পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
সিভিক ভলান্টিয়ার। ‘পুলিশ’ তকমা উঠে গেলেও অনেকে এখনও ‘সিভিক পুলিশ’ বলেও ডাকেন। বস্তুত, পুলিশের সহায়তা করার জন্যই এই বাহিনীর জন্ম হয়েছিল বাংলায়। তখনও নামে ‘পুলিশ’ ছিল। পরে তা বদলে যায়। তবে পুলিশের সঙ্গে থাকতে থাকতে সিভিক ভলান্টিয়াররা যে অনেকে নিজেদের পুলিশের সমকক্ষ ভাবতে শুরু করেন, তার নজিরও বাংলায় অসংখ্য। আনিস খান হত্যাকাণ্ড থেকে আর জি কর কাণ্ড, আরও বহু বিতর্কে জড়িয়েছে সিভিক ভলান্টিয়ারদের নাম। কিন্তু সিভিক ছাড়া বাংলার বর্তমান পুলিশ ব্যবস্থাটাই অচল। সরকারি নির্দেশিকা অনুযায়ী, শুধুমাত্র পুজো, উৎসবে পুলিশকে সহযোগিতা করতে পারবে সিভিক ভলান্টিয়াররা। এছাড়া ট্র্যাফিক সামলানোর দায়িত্ব পালন করবে তারা। বেআইনি পার্কিং আটকাতে পুলিশকে সহযোগিতা করবে। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার কাজে পুলিশকে সাহায্য করবে। কিন্তু সিভিক আদতে কি করে? রাস্তাঘাটে ট্রাফিক দেখে। তোলা তোলে। বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায়, গাড়ি থেকে, বাইক থেকে আপনাকে নামিয়ে গাড়িতে বসে থাকা বড়বাবু, মেজবাবুর কাছে নিয়ে যায়। কনস্টেবল-এএসআই এর হক ছিনিয়ে কোথাও কোথাও সিভিক আবার ডাক পার্টিও। সিভিক মানে সব। বড়বাবুর গরম চা-তেলে ভাজা থেকে, রাতের জনি ওয়াকার। বাংলার পুলিশের আশ্চর্য প্রদীপ সিভিক ভলেন্টিয়ার।
২০০৮ সালে কলকাতায় যান নিয়ন্ত্রণের জন্য পুরসভা ‘গ্রিন পুলিশ’ নামে একটি বাহিনী তৈরি করেছিল। যদিও বাহিনী তৈরির মূল উদ্যোগ শুরু হয় ২০১২ সালে। এই মুহূর্তে রাজ্যে দুই লক্ষেরও বেশি সিভিক ভলান্টিয়ার রয়েছে বলে খবর। তবে এঁদের নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক ছিল। বিরোধীরা রাজ্য সরকারের এই বাহিনীকে শাসক তৃণমূলের ‘ইউনিফর্ম পরা ক্যাডার’ বলেও অনেক সময় দাবি করেছেন। সিভিক ভলান্টিয়ারদের নিয়ে পুলিশবাহিনীতেও সমালোচনা শুরু হয়েছিল। মূল আপত্তি ছিল বাহিনীর নামে ‘পুলিশ’ শব্দটি নিয়ে। অন্য দিকে, নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে সেই সময় সরব হতে শুরু করেছিল সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ারদের সংগঠন। বিপদ বুঝে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাহিনীর নাম থেকে ‘পুলিশ’ শব্দটি ছেঁটে দেয় রাজ্য সরকার। ‘সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ার্স’ শুধু ‘সিভিক ভলান্টিয়ার্স’ হয়ে যায়। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, বাহিনী তৈরির সময়ে যা ভাবনা ছিল, তাতে পুলিশের ‘সাহায্যকারী’ হিসেবে সিভিক ভলান্টিয়ারদের চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ করেছিল রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর। ছ’মাস অন্তর ওই চুক্তির পুনর্নবীকরণ হওয়ার কথা। এঁদের দায়িত্ব মূলত যানশাসন ও মেলা-পার্বণে ভিড় সামলানো। নবান্নের তরফে বলা হয়েছিল, জেলা স্তরে কমিটি তৈরি করে সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ার্স বাছাই করতে হবে। শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিক হলেই চলবে। প্রত্যেককে মাসে অন্তত ২০ দিন কাজ দিতেই হবে।
সম্প্রতি সিভিক ভলান্টিয়ারদের বেতন বাড়ানো হয়েছে, বেড়েছে তাদের বোনাসও। পুরস্কৃত করার ঘোষণা করেছেন। প্রশাসনিক কর্তাদের নিয়ে বৈঠকে কোনও সিভিক ভলান্টিয়ার ভাল কাজ করলে তাঁকে স্থায়ী চাকরি দেওয়া যায় কি না, তা নিয়েও পদস্থ আধিকারিকদের ভাবতে বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। নবান্ন সূত্রের খবর, এই মুহূর্তে রাজ্যের বিভিন্ন থানায় অনেক কনস্টেবল পদ খালি রয়েছে। সেখানে ‘দক্ষ’ সিভিক ভলান্টিয়ারদের নিয়োগ করা যায় কি না, তা ভাবার জন্য তাঁর অধীনস্থ স্বরাষ্ট্র দফতরকে পরামর্শ দিয়েছেন মমতা। এই দায়িত্ব মূলত থাকবে সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপারের উপরে। তিনি আবার সুপারিশের জন্য নির্ভর করবেন যে থানা এলাকায় ওই সিভিক ভলান্টিয়ার কাজ করছেন, সেখানকার ওসি এবং এসডিপিও-র রিপোর্টের উপরে। এতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছেন অনেকেই, কারণ বড় কর্তাদের কাছে ভাল হতে গিয়ে বা বেশি কাজ দেখাতে গিয়ে অনেক সিভিক ভলান্টিয়ারই নিজেদের এক্তিয়ারের বাইরে চলে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা।
এখন রাজ্যে যে নিয়ম, তাতে ২০ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে বয়স হলেই সিভিক ভলান্টিয়ার পদের জন্য আবেদন করা যায়। সর্বনিম্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে অষ্টম শ্রেণি পাশ। যে থানার অধীনে নিয়োগ হবে, সংশ্লিষ্ট সিভিক ভলান্টিয়ার সেখানকারই বাসিন্দা কি না, তা-ও দেখা হয়। তবে পাশাপাশিই বলে দেওয়া হয়, যাঁরা এই কাজ পাবেন, তাঁরা কোনও ভাবেই নিজেদের ‘স্থায়ী সরকারি কর্মী’ হিসাবে দাবি করতে পারবেন না। সিভিক ভলান্টিয়ার হতে গেলে দু’সপ্তাহের একটি প্রশিক্ষণও নিতে হয়। অনলাইন নয়, অফলাইনেই আবেদন এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া হয়। নতুন নিয়মে মাসে ৩০ দিনই দৈনিক আট ঘণ্টা করে কাজ করতে হয়। সেই সময় কোনও কারণে বেড়ে গেলেও সে জন্য অতিরিক্ত পারিশ্রমিক পাওয়া যায় না। বছরে ১৪টি ‘ক্যাজ়ুয়াল লিভ’ মেলে। অসুস্থতা এবং দুর্ঘটনাজনিত কারণে সিভিক ভলান্টিয়ারদের বিমার সুযোগসুবিধাও দেয় রাজ্য সরকার।
এই সিভিক নিয়ে অন্য রকম ভেবেছিলেন বাঁকুড়ার বড়বাবুদের বড়বাবু। সিভিকরা পড়াবেন শিশুদের। মন্দ কি। কয়লা, বালি, ধুলো-কালি, ছেড়ে চক-ডাস্টারের সুনামে ক্ষতি কোথায়। পুলিস সুপারেরও একটু কৃতিত্ব আর সিভিকের একটু অন্য জীবন। সেই সূত্রেই বাঁকুড়া জেলা পুলিশের উদ্যোগ নিয়েও বিতর্ক বেধেছিল। ব্যাপারটি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। পরে অবশ্য রাজ্য শিক্ষা দফতর এবং পুলিশের পক্ষে বিষয়টি স্পষ্ট করে জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, বিদ্যালয়ে নয়, তার চৌহদ্দির বাইরে প্রাথমিকের পড়ুয়াদের পড়াবেন সিভিক ভলান্টিয়াররা। যান সামলানো ছাড়া সিভিকরা যে সব কাজ মূলত করে থাকেন আলোচনার প্রথমেই তা বলেছি। কারও যদি যোগ্যতা থাকে তাহলে তোলাবাজি বা ভয় দেখানো বাদ দিয়ে কিছু গঠনমূলক কাজ তারা করতেই পারেন। কিন্তু পুলিশের সাহচর্যে থাকতে থাকতে নিজেদের পুলিশ ভাবতে শুরু করা এবং তার অসাধু প্রয়োগ ক্রমেই কালিমালিপ্ত করে তুলছে এই পেশাটিকে। পুলিশও বুঝতে পারছে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের জন্ম দিয়েছে তারা, যাকে নিয়ন্ত্রণ করা এখন তাদেরই হাতের বাইরে। সামাজিক স্বেচ্ছাসেবকরা তাই অসামাজিকতা ছেড়ে সর্বদা সমাজ গঠনে সামাজিক হোন এটাই সকলের দাবি।
(www theoffnews.com West Bengal civic police)
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours