সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর:
[অস্ট্রেলিয়ার নারেন নদীর তীরে বসবাসকারী ইয়ুয়ালায়ি উপজাতির নুঙ্গাবুরাহ্ শাখার লোককথা]
বুড়ো বাইয়ামি (অস্ট্রেলীয় আদিবাসী ভাষায় বিরাট চেহারার মানুষ) তার দুজন ছুক্রি বৌকে ডেকে বলল, “একটা মৌমাছির পেছনে একটা সাদা পালক ভরে দিয়েছি, এবার ওটাকে উড়িয়ে দেব, আর ওটার পিছু পিছু দৌড়ে ওর চাকে পৌঁছে গিয়ে প্রচুর মধুর সন্ধান পেয়ে যাব। আমি যখন মধু জোগাড়ে ব্যস্ত থাকব তখন তোরা দুজনে বেরিয়ে পড়বি আর ব্যাঙ ধরবি আর চুপড়ি আলু জোগাড় করে কুরিগেল ঝর্ণার কাছে চলে আসবি। সেখানে আমার সঙ্গে দেখা করবি, ওখানেই আমরা মৌজমস্তি করব, কারণ ওখানের জল খুব মিষ্টি আর পরিষ্কার”। বৌরা, তার কথামত, জাল আর আলু তোলার খোঁচনবাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তারপর অনেক দূর দূরান্ত ঘুরে প্রচুর ব্যাঙ ধরে আর চুপড়ি আলু খুঁড়ে বের করে তারা যখন কুরিগেলে পৌঁছাল তখন তারা হা-ক্লান্ত – তাই ঠান্ডা পরিষ্কার জল দেখে তাদের সাধ হল নাইবার। কিন্তু জলে নামবার আগে তারা ডালপালা দিয়ে একটা ঝুপড়ি তৈরি করে তার মধ্যে তাদের আনা খাবার আর জোগাড় করা ব্যাঙ আর আলু জাল দিয়ে ঢেকে রাখল। ঝুপড়িটা তৈরি করল বায়ামির নালা-নালা-র (অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ব্যবহৃত কাঠের গদা) ভয়ে, যেটা দেখিয়ে ও তাদের মন জয় করেছিল আবার ওটার ভয় দেখিয়েই তাদের শাসনে রাখত। তারপর তারা ঝর্ণায় গেল নাইতে। প্রথমেই তারা তাদের গুমিলাগুলো [কমবয়সী মেয়েদের পোশাক, যেটাতে অপসাম নামে অস্ট্রেলিয়ার একজাতীয় বৃক্ষবাসী স্তন্যপায়ী প্রাণীর নাড়ি দিয়ে তৈরি কোমরবন্ধতে অপসামের লোম দিয়ে তৈরি প্রায় এক বর্গ ফুটের গুছি সামনের দিকে ঝোলানো থাকত] খুলে রাখল, তারা তখনও এতটা কম বয়সী ছিল যে তারা গুমিলা পরত – সেগুলো তারা ডাঙার ওপর ঝরণার কাছে খুলে রেখে মহানন্দে ঝর্ণার জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু ঠান্ডা জলে তাদের শরীর জুড়ে ঠান্ডা আরাম চারিয়ে যাওয়ার আগেই দুটো কুমীর [কুরীয়া] দু’জনকে ক্যাঁক করে ধরে কোঁত করে গিলে ফেলল। মেয়েদুটোকে গিলে ফেলেই কুমীর দুটো ঝর্ণার জল যেখান দিয়ে মাটিতে প্রবেশ করে মাটির তলার একটা গর্ত দিয়ে নারান নদীতে গিয়ে পড়ছে সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেই রাস্তা দিয়েই তারা গেল, সঙ্গে নিয়ে গেল ঝর্ণা থেকে নারান পর্যন্ত বয়ে যাওয়া সমস্ত জল আর নারানের সব জলও তারা শুকিয়ে দিল।
এদিকে এই সময়ে বাইয়ামি, তার বৌদের ভাগ্যে কী ঘটেছে না জেনেই মধু শিকারে ব্যস্ত ছিল। সাদা পালক গাঁথা মৌমাছিটাকে সে খানিক দূর অনুসরণ করে গেল। তারপর মৌমাছিটা কিছু বুদথা ফুলের ওপর বসে আর নড়তে চাইল না। বাইমি তখন ভাবল, “কিছু তো একটা ঘটেছেই না হলে মৌমাছিটা ওর বাসার দিকে উড়ে না গিয়ে এখানে এরকম চিটিয়ে বসে থাকত না। কুরিগেল ঝর্ণায় গিয়ে আমাকে দেখতেই হচ্ছে আমার বৌগুলো নিরাপদে আছে কিনা। মারাত্মক একটা কিছু ঘটে গেছে নিশ্চয়”।
এই বলে বাইয়ামি দ্রুত ঝর্ণার উদ্দেশ্যে রওনা হল। ওখানে পৌঁছে সে লতাপাতার ঝুপড়িটা দেখল যেটা তার বৌয়েরা বানিয়েছিল, চুপড়ি আলুগুলোকে দেখতে পেল যেগুলো তারা মাটি খুঁড়ে বার করেছিল, সে ব্যাঙগুলোকেও দেখতে পেল কিন্তু বিরাগনুলু আর কানানবেইলিকে কোথাও দেখতে পেল না। জোরে জোরে চীৎকার করে সে তাদের নাম ধরে ডাকল। কিন্তু কোনও উত্তর পেল না। এরপর সে ঝর্ণার কাছে গেল; ঝর্ণার পাড়ে সে দেখতে পেল তার দুই বৌয়ের গুমিলা দুটি। এরপর ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে যখন দেখল সেটা শুকিয়ে গেছে তখন সে বলে উঠল, “এটা ঠিক কুরীয়াদের কম্ম। নীচের সুড়ঙ্গের মুখটা খুলে ফেলেছে আর আমার বৌদুটোকে নিয়ে নদীতে চলে গেছে। মুখটা খুলে যাওয়ায় ঝর্ণার জলটা শুকিয়ে গেছে। ঠিক আছে, আমি জানি এই সুড়ঙ্গটা নারেন নদীর সঙ্গে কোথায় মিশেছে, আর এই দন্ডে আমি সেখানে যাব”। বর্শা আর ওগারা (কাঠের যুদ্ধাস্ত্র) বাগিয়ে সে কুমীরদের ধাওয়া করল। খুব শিগগিরই সে একটা গভীর গহ্বরে পৌঁছাল যেখানে কুরিগেলের অন্তঃসলিলা প্রবাহ নারেনের স্রোতের সঙ্গে মিশেছে। সেখানে গিয়ে সে যা দেখল তা সে জন্মে দেখেনি – গভীর ডহরটা খট্খটে শুকনো। সে নিজের মনেই বলল – “কুমীর দুটো যাওয়ার সময় সবকটা ডহরের সব জল খালি করে সঙ্গে নিয়ে গেছে। কিন্তু এই নদীটার সব দহ আমি খুব ভালো করেই জানি। নদীর ওই বাঁকটা দিয়ে আমি মোটেই যাব না, তাহলে আমাকে তিনগুণ রাস্তা পেরুতে হবে, তার বদলে আমি এক ডহর থেকে আর এক ডহরে কোনাকুনি যাব, আর তাহলেই আমি কুমীরগুলোর থেকে এগিয়ে যেতে পারব”। এই বলেই বাইয়ামি দ্রুত এগিয়ে গেল, এক ডহর থেকে আর এক ডহরে শর্টকাট করে এগুতে লাগল, আর তার পায়ের চিহ্ন রয়ে গেল মোরিলা শৈলশিরার ওপর যেটা এগিয়ে গেছে গভীর গর্তগুলোর দিকে। যে গর্তেই সে যায় সেটাই সে দেখে খালি – এই করে করে সে নারেন নদীর শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছাল; সেখানের নদীখাত তখনও যথেষ্ট ভিজে আর কাদাটে, সে বুঝতে পারল যে সে তার শত্রুদের কাছে পৌঁছে গেছে, আর সত্যিই সে তার পরে পরেই তাদেরকে দেখতে পেল। সে কায়দা করে কুমীর দুটোর চোখে ধুলো দিয়ে ওদের থেকে একটু এগিয়ে গেল। তারপর সে একটা প্রকান্ড ঢিল [পবিত্র] গাছের পিছনে লুকিয়ে পড়ল। কুমীর দুটো তার কাছে এসেই আলাদা হয়ে গেল, একটা অন্যদিকে যাওয়ার জন্য বাঁক নিতেই বাইয়ামি একের পর এক বর্শা ছুঁড়ে তাদেরকে বিদ্ধ করে আহত করল, তারা যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল আর তাদের লেজগুলো ভয়ঙ্কর জোরে আছড়াতে লাগল, যার ফলে সেখানে মাটিতে বিশাল বিশাল গর্ত হয়ে গেল আর তারা সঙ্গে করে যে জল এনেছিল তাতে ওই গর্তগুলো ভরে গেল। কুমীর দুটো তার হাত ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারে এই ভেবে বাইয়ামি বর্শা নিয়ে জল থেকে তাদেরকে তাড়া করল আর তারপর খুব কাছ থেকে তাদেরকে তার ওগারা দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলল। আর তারপর থেকে চিরকাল, বন্যার সময়, নারেন নদীর জল ওই বিশাল ডহরে এসে পড়ত, যেটা কুমীর দুটোর লেজের আছড়ানিতে তৈরি হয়েছিল। যখন বাইয়ামি দেখল কুমীর দুটো প্রায় মরেই গেছে, সে তাদের পেটগুলো কেটে ফেলল, আর তার বৌদের শরীরগুলো বার করে নিয়ে এল। দুজনারই গা ভিজে ভিজে চটচটে আঠালো রসে ভর্তি আর তাদের দেহগুলো দেখে মনে হচ্ছে প্রাণহীন; কিন্তু সে তাদের বয়ে নিয়ে এসে লাল পিঁপড়ের দুটো বাসাতে দুজনার দেহকে শুইয়ে দিল। তারপর একটু দূরে বসে তাদেরকে দেখতে লাগল। পিঁপড়েরা দ্রুত সারা শরীর ঢেকে ফেলল আর চটচটে রসটা পরিষ্কার করে ফেলল, আর বাইয়ামি কিছুক্ষণের মধ্যেই লক্ষ করল মেয়ে দুটোর পেশীগুলো কাঁপছে। “আহ্”, সে বলে উঠল, “যাক প্রাণ আছে; পিঁপড়ের কামড় ওরা অনুভব করছে”। সে যেই না এটা বলেছে সঙ্গে সঙ্গে একটা বাজ পড়ার মত আওয়াজ হলো, আওয়াজটা কিন্তু মনে হলো মেয়ে দুটোর কান থেকে বেরিয়ে এল। সেই বিকট আওয়াজের প্রতিধ্বনি যে মুহূর্তে থেমে গেল মেয়ে দুটো আস্তে আস্তে নিজেদের পায়ে উঠে দাঁড়াল। এক মুহূর্তের জন্য তারা সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে হতবুদ্ধি হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। তারপরেই তারা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল যেন কোন মারাত্মক আতঙ্ক তাদের তাড়া করছে। কিন্তু বাইয়ামি তাদের কাছে এসে বুঝিয়ে বলল সে কীভাবে কুমীরদের পেট থেকে তাদেরকে উদ্ধার করেছে। সে তাদেরকে বারংবার সাবধান করে দিল যাতে তারা নারেনের গভীর গর্তে যেন কখনও নাইতে না নামে কেন না ওই গর্তগুলো হচ্ছে কুমীরদের আস্তানা।
অতঃপর সে বুগিরাতে তাদের দু’জনকে জলের দিকে তাকানো করিয়ে বলল – “শীঘ্রই কালো রাজহাঁস, পেলিক্যান আর হাঁসের দল এই জলাশয় খুঁজে পাবে; অতীতে যেখানে শুকনো মাটি আর পাথর ছাড়া কিছু ছিল না, এবার থেকে ভবিষ্যতে সেখানে জল এবং জলচর পাখি থাকবে; নারেনে যখন জলস্ফীতি হবে তখন তার বিস্তৃত জলরাশিতে একটা বিরাট হ্রদের সৃষ্টি হবে”। আর বাইয়ামি ঠিক যা বলেছিল কালে কালে তাই ঘটল, এখন যেমন নারেন লেকে দেখা যায়, মাইলের পর মাইল বিস্তৃত জলরাশি যা হাজার হাজার বুনো জলচর পাখির নিশ্চিন্ত নিবাস।
(www.theoffnews.com Narran lake folk tales)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours