সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর:
[ওড়িশা ভাষার মূল গল্পকার: দেবাশিস সামন্তরায়]
{অনুরোধ পেয়েই স্বল্প সময়ে গল্পটি সংগ্রহ করে দিয়ে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন যশোধরা রায়চৌধুরী}
আচ্ছা, আপনারা কী মনে করেন বলুন তো! মনের খুশী আনন্দ সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া কি এতই সোজা? কাউকে বুকে জাপ্টে ধরলেই কিংবা হেঁ হেঁ মার্কা দেঁতো হাসি হেসে কুশল প্রশ্ন করলেই সেটা হয়ে যায়?
একটা জাঁকালো বিয়ে বাড়িতে গাদা গাদা আত্মীয়-বন্ধু- অতিথিদের আগমন ঘটেছে। চেনা মুখের মালিকদের সঙ্গে সবাইয়ের কত হৃদ্যতা সেটা বোঝাতে কোলাকুলির ঝড় বয়ে যাচ্ছে আর একটা প্রশ্নই চালাচালি হচ্ছে – “কেমন আছেন?” উত্তর পাবার আগেই প্রশ্নকর্তার দিকেই একই প্রশ্ন ধেয়ে আসছে। প্রশ্নটা আপাত নিরীহ কিন্তু উত্তরকর্তার পক্ষে খুবই কঠিন কারণ তলিয়ে ভাবলে সে খুব সমস্যায় পড়ে যায় – আমি কি সত্যিই সুখী?
“তন্দুরিটা যা হয়েছে না! একেবারে লা জবাব! শেষ হওয়ার আগেই আরও নিয়ে এস জলদি”।
কেউ লুকিয়ে লুকিয়ে মিষ্টি পেটে চালান করছে পাছে পরিচিতদের কাছে ধরা পড়ে যায়, কারণ তার ডায়াবেটিস আছে।
নিম্নত্রণকর্তার প্রশংসায় সকলে পঞ্চমুখ - “আরে কি দারুণ আয়োজন! কত রকমের খাবার! আর প্রত্যেকটা কি দারুণ খেতে!”
গৃহকর্তা এইসব কথা তাঁর স্ত্রীর কাছে বড়াই করে শুনিয়েই যাচ্ছেন যাতে তাঁর স্ত্রীর চোখে আনন্দের ক্ষণিক আভাসও ফুটে ওঠে কারণ কর্তা তাঁর সুখের ভারা পূরণ করতে মরীয়া।
গৃহকর্ত্রী করুণ সুরে বলেন – “আমি যদি সব কিছু নিজের চোখে দেখতে পেতাম! কি দুর্ভাগ্য আমার! এই চার দেয়ালের মধ্যে এই চার পাইয়ের ওপর অসহায় হয়ে আটকে আছি”। তাঁর একমাত্র ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ না দিতে পারার জন্য বিলাপ করতে থাকেন - বাতের ব্যাথায় পঙ্গু আর শিরদাঁড়ায় চোটের কারণে অসহ্য ব্যাথায় কাবু।
আচমকা গায়ে একটা জোর ঘা খেয়ে তিনি চমকে উঠলেন। পাশ ফিরে তিনি অবাক হয়ে দেখলেন যে তাঁর স্বামী রাগে ফুটছে আর আগুনের জ্বলন্ত শিখার মত উত্তেজনায় থর থর করে কাঁপছে।
“শালী! বোকার হদ্দ! কোনও ভালো খবরই তোকে খুশী করতে পারে না, না!” – কর্তা গলা ফাটিয়ে কর্কশ চীৎকার করে বলে ওঠে।
কিন্তু তার স্ত্রী টুঁ শব্দটি করে না। ঠোঁট চিপে জোর করে মুখ বন্ধ করে রাখে না হলে তার বর্বর বর আরও খেপে গিয়ে বিশাল হাল্লা করবে আর গেরস্থালীর জিনিসপত্র ছুঁড়ে ছুঁড়ে ভাঙবে।
সে নিজের মনেই ভাবে, “নতুন বৌমার কী ধারণা হবে?”
সে আপাদমস্তক ঢাকা নিয়ে ঘুমের ভান করে শুয়ে রইল, না হ’লে তার শরীরের বেআব্রু জায়গায় চোখ পড়লেই তার স্বামীর মেজাজ আরও তিরিক্ষে হয়ে উঠবে।
কাজের বৌ একমনে মনের আনন্দে কাজ করছিল। আজ তার ছোটবাবুর বৌভাত বলে কথা! এই দিনটার জন্য সে কবে থেকে অপেক্ষা করে আছে। আজ আর তার আনন্দ ধরে না।
তাকে মালকিন কাছে ডেকে ছদ্ম রাগ দেখিয়ে বলে, “আচ্ছা তুমি এত বোকা কেন বলত? এত কষ্ট করে মুখে রক্ত তুলে হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করে তুমি সংসার চালাও আর তুমি বিয়েতে সোনার আংটি দিতে গেলে! কেন? কীসের জন্য? মাস গেলে কত টাকা মাইনে পাও তুমি? তুমি কি আমাদের আত্মীয়? তোমাকে আজকে বৌভাতে নেমন্তন্ন করা হয়েছে কারণ তুমি বহুদিন ধরে এই বাড়িতে কাজ করছ। এই নাও, এটা নিয়ে যাও, স্যাকরাকে ফেরত দিয়ে দেবে”।
কাজের মেয়ে জিভ কেটে বলল, “এ কী বলছেন গিন্নীমা! ছোটবাবুকে আমি নিজের ছেলের মত দেখি। কোন ভুল নেই যে আমরা খুব গরীব আর আপনারা বিশাল বড়লোক। তাও কিন্তু আপনি আমাদের ভোজে নেমন্তন্ন করেছেন। তাতেই কি আমাদের এই সামান্য উপহার আনার অধিকার জন্মায় না? মা, আপনাকে সত্যি বলছি আমি কারোর কাছে ধার করে আংটি কিনিনি – আমার কানের একটা মাকড়ি হারিয়ে গিয়েছিল – অন্যটা কোন কাজে আসত না – তাই এটা দিয়ে ওইটা নিয়েছি। কিছু টাকা বেশী লেগেছে, সেটা আমার বর যে ঠিকাদারের কাছে কাজ করে তার কাছ থেকে আগাম নিয়েছে”।
গিন্নীমা কিন্তু জোর করতেই থাকে – “সব বুঝলাম, কিন্তু তুমি এত দামী উপহার কেন আনবে? তাছাড়া এই ঠুনকো সোনার আংটির চেয়ে তোমার ভালবাসা অনেক মূল্যবান। এর কোন দরকার নেই। লক্ষ্মীটি, এটা ফিরিয়ে নিয়ে যাও”।
এর উত্তরে কাজের মেয়েটি যা বলল গিন্নীমা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।
“গিন্নীমা, আমাদের কাছে টাকা একটা তুচ্ছ ব্যাপার। এটা সত্যি অভাব আমাদের তাড়া করে বেড়ায় কিন্তু আমাদের জাতের বৈশিষ্ট্য হ’ল আত্মমর্যাদা। পেটের দায়ে আমরা ছোটমোট চাকরবাকরের কাজ করি কিন্তু আমাদের আঁতে ঘা দিলে আমরা কাউকে ছেড়ে কথা বলি না। একদিকে ভালবাসা আর সম্মান আর অন্যদিকে ঘেন্না আর অপমানকে আমরা সমান ভাবে ফিরিয়ে দিই। যদি আমাকে আমার উপহার ফিরিয়ে দেন তাহলে আমার কিন্তু অপমান হবে। সেটা যদি করতে চান তাহলে ফিরিয়ে দিন”।
গিন্নীমা স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন। তাঁর ডান হাত, যেটাতে আংটিটা ধরা ছিল, তাঁর শাড়ির সবথেকে নিরাপদ প্রান্ত খুঁজতে লাগল যেখানে এই অমূল্য উপহারটি গচ্ছিত রাখা যায়। ইত্যবসরে তার মন সেই প্রশ্নের উত্তর হাতড়াতে লাগল যেটা তার মনকে কুরে কুরে খাচ্ছিল – “আমি কি সত্যিই সুখী? অন্তত এই হাঘরে কাজের মেয়েটার থেকে?”
(দেবাশিস সামন্তরায় – ওড়িশার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বর্তমান প্রজন্মের প্রতিস্পর্ধী লেখকদের প্রতিনিধিস্বরূপ। একাধিক উপন্যাস – ১। এপাটে সেপাটে, ২। বিন্দুরু ব্রুতু ও গল্পগ্রন্থ প্রণেতা - ১। ভির্নস্বর, ২। পর্ব, ৩। শতমুনহা, ৪। রাহা, ৫। ছাকিসুনা সহ ইংরাজি গল্পগ্রন্থ – Writing for the Dawn।
একাধিক পুরস্কারে ভূষিত – ১। কিশোরী পুরস্কার, ২। টাইমপাস স্বয়মশ্রী, ৩।রাজ্য যুব পুরস্কার, ৪।ফকিরমোহন কথাশিল্পী সম্মান, ৫। কলিঙ্গপ্রভা সারস্বত সম্মান, ৬। কথাকলিকা যুবাপ্রতিভা সম্মান, ৭। কুঞ্জবিহারী উপন্যাস পুরস্কার এবং অন্যান্য।
কর্মক্ষেত্র: দেবাশিস সামন্তরায় বর্তমানে আদিত্য মেডিসায়েন্স-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর)
(www.theoffnews.com Orissa story Debashis Samantaroy)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours