রণজিৎ গুহ, লেখক ও সমাজকর্মী, দুর্গাপুর:
(লেখক প্রাক্তন ইস্পাত কর্মী)
এখন বছরের প্রতিটি দিনই কোনও না কোনও দিবস হিসাবে পালিত হয়। হ্যাংলা দিবস, বুভুক্ষু দিবস, টমেটো দিবস,গালি দিবস, চপলতা দিবস, অট্টহাসি দিবস, শৃগাল দিবস, প্রজাপতি দিবস। আবার কবিতা দিবস,পুস্তক দিবস, সঙ্গীত দিবস, বন্ধুত্ব দিবস, ভালবাসা দিবস এসবও আছে। শিশু দিবস,বাল্য দিবস, যুব দিবস, নারী দিবস, প্রবীণ দিবস, ক্রীড়া দিবস, যোগ দিবস ইত্যাদিও পালিত হয়। এত এত দিবস ৩৬৫ দিনে কুলিয়ে ওঠা যায় না। একই দিনে দুটো বা তিনটে দিবস পালন করতে হয়। যেদিন স্বাক্ষরতা দিবস সেদিনই ফিজিওথেরাপি দিবস। যেদিন শরনার্থী দিবস সেদিনই প্রাচীন অট্টালিকা দিবস। কিছু দিবস আন্তর্জাতিক। ইউএনও বা ইউনেস্কো কিংবা অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ঘোষণা করে। সারা বিশ্বে পালিত হয়। কিছু কিছু দিবস দেশজ। শিক্ষক দিবস বা চিকিৎসক দিবস একেক দেশে আলাদা আলাদা দিনে পালিত হয়। আবার শ্রমিক কর্মচারী দিবস বিশ্বের সব প্রান্তে ১লা মে পালিত হয় অথচ সে হিসাবে এই দিনটির ঘোষণা সরকারি ভাবে কেউ করেনি। কিন্ত এক শ্রমিক আন্দোলনের স্মৃতিতে পালিত হয়ে আসছে। আমিষ ভোজীদের জন্য নির্দিষ্ট দিন আছে কিনা আমি জানি না, তবে বিশ্ব জুড়েই নিরামিষ দিবস পালিত হয়। পর্বত দিবস আছে। দ্বীপ দিবস আছে। নদী দিবস, সাগর দিবস আছে আবার আলাদাভাবে জল দিবসও আছে। পর্যটন দিবস বা প্রতিবেশী দিবস আছে। বাবা দিবস, মা দিবস, ভাই দিবস, ভগিনী দিবস এমনকি ঠাকুর্দা ঠাকুমা দাদু দিদিমা দিবসও আছে। পুলিশ দিবস, সৈন্য দিবস যেমন পালিত হয় তেমনই নৌযান দিবস এবং বিমান দিবসও পালিত হয়।মাতৃদুগ্ধ দিবস যেমন আছে আলাদাভাবে, মাতৃত্ব দিবস ও অন্তসত্ত্বা দিবসও পালিত হয়। বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস আছে, আবার আলাদা আলাদা স্প্যানিশ, ফরাসি, আরবিক ভাষা দিবস আছে। অনেক অসুখ বিসুখ এর জন্যও নির্দিষ্ট দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। বিশ্ব মধুমেহ দিবস, কর্কট রোগ দূরীকরণ দিবস, হৃদপিণ্ড দিবস। সে না হয় নানান দিবস পালিত হল। কিছু হৈ-হুল্লোড়। শপথ গ্রহণ, আলাপ আলোচনা। জন সচেতনতা। সেসব মন্দ কি! সামান্য গোলমালে পড়ি যখন দিবস পালনে উৎসাহী কেউ হোয়াটসঅ্যাপে শুভেচ্ছা পাঠায় 'হ্যাপ্পি অটোমোবাইল ডে' বা 'হ্যাপ্পি পরিবহন দিবস'। এই শুভেচ্ছা নিয়ে আমি কি করব বুঝতে পারি না। সম্পর্কে ভাইপো মেসেজ পাঠালো-
"জেঠু প্রবীণ দিবসের প্রণাম নিও।" যাক তবু একটা দিন জেঠুকে মনে পড়েছে। ও হরি পরে জানলাম আশেপাশে পরিচিত কোনও বুড়োর সাথেই ভাব ভালোবাসা নেই তাই দিবস উদযাপনে জেঠু ভরসা।
অনেকেই বলেন এই সব দিবস পালন ইদানিংকার অনাবশ্যক বিলেতি ঢঙ। শুভেচ্ছা পত্র বিক্রি করার কৌশল। অনেকে বেশ বিরক্ত। সম্বৎসর খোঁজ নেই বছরে একদিন বাবা দিবস বা মা দিবস। যত আদিখ্যেতা। ন্যাকামি। আমাদের সমাজে দিবস পালন অবশ্য নতুন কিছু নয়। সে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, শিখ, খৃষ্টান যে ধর্মেরই হোক সকলেই বছরভর নানা দিবস পালন করে আসছে। প্রচলিত ধর্মাচরণে যারা মোটেও আগ্রহী নন তাঁরাও দেশাচার লোকাচার হিসাবে কিছু দিবস পালন করে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। অবশ্য এই দিবসগুলি অধিকাংশ পালিত হয় নির্দিষ্ট তারিখের বদলে তিথিতে।বিশ্বকর্মা পুজো যা কিনা বলা যেতে পারে মিস্ত্রি দিবস কিংবা বড়দিন পালিত হয় নির্দিষ্ট তারিখে। মহরম শোকদিবস হিসাবে পালিত হয় তিথি অনুযায়ী। ইস্টার বা গুডফ্রাইডের সেভাবে নির্দিষ্ট তারিখ নেই। বুঝে না বুঝে কতজনাই যে হ্যাপি মহরম হ্যাপি ইস্টার জানাচ্ছে! বিজয়া দশমীকে শুভেচ্ছা দিবস বা কোলাকুলি দিবস বলা যেতেই পারে। হেপি বিজয়া এখন বেশ চল কথা। তাই বলে এক বঙ্গসন্তান আরেক বাঙালিকে হ্যাপি বেঙ্গলি নিউ ইয়ার্স বলে শুভেচ্ছা জানান তা একেবারেই অসমীচীন। ভাই দিবস জামাই দিবস বেশ সুপরিচিত। মুলো ষষ্ঠী কৌশিকি অমাবস্যা গুরু পূর্ণিমা এসবতো দিবস পালনই। দশহরা তো নদী দিবসের নামান্তর। কিংবা নবান্ন শস্য দিবস। শ্রীপঞ্চমী কি সঙ্গীত দিবস বা বুদ্ধপূর্ণিমা নাস্তিক দিবস বা উপলব্ধি দিবস? নারীবাদীরা মানবেন কিনা জানি না রাখিবন্ধন তো ভগিনী সুরক্ষা দিবস। দীপাবলি বিজয় দিবস বা প্রদীপ দিবস। অরন্ধন দিবসের চল বহুকালের। সেকি গৃহিণী বিশ্রাম দিবস নাকি জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ দিবস। ইদানীং কালে এদেশে দিবস ঘোষণা ও পালন কিছু কম নয়। কুষ্ঠ দিবস, অস্পৃশ্যতা বিরোধিতা দিবস কিংবা সদ্য সদ্য স্বচ্ছতা দিবস, কন্যাশ্রী দিবস এখন সরকারের উদ্যোগে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে।
বিলেতি ঢঙে মা দিবস বাবা দিবস পালনকে আমরা ঠাট্টা ইয়ার্কি করতেই পারি। তবে প্রিয়জনের জন্ম অথবা মৃত্যু দিনে স্মরণ করাতো সংস্কার বা পরম্পরা। এই যে পুজোর আগে মহালয়া সেতো প্রকৃতপক্ষে আমাদের পূর্বপুরুষদের জন্য উৎসর্গিত দিবস। স্মরণ বা কৃতজ্ঞতা দিবস বলা যেতেই পারে।যেমন খুশী সমারোহে যে কোনও দিবস পালন করতে চান করুন কিন্তু খুশিতে ডগমগ হয়ে হেপ্পি মহালয়া বলে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠাবেন না। আমার আশংকা কিছু দিন পরে হয়তো ২৫শে বৈশাখ বা ২২শে শ্রাবণ হ্যাপি রবীন্দ্র দিবস শুভেচ্ছা আদান প্রদান শুরু হয়ে যাবে।
(www.theoffnews.com Mahalaya day)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours