায় এবং তাদের ১,২৫,০০০ শিলিং অনুদানে এই মেয়েগুলিকে উদ্ধার এবং তাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত করা সম্ভব হবে - স্যানিটারি ন্যাপকিনের জোগান, হাতের কাজ শেখানো আর সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের মাধ্যমে। কারণ কোন মেয়ের কখনই ভুলে যাওয়া উচিৎ নয় তাদের জীবন, তাদের শরীর, তাদের পরিবার আর তাদের নাম।)
(www.theoffnews.com The cooked meat story)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours