মোনালিসা মুখোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার, হুগলি:

"নিজের হাতে পড়লে হাঁড়ি, ভাত ফেলে আমানি বাড়ি।"

এলোমেলো কিছু কথা মাঝে মধ্যেই নাড়িয়ে দেয় আমাকে। যেমনটা, এই প্রবাদটা হঠাৎই মনে পড়ে গেল আজ নিজের টিফিন গোছানোর সময়। কথাটা মা খুব বলত ছোটবেলায়। আসলে আমার নানা বায়নার ঝক্কি নিতে হত মাকে। সত্যি মায়ের ওপর কত জুলুম করে এসেছি এখনও করি। মা যখন আমায়  মাখন পাঁউরুটি দিত, আমারটায় পাউরুটির দু পিঠেই ভালো করে মাখন লাগিয়ে দিতে হত। না হলে আমি খেতাম না। আর একটি মাত্র হবার সুবাদে আমার জোরজুলুম বেশিই চিরকাল মা বাবার প্রতি। 

যাইহোক আজ নিজের টিফিন নিজে গোছাবার সময় যখন একপিঠেই ভালো করে মাখন লাগাবার সময় না পেয়ে কোনমতে যাহোক তাহোক করে মাখন লাগিয়ে বক্সে ভরছি তখন মায়ের বলা প্রবাদ মনে পড়ছে। সবার বাড়িতেই মা ঠাকুমারা এসব বলে আসতেন আগে যার কিছু আমি বা আমরা আজ অতি আধুনিকতার যুগেও সত্যি হতে দেখি। সত্যি নিজের হাতে নিজেকে যত্ন করা হয়ে ওঠে না।  অবলীলায় আজ মনকে বোঝাতে পারি যা হয়েছে ওই অনেক এটাই খেয়ে নেব আজ। পটল, লাউ, কুমড়ো, পেঁপে কোন সবজিই খাদ্য তালিকায় ছিল না। আজ তারা আমার থালায় আমাকে দেখে হয়তো মুচকি হাসে। আমিও হাসি আর নিজেকে বলি- নে কাকে বলবি বল খাব না যাও। 

আসলে নিজের ওপর জুলুম করা অত সহজ নয়। করি না আমরা। আসে তখন আপোষ। তাই খেয়েও নিলাম। অথচ এটাই অনেকগুলো বছর আগে আমাকে কেউ খাওয়াতে পারত না। মাছ একদিন না হলে পাতে বসতাম না। আজও বসি না, যদিও কিন্তু সেই চাইই চাইটা আজ নেই। একটা সমঝোতা হয়ে যায় কখনও সখনও নিজের সাথে। 

আমি আর সমঝোতা? দুটো উল্টো দিক চিরকাল। তবুও এক এক সময় চরম ক্লান্ত লাগে। হার মানাও সয় না, জেতাও হয়ে ওঠে না। এক অদ্ভুত লড়াই চলে নিজের সাথে নিজের। তখন কারোর জন্য একটা কথাও খরচ করতে ইচ্ছা হয় না। অনর্গল কথাবলার জন্য যাকে বুলবুলি বলা হত সেও ডানা গুটিয়ে চুপ করে বসে। ঝড়ে এলোমেলো হওয়া ডালে বসেও পালায় না সে। তান্ডবের মাঝে তাল খোঁজে নিজের। ভোরের হাওয়ায় সব ভালো হবে এই ভেবে যায়। 

জুলুম আমার চিরকাল ছিল নানাভাবে। বিনুনী দু পাশে স্কুলে যাবার সময় প্রায় রোজ মায়ের কাছে চিরুনী পেটা খেয়ে চোখমুখ লাল করে বেরোতাম। সেখানেও সেই মায়ের ওপর জুলুম - বিনুনী এত টাইট করতে হবে তাতে যেন আঙুল না গলানো যায় আর দুটো যেন সমান ডিস্ট্যান্সে থাকে। অদ্ভুত আবদারের জ্বালা সইত মা। এই নিয়ে রোজ একপ্রস্থ কান্নাকাটি মার বকা খেয়ে রিক্সাতে উঠতাম। আজ একমাথা চুল অলসতায় একটা ক্লিপে আটকে সারা দুনিয়া করছি। নিজেকে স্বস্তি দিতে বলছি, এটাই ঠিক। বেশি টাইট করার দরকার কি? আসলে সময় যে সব বাঁধনই আলগা করতে শেখায়। 

আমাদের সময়ে ডিম সুতো দিয়ে আধখানা করে খাওয়া হতো। আমার ভাগেরটা বড় চাই। এটা নিয়েও ঝামেলা কম করিনি। আজ ফ্রিজে ডিমের ট্রে ভর্তি। কিন্তু সেই আধখানা ডিমের ছোট বড় নিয়ে ঝামেলা নেই। ডিমের সে স্বাদও নেই। মাছের ল্যাজা আমায় দেওয়া হত না, আমি চাইলেও। মা ভয় পেত যদি গলায় কাঁটা আটকায়। তাই  বড় বড় রুই কাতলার মত জ্যান্ত মাছের বড় মুড়ো বা গাদার পিস আমার জন্য বরাদ্দ ছিল। ল্যাজা খাবার খুব বায়না করলে বড় ভেটকি মাছ আনত বাবা সেটার ল্যাজা আমায় দিত মা, তাতে কাঁটা নেই। কি সুন্দর সাপ মরল অথচ লাঠি ভাঙল না। স্নেহের আড়ালে সব কাঁটা দূর করে একটা বড় ল্যাজা পড়ত আমার পাতে। আজ রুই কাতলা এমনকি, ইলিশের কাঁটা ভরা ল্যাজাটা বসে বসে খাই। কেউ খেতে জোর করে না, কিন্তু আমি নিজেই নিয়ে খাই। মায়ের কাছে শেখা সবাইকে ভালো ভাবে দিয়ে নিজে নাও। চরম নারীবাদীরা হয়তো বলবে কেন আমি ভালোটা খাব না? আমি বলব অন্যরা ভালো করে খেলে অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করে। তাই তো ভালোবেসেই খাই। ভালোলাগা ও ভালোবাসা এখন অন্য খাতে বইছে। এখন নিজের হাতে হাঁড়ি আর জীবনের ভারসাম্য। আর জীবনের চলার পথে এত কাঁটা দেখি এগুলো কিছুই মনে হয় না। আমি নয় শুধু আমার অনেকেরই (পুরুষ নারী ভেদ করছি না) জীবন এগিয়ে যায় অনেকভাবে কখনও সোজা বা কখনও বাঁকা পথে অনেক ঝড় ঝাপসা সামলে। 

আসলে ছোট বেলাটা ছিল হ্যাপি প্রিন্সের মত। সবারই মোটামুটি তাই থাকে। মা বাবারা সব খারাপ গুলো উঁচু পাঁচিলের আড়ালে রেখে দেন যাতে সন্তান না কোনও কষ্টের স্পর্শ পায়। জীবনের স্রোত যত এগোয় সে পাঁচিল ছোট হয়, একদিন ভেঙেও যায়। তখন রুক্ষ শুষ্ক বাস্তব সামনে এসে দাঁড়ায় আর - বলে কতদিন আড়ালে রাখবে আমায়। পারবে না। মেনে নাও আমায়। এগিয়ে চলো সময়ের সাথে। লড়াইটা উপভোগ করাটাও জীবন। 

আমরা মোকাবিলা করি, ভাঙি, গড়ি, মুখোশের আড়ালের সব সম্পর্কের আসল চেহারা দেখি। ভয় পাই। সামলেও যাই। এভাবেই চলতে থাকে পরিণতির দিকে একটা জীবন। যে পেল অনেক কিছু -সে হাসল। যে পেল না সে কাঁদল। কেউ অবহেলায় হারালো তো কেউ অতি যত্নে শুকিয়ে গেল। কেউ আবার পাওয়া না পাওয়ার হিসেবই করল না কোনদিন। চিরকাল বয়ে গেল অজানা আনন্দে মোহনার দিকে। সবের শেষেই পরম শান্ত এক দুনিয়া আছে। একটা সময় আসে আমরা ভীড়েও একা হই। সেই একা আমিটাকে একাই বুঝে নিতে হয়। নিজের মত করে। মায়ের মত স্নেহ দিয়ে বা কখনও ধমকে বা কখনও কান্না হাসিতে।

হ্যাপি প্রিন্সের ছোট্ট সোয়ালোর মত বন্ধু কোথাও না কোথাও আছেই। খুঁজে পেতে হয় কলুষতা দূরে সরিয়ে। স্বার্থের দুনিয়ায় সে থাকে না। সেদিন অন্তর শুদ্ধ হবে তার গান তার কোমল পালকের স্পর্শ ঠিক তোমায় জানান দেবে তুমি এবার সব বিলিয়ে দিতে পারো ভালোর জন্য আলোর জন্য। মুক্তির আলো ছুঁয়ে যাবে সবটুকু ভালোবাসা নিয়ে তোমাকে আমাকে আমাদেরকে। 

"বাঁশি যতবার বাজে,

শুরু, শেষ আর মাঝে 

ততবার করে শুরু হয় খেলা 

শেষ হতে চায় না যে।"

(www.theoffnews.com myself yourself ourselves)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours