সুদীপ্তা বন্দ্যোপাধ্যায়, লেখিকা, শিলিগুড়ি:

রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাম্প্রতিক প্রকাশিত এক রিপোর্টে  সতর্কীকরণ করা হয়েছে যে, পৃথিবী মুখোমুখি হতে চলছে এক অভূতপূর্ব খাদ্য সংকটের। করোনা মহামারী, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, জলবায়ুর আকস্মিক পরিবর্তন, সর্বোপরি ক্রমবর্ধমান যুদ্ধ পরিস্থিতি এর জন্য দায়ী।

২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বে জনসংখ্যা হবে ৯৭০ কোটি। ভারত পৌঁছবে ১৬৬ কোটিতে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সমানুপাতিক ভাবে বাড়বে খাদ্য সংকট। অদূর ভবিষ্যতে যা ভয়াবহ আকার নেবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব এন্টেনিও গুতেরেস।

একবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এমনই অকল্পনীয় ভয়াবহ খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হতে চলেছে আগামী বিশ্ব। নোবেলজয়ী ইহুদী-জার্মান রসায়নবিদ ফ্রিৎজ হ্যাবারের আবিষ্কার একদা রক্ষা করেছিলেন কোটি-কোটি মানুষের প্রাণ। আজও সেই কল্যাণকর আবিষ্কারের সুফল ভোগ করছেন আপামর পৃথিবীবাসী।

১৮৬৮ সালের ৯ই ডিসেম্বর বর্তমান পোল্যান্ডের রোকলো শহরে এক সম্ভ্রান্ত ইহুদি-জার্মান পরিবারে তাঁর জন্ম। বাবা সিগফ্রিড হ্যাবার ছিলেন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। 

মেধাবী হ্যাবারের ছোট থেকেই ছিল বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ এবং বিজ্ঞান চর্চায় নিত্যনতুন আবিষ্কার।

১৯১৯- ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত জার্মানির যাবতীয় বিজ্ঞান গবেষনার প্রাণকেন্দ্র ছিল বার্লিনে হ্যাবার প্রতিষ্ঠিত ‘উইলহেম কাইসার সাইন্স ইন্সটিটিউট'। যেখানে একসময় কাজ করেছেন, আলবার্ট আইনস্টাইন, অটোহ্যানের মতো বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীরা। 

বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই বিশ্বের অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা দেয় জন সংখ্যাধিক্য এবং এরসঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত খাদ্য সংকট। বিশ্বের দেড় মিলিয়ন জনগনের দৈনন্দিন আহারের যোগান গুরুতর বিষয়। 

হ্যাভারের দেশ জার্মানিতে তখন তিন কোটি মানুষের খাবারের সংস্থান থাকলেও কৃষিফলন ভালো না হলে অভুক্ত থাকতে হবে প্রায় দুই কোটি মানুষকে। 

১৮৪০ সালে জার্মান বিজ্ঞানী ফন লুবিগ বলেছিলেন, উদ্ভিদ- কোষের বৃদ্ধির জন্য নাইট্রোজেন অপরিহার্য। কৃষি ফলনের বৃদ্ধির হার নির্ভর করে নাইট্রোজেন সরবরাহের পর্যাপ্ত মাত্রার ওপর। নাইট্রোজেনের বিকল্প সার সেই সময় ছিল দূর্লভ। চার হাজার ট্রিলিয়ন টন নাইট্রোজেন গ্যাস রয়েছে এবং বায়ুমন্ডলের ৮০% এলাকা নাইট্রোজেনের আওতাধীন। একে পৃথককরণ করে কৃষি জমিতে ব্যবহারের উপযোগী করতে হবে। বায়ু থেকে নাইট্রোজেনকে পৃথক করার প্রধান অন্তরায় এর শক্তিশালী ত্রিযোগী বন্ধন। বায়ুতে ভাসমান নাইট্রোজেনের অণুগুলি পরস্পরের সাথে দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত থাকে। এদের পৃথক করার মতো প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদন  তৎকালীন সময়ে অকল্পনীয় ছিল।

হ্যাবার প্রয়াসী হলেন অসাধ্য সাধনের। বিশালাকার লোহার ট্যাঙ্কে বায়ু এবং হাইড্রোজেন গ্যাস প্রবেশ করিয়ে প্রবল তাপ ও চাপের প্রভাবে উদ্ভাবন হল বায়ু থেকে নাইট্রোজেন নিষ্কাসন পদ্ধতি (নাইট্রোজেন ফিক্সেশন বা হ্যাবার-বশ প্রক্রিয়া)। ১৯০৯ সালে এই আবিষ্কারের ব্যবহারিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। মানব কল্যাণকর এই আবিষ্কার তাঁকে ১৯১৮ সালের নোবেলজয়ী ঘোষিত করে। 

প্রতিবছর ১০০ মিলিয়ন টনের বেশী সার উৎপাদন করা হয় হ্যাবার প্রক্রিয়ায়। ৭ বিলিয়নের অধিক পৃথিবীবাসীর খিদে মিটিয়ে প্রাণ বাচাঁতে সাহায্য করে চলেছে আজও অনলস। বিশ্বের খাদ্য সমস্যা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৭২ সালে এনসাক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাতে হ্যাবারের কৃতিত্বের কথা প্রকাশিত হয়েছে।

কোটি কোটি মানুষের জীবনদায়ী মানুষটি উগ্র জাতীয়তাবাদের কারণে লক্ষাধিক মানুষের জীবননাশের কারণও হলেন। তিনি বলতেন, ”যুদ্ধ বিরতিহীন অবস্থায় একজন বিজ্ঞানী গোটা বিশ্বের জন্য কিন্তু যুদ্ধের সময় পুরোপুরি দেশের জন্য।“

এর বাস্তব প্রয়োগ করেছিলেন ১৯১৫ সালে বেলজিয়ামের ইপ্রার যুদ্ধক্ষেত্রে। হ্যাবার, ক্লোরিন গ্যাসের যা মাস্টার গ্যাস নামে অধিক কুখ্যাত ধ্বংসাত্মক প্রয়োগের জন্য আবিস্কার করেন এবং ১৬৮ টন ক্লোরিন গ্যাস, মিত্রবাহিনীর ওপর প্রয়োগে সহায়তা করেন হ্যাবার স্বয়ং, যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থেকে। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম রাসায়নিক অস্ত্রের প্রয়োগে বীভৎস, যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর মুখোমুখি তাই হতে পেরেছিল মিত্রবাহিনী।

যুদ্ধের ফলাফল জার্মানির অনুকূলে যায়নি। নাৎসি বাহিনীর উত্থান এবং ইহুদি-বিজ্ঞানীদের বিতাড়ন চলল। উদভ্রান্তের মতো ইউরোপের নানা প্রান্তে গেলেন অশান্ত চিত্তে। ১৯৩৪ সালের ২৯ শে জানুয়ারী, সুইজারল্যান্ডের এক অখ্যাত হোটেলে, একাকী, ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষটি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।

ভাগ্যের পরিহাস! তাঁর আবিস্কৃত হাইড্রোজেন-সায়ানাইড যৌগের সামান্য পরিবর্তনে গন্ধহীন করে নাৎসি বাহিনী প্রয়োগ করলো গ্যাস চেম্বারে ইহুদি-নিধনে।

প্রাণ দিয়েছেন যেমন নিয়েছেনও। তবুও বলা যায় আবিষ্কারের কল্যাণমূলক কাজের পাল্লাই ভারী।

(www.theoffnews.com Fritz Haber)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours