দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:
গুত্তোনি খাওয়ার ভয় যে একেবারেই নেই তা নয়। তবুও ধর্ম নিয়ে কিছু লেখার তাগিদ অনুভব করেছি। প্রসঙ্গ ধর্ম হলে অধর্ম আসবেই। অধর্মের সর্বব্যাপিতা আজ প্রাতিষ্ঠানিক। নইলে একজন প্রতিভাময় চিকিৎসকের আরজিকরে এমনভাবে গণধর্ষণের পর এমন নৃশংস মৃত্যু হয়? তুমি তো বলেছিলে, যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মনং সৃজামহ্যম্।। পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।
আর কবে??
রাজধর্ম নেই। বিচার নেই। জনতা রাজপথে। এ কোন ধর্ম যখনই আর জি করের বিরলতম মৃত্যুর বিচার চাইছে মানুষ, তখনই ধর্মের ককটেলে মিশে বুদবুদ উঠছে, হাথরস, উম্মাও। কেন? সমস্ত প্রমাণ লোপাট যদি শাসনযন্ত্রের ধর্ম হয়, আমারও ধর্ম প্রতিবাদ একমুখী করা। বহুমুখী নয়। প্রতিবাদ ডায়লিউট না হতে দেওয়া। এই একটি প্রতিবাদী আন্দোলন সব সম্প্রদায়, সব ধর্মকে একত্রিত করেছে। এটাই ধর্মের সার্থকতা। এই ধর্ম মানবধর্ম। যা ঐশী ধর্ম থেকে শক্তিশালী।
তবে ধর্ম কী ঈশ্বরহীন নাস্তিকতা, আচার সর্বস্ব সীমাহীন কল্পনা? আবেগ? না, আধ্মতিকতা? প্রশ্ন জাগে, আমরা কি ধর্ম মানি না? চরম অবমাননা করি? নাহলে এতো দুর্নীতি, অন্যায়, নৃশংসতা নিয়ে আছি কী করে? এর জন্য প্রথাগত ধর্ম কতটা দায়ী বা দায়ী কিনা সেটা আলোচনা করতে গেলে আগে সেটাই জানা জরুরি।
ধর্ম কী? তার নতুন ব্যাখ্যা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। আমরা সবাই জানি, সংস্কৃত "ধৃ" ধাতুর সঙ্গে "মন্" প্রত্যয় যোগ করে ধর্ম শব্দের উৎপত্তি। এখন প্রশ্ন, ধর্ম আমাকে ধারণ করেছে? না আমি ধর্মকে ধারণ করেছি?
পারিবারিক সংস্কার থেকে ধর্ম গৃহীত হয়। আবার সংস্কার বোধ রহিত হয়েও অনেকেই ধর্ম গ্রহণ বা ধারণ করেন। সেই ধর্ম কী? সেটা একমাত্র মনুষ্যত্ব নির্ভর, আচার নির্ভর নয়। কিন্তু আচার হলো শৃংখলাবোধ। একসঙ্গে দুটির সমঞ্জস মেল বন্ধনে ধর্ম গড়ে ওঠে। হিন্দু শাস্ত্রের কথা যদি বলি, তবে প্রথমেই মনুসংহিতার কথা আসে। "অহিংসাসত্যমস্তেয়ং শৌচং সংযমমেব চ। এতৎ সামাসিকং প্রোক্তং ধর্মস্য পঞ্চ লক্ষণম। " অর্থ: হিংসা না করা, চুরি না করা, অসংযমী না হওয়া, শৌচ থাকা, সত্যাশ্রয়ী হওয়া।
বৈশেষিক দর্শন বলে, "যতোবাহদ্যুয়-নিশ্রেয়সসিদ্ধি: সধর্ম :।"
যা থেকে জাগতিক ও পারমার্থিক কল্যাণ হয় তাকে ধর্ম বলে।
কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট ধর্ম এবং ঈশ্বর বা অবতার সৃষ্ট ধর্ম নিয়ে বহু মতান্তর আছে। রামকৃষ্ণ দেব সার বুঝে বলেছেন, "যত মত তত পথ।" সব মার্গ দর্শন করে বলেছেন, গুড় অন্ধকারেও মিস্টি।
কিন্তু সমস্যা সব ধর্ম এক কথা বলে না। প্রচলিত ধর্মের মধ্যে গুড়ের মিস্টত্বর প্রতিযোগিতা আছে। শুধু তাই নয়, অন্যের ধর্ম থেকে শ্রেষ্ঠ এবং অন্য ধর্মের প্রতি খড়্গ হস্ত হতে দেখা গেছে। হিন্দু ধর্মের মধ্যে শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব এবং বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে বিরোধ আজ আর নেই। সময়ের তাগিদে আত্মীকরণ ঘটেছে। জাতিভেদ প্রথার অসাড়তা দেরী হলেও, আজ শতধা প্রথাগত হিন্দু ধর্ম অনেকটাই বুঝতে পেরেছে আমরা সবাই অমৃতের পুত্র। আমাদের উৎস এক। এই তথ্য অনেকেই অস্বীকার করে চায়ের পেয়ালায় তুফান তুলতে পারেন। আমার আপত্তি নেই। কিন্তু এই পরিবর্তন আমি চাক্ষুষ করছি প্রতিনিয়ত। শিক্ষার আলোকে আজ দাবি উঠছে শুধু নয়, জোর গলায় উচ্চারিত হচ্ছে, জন্মসূত্রে কেউ ব্রাহ্মণ হয় না। "জন্ম না জায়তে শুদ্র। সংস্কারাৎ উচ্চতে দ্বিজ। বেদ পাঠ ভবেৎ বিপ্র। ব্রহ্ম জানাতি ব্রাহ্মণ।" বিপ্র হলো ইন্টেলেকচুয়াল। ব্রাহ্মণ একটি অবস্থা বা দশা মাত্র। যা পরিবর্তন শীল এবং আচরণ নির্ভর। গায়ত্রী মন্ত্রের রচয়িতা একজন তথাকথিত অব্রাহ্মণ বিশ্বামিত্র। সময়ের দাবি মেনে অস্পৃশ্যতার মতো অভিশাপ দূরীভূত হওয়ার পথে। কিন্তু এই অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠেছে ধর্মবোধের গহ্বর থেকেই। বোধিসত্ত্ব, মাতঙ্গ নামে একটি চন্ডাল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সেই সময় প্রাচীন ভারতে বর্ণ-প্রথা ছিল অত্যন্ত কঠোর এবং অস্পৃশ্যতা প্রবল ছিল।
একদিন, ধনী এবং তথাকথিত 'উচ্চ বর্ণ' পরিবারের মেয়ে, এক সুন্দরী কন্যা দিত্তমঙ্গলিকা তাঁকে জাত্যাভিমানে অপমান করেন। কিন্তু মাতঙ্গের ধর্ম বোধ দেখে প্রভাবিত হন। দিত্তমঙ্গলিকার অহংবোধ দূর হয়ে যায়। তখন মাতঙ্গ তাকে সম্মান করার সিদ্ধান্ত নেন। তাই, তিনি তাকে তার সমস্ত আত্মীয়দের আমন্ত্রণ জানাতে এবং একটি প্রকাশ্য ঘোষণা করতে বলেছিলেন যে তার স্বামী তার ধার্মিক কর্মের মাধ্যমে 'শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ'।
হিন্দু সনাতনী ধর্মকে টার্গেট করা হয়। সাম্যবাদ মার্কসীয় দর্শন ধর্মকে আফিম সেবনের সঙ্গে তুলনা করলেও, এই দর্শনের আক্রমণের একমাত্র লক্ষ্য হিন্দু সনাতন ধর্ম। জাতিভেদ প্রথা বা বর্ণভেদ এই ধর্মকে সঙ্কীর্ণ করেছে। তাই এতো অন্যায়? গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন - তিনি গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে চারিবর্ণের সৃষ্টি করেছেন। চারজাতি নয়। মহাভারত রচয়িতা ব্যাসদেব, ব্রাহ্মণ ছিলেন না। ত্রেতা যুগে রামায়ণ রচনাকার মহর্ষি বাল্মীকি, ব্রাক্ষণ ছিলেন না। মহাভারতে তিন নীতির যুদ্ধ বলে জানা যায়। ধর্মনীতি, রাজনীতি এবং কূটনীতি। ধর্মনীতি যিনি ধারন করেন তিনি শ্রীকৃষ্ণ। রাজনীতি যিনি ধারন করে আছেন - তিনি মহামতি বিদুর। আর কূটনীতির ধারক - শকুনি। মহামতি বিদুর ব্রাক্ষণ ছিলেন না, ছিলেন দাসী পুত্র শূদ্র। বিশ্বামিত্র ক্ষত্রিয় থেকে ব্রাহ্মণ হন। ত্রিশঙ্কু হরিশ্চন্দ্রের পিতা ছিলেন ঐতেরিয় ব্রাহ্মণ। কিন্তু পাপাচারে বহুবার চণ্ডাল হন। উপবীত ধারণের কথা বলা হয়। মনুসংহিতায় সবার উপবীত ধারণের কথা বলা আছে। যদু বংশের শ্রীকৃষ্ণ পুত্র শাম্বর উপনয়ন হয়। একইভাবে শ্রীরামচন্দ্রেরও উপবীত ধারণের কথা জানা যায়। তাই এই যুক্তি খাটে না। নারীকে যথাযথ মর্যাদা বা সম্মান প্রদর্শন প্রথাগত ধর্ম দেয় নি। এই অভিযোগও ওঠে। এব্যাপার বহুচর্চিত শ্লোকটি হলো---
পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্তা রক্ষতি যৌবনে।
রক্ষত্তি স্থবিরে পুত্ৰা ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি।।
(মনুসংহিতা:৯.৩)
"ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি।।" এই কথাটি সব থেকে বেশি সমালোচিত।
"বিবাহের আগে কুমারী অবস্থায় স্ত্রীলােককে পিতা রক্ষা করবে, যৌবনকালে বিবাহিতা স্ত্রীকে স্বামী রক্ষা করবে, আর বৃদ্ধাবস্থায় পুত্রেরা রক্ষা করবে; পতি-পুত্রবিহীনা স্ত্রীকেও সন্নিহিত পিতা প্রভৃতিরা রক্ষা করবে।কোনও অবস্থাতেই স্ত্রীলােককে অরক্ষিত স্বাতন্ত্র্য অবস্থায় রাখবে না। মনুসংহিতার নবম অধ্যায়ের এই শ্লোকটিতে ভাল করে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, শ্লোকে 'রক্ষতি' শব্দের সুস্পষ্ট ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাৎ নারীকে পরাধীনতার নাগপাশে বদ্ধ নয় তাকে সকল অবস্থাতেই রক্ষা করতে হবে। গৃহের লক্ষ্মী স্বরূপা নারী যেন কোন অবস্থাতেই দুর্দশাগ্রস্ত না হয়। "রক্ষতি" কথাতেই অনেকের আপত্তি। আবার "স্বাতন্ত্র্যমর্হতি" কথায় আপত্তি। কিন্তু এর মধ্যেই "রক্ষিত " কথাটি লুকিয়ে আছে। স্বাতন্ত্রবোধের বিরোধিতা করা হয়নি। অরক্ষিত স্বাতন্ত্র্যের কথা বলা হয়েছে।
এই শ্লোকটিও বহু শ্রুত। ধর্ম রক্ষতি রক্ষিতঃ। এটির অর্থ হলো "ধর্ম তাদের রক্ষা করে যারা এটি রক্ষা করে।" শুধু শব্দের হেরফের। যদি আপত্তির থাকে তা বর্জনীয়।
মনুসংহিতার অন্য শ্লোকগুলি দেখা যাক:
পরদারাভিমর্ষেষু প্রবৃত্তান্ নৃন্ মহীপতিঃ।
উদ্বেজনকরৈর্দণ্ডৈশ্চিহ্নয়িত্বা প্রবাসয়েৎ।।
(মনুসংহিতা:৮.৩৫২)
"যারা পরস্ত্রী নারীদের জোরপূর্বক যৌন মিলনের প্রচেষ্টা করে ব্যভিচারে রত হয়, রাজা তাদের নাক-কান ছেদন করে এমন শাস্তি দিবেন; যা দেখে সকলে ভীত হয়। সে অবস্থায় তাদের দেশ হতে বিতারিত করতে হবে।"
নারী, শিশু ও জ্ঞানীদের যারা হত্যা করে, তাদের মত পাপী আর নেই। তাই তাদের মৃত্যুদণ্ডের মত কঠিনতম শাস্তি প্রদান করতে হবে।
কূটশাসনকর্তৃংশ্চ প্রকৃতীনাঞ্চ দূষকান্।
স্ত্রীবালব্রাহ্মণঘ্নাংশ্চ হন্যাদ্দ্বিটসেবিনস্তথা।।
(মনুসংহিতা: ৯.২৩২)
আবার নারীকে পূজিতা বলা হয়েছে--প্রজনার্থং মহাভাগাঃ পূজার্হা গৃহদীপ্তয়ঃ।
তাহলে এটা পরিস্কার সনাতন ধর্ম কোনভাবেই মানুষের নৈতিক অবক্ষয়ের কারণ হতে পারে না।
মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ ধর্ম সম্পর্কে অর্জুনকে বলেনঃ-
"ধারণাদ্ধর্মমিত্যাহু ধর্মো ধারয়তে প্রজাঃ |
যৎস্যাদ্ধারণ সংযুক্তং স ধর্ম ইতি নিশ্চয়ঃ ||"
(মহাভারত কর্ণপর্বঃ- ৬৯/৫৮)
ভাবার্থঃ-
সমাজকে, প্রজা সাধারণকে ধারণ যা করে রাখে তাই ধর্ম। কিসে প্রজার ও সমাজের সমৃদ্ধি, কল্যাণ হয়, তা বিচার করে স্থির করতে হবে। কারণ সেটিই হচ্ছে ধর্ম তথা বেদ বিহিত কর্ম।
ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ তথাকথিত অব্রাহ্মণ স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন,
"পরোপকারই ধর্ম, পরপীড়নই পাপ। শক্তি ও সাহসিকতাই ধর্ম। দুর্বলতা ও কাপুরুষতাই পাপ। স্বাধীনতাই ধর্ম, পরাধীনতাই পাপ। অপরকে ভালবাসাই ধর্ম, অপরকে ঘৃণা করাই পাপ। ঈশ্বর এবং নিজ আত্মাতে বিশ্বাসই ধর্ম, সন্দেহই পাপ।" (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ষষ্ঠ খন্ড, পত্র নং ৫১)
সনাতন ধর্ম উদার তার সমালোচনা করা যায়। অতীতে না গেলেও, এখন তো যায়। তাই তো মনুসংহিতার আড়াই হাজার শ্লোকের মধ্যে বেশ কয়েকটি শ্লোককে আমরা আপত্তিজনক বলতে পারি। তার পরেও মানতে পারি: স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ॥ এখন আমাদের ঠিক করতে হবে স্বধর্ম প্রকৃত অর্থে কী?
সনাতন ধর্ম কখনও বলে না একমাত্র তাদের ভগবান সত্য। বাকি সব মিথ্যা। সাকার ও নিরাকার নিয়ে যারা তর্ক করেন, তারা বোঝেন না শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের মহাবাক্য:
"সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম" ব্রহ্মইএই চরাচর জগতের রূপধারণ করেছেন, তাই সর্বত্রই ব্রহ্মময়। তারা মূর্তি পূজা নিয়ে কটূক্তি করে ধর্মবোধকে বিষিয়ে তার মঙ্গল রূপ বিনষ্ট করেন। সনাতন ধর্ম কখনও বলে না, একমাত্র সনাতন ধর্মালম্বীদের মঙ্গল হোক। সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ। মা কশ্চিৎ দুঃখভাগ্ভবেৎ।। বঙ্গানুবাদ: হে ঈশ্বর, জগতের সকলে যেনো সপরিবারে সুখী থাকে, সকলে যেনো সর্ব রোগভোগ থেকে মুক্তি পায়, জগতের কারোর যেনো কখনো কোনো বিপদের উৎপত্তি না ঘটে।
এই যদি ধর্মের মঙ্গলময় রূপ হয়, তাহলে নাস্তিককেরও নিন্দা করবে না সেই ধর্ম। আমার জ্ঞানমতে সনাতন ধর্ম এই অধর্ম কখনও করেনি, করে না এবং করবেও না।
(www.theoffnews.com religion)
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours