সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর:
(মূল লেখিকা: মাকেনা ওঞ্জেরিকা, তাঁর অনুমতিতে এই বঙ্গানুবাদ)
মেরি আমাদের বোন আবার বন্ধুও, কিন্তু আমাদের সেই ঘুনসি পরা বয়েস থেকেই মেরি আমাদের সবার থেকে আলাদা। রোববার রোববার যে ‘গুড সামারিটানরা’ আমাদের খাবার আর জামাকাপড় দিয়ে যায় তারা যদি আমাদের জিগ্যেস করত ভগবানের কাছে আমরা কী চাই – আমাদের কেউ কেউ চাইত ইস্কুল যেতে; কেউ কেউ চাইত ‘মাথারে’ বস্তিতে একলা একটা ঘরে থাকার মত টাকা; যারা আবার জন্মাতে চায় তারা স্বর্গে যেতে চাইত। কিন্তু মেরি শুধু চাইত বড় একটা ফ্যান্টা ব্ল্যাককারান্ট, যেটা প্রতিদিন খেয়েও শেষ হবে না।
ভগবান মেরিকে সব সময় বেশি বেশি ভালবাসত। রাস্তায় রাস্তায় আমরা যখন হাত পেতে ভিক্ষে চাইতাম লোকেরা সবসময় মেরির ওপর বেশি দয়া দেখাত। তাদের চোখে পড়ত তার মুজুং জুংগু (তামাটে ফর্সা) রূপসী মুখ, তার সামনের দাঁতে একটা ফাঁক। তারা ওকে ওর বাবা-মায়ের কথা জিগ্যেস করত। তারা ওকে ১০ টাকা এমনকি কখনোও কখনোও ২০ টাকাও দিত। আর আমাদের মত কেল্টি শাঁকচুন্নিদের জন্য কেবলমাত্র ৫ টাকা।
মেরিকে আমরা সবাই হিংসে করতাম – গরম আলু যেমন গলা দিয়ে নামতে চায় না – আমরা কেউ ওকে সহ্য করতে পারতাম না। ওর প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে আমরা সবাই জিনিস চুরি করতাম। ছোট ছোট জিনিস অবশ্য – ওর রুটি, ভাঙ্গা ব্লেড, ওর রান্নার কৌটো। এতেও আমাদের অনেকের গায়ের ঝাল মিটত না – আমরা মনে প্রাণে চাইতাম ওর ভীষণ একটা কিছু খারাপ হোক, ওর ভীষণ সর্বনাশ হোক।
এরপর একদিন মেরিকে টিভিতে দেখাল। আসলে ঘটনাটা হল, ওয়ানুগু বলে একটা ছেলেকে পুলিশ গুলি করে মারে। এই ওয়ানুগু ছেলেটা আমাদের ভাই বা বন্ধু ছিল না কিন্তু আমরা তখন যেখানে থাকছিলাম সেখানে কয়েকটা ছেলে এল হাতে লাঠি পাথর আর ছোরা নিয়ে। তারা বলল রাস্তার সব ছোঁড়াছুঁড়িদের রাস্তায় রাস্তায় ওয়ানুগুকে নিয়ে হাল্লা করতে হবে। তাদের ভয়ে আমরা মিছিলে গেলাম আর ‘খুনী-খুনী/ আস্তাকুঁড়িরাও মানুষ’ বলে চিৎকার করতে থাকলাম যতক্ষণ না টিভির লোকেরা আমাদের মুখগুলো ক্যামেরা দিয়ে দেখতে এল।
আমরা সবাই টিভিতে নিজেকে দেখাতে চাইছিলাম। জলদি জলদি আমরা জামাকাপড় থেকে ধুলো ঝেড়ে ফেললাম; জোরে জোরে হাসা বন্ধ করলাম, যাতে আমাদের কালো কালো দাঁত দেখা না যায়; নাক থেকে গড়ানো পোঁটা টেনে নিলাম। আমরা সবাই একসঙ্গে ওয়ানুগুর ঘটনাটা বলতে চাইছিলাম – কীভাবে তাকে একে ফর্টি সেভেন দিয়ে গুলি করে মারা হল যখন সে শুধু জেবানজী বাগানে বসে ডেনড্রাইট শুঁকছিল আর লাঞ্চটাইম প্রিচারের বর্ণনা শুনছিল যে স্বর্গ কত সুন্দর। কোন গাড়ির লাইট বা আয়না বা টায়ার চুরি করার কথা ও সেসময় ভাবছিলও না। সবাই আমরা গল্পটা বললাম কিন্তু রাত্তিরে যখন আমরা মহিন্দি দোকানে গেলাম জানলায় বিক্রির জন্য রাখা টিভিতে আমাদের দেখতে, আমরা শুধু মেরিকে দেখতে পেলাম – ও ইংরিশে [ইংরাজি আর স্প্যানিশ মিশ্রিত খিচুড়ি ভাষা] গাইছিল –
মেরি হাদা রিত্রো র্যাাম্প, রিত্রো র্যাদম্প, রিত্রোপ র্যা ম্প...
[মেরি স্নেক রিট্রো র্যারম্পস র্যা ম্প রিট্রো, রিট্রোয়া র্যািম্প]
[মেরি হ্যাড এ লিট্ল ল্যাম্ব - মেরির একটি ভেড়ার ছানা ছিল]
আমরা সবাই চোখ বড় বড় করে মেরির দিকে তাকিয়ে রইলাম কারণ ও রাস্তার আস্তাকুঁড়ে আস্তানা গাড়ার আগে ইস্কুলে গিয়েছিল আর ক্লাস ওয়ান থেকে থ্রী পর্যন্ত পড়েছিল সেটা কেউ জানত না। আমরা ওকে চেপে ধরলাম, “মেরি, আমাদেরকেও একটু ইংরিশে কথা বলে শোনা”।
আমরা ওকে বেশ কয়েকটা চড়থাপ্পড় লাগালাম – কিন্তু আমাদের সকলের মনের মধ্যে ভয় ঢুকে গিয়েছিল মেরিকে উদ্ধার করতে কেউ না কেউ আসছেই। আমাদের সবারির মনে হয়েছিল গত বছর একটা কুকুরকে উদ্ধার করতে লোকেরা কেমন করে হাজির হয়ে গিয়েছিল কারণ কুকুরটা আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া একটা মানুষের বাচ্চাকে খুঁজে পেয়েছিল।
আমাদের মেরিকে খুব হিংসে হতে লাগল। মেরি কক্ষনো কোন কিছু নিয়ে মাথা ঘামায় না। যদিও ও আমাদের বোন আবার বন্ধুও তাহলেও ও কোন কাজের নয়, সব সময় আঠা শুঁকছে আর ভাবছে কোথায় একটা ফ্যান্টা ব্ল্যাককারান্ট হাতাতে পারা যাবে। যদি কেউ মেরিকে উদ্ধার করতে আসে আমরা সবাই বলব যে আমি মেরি। আমরা কেউ কেউ রোজ নাইরোবি নদীতে চান করতে শুরু করলাম যাতে গা থেকে রাস্তার আস্তাকুঁড়ের দুর্গন্ধ আর না ওঠে। কেউ কেউ মেহন্দি দোকানগুলোতে টিভিতে লোকেরা ইংরিশে কীভাবে কথা বলে শুনবার জন্য টহল দিতে শুরু করল। কেউ কেউ লম্বা লম্বা গল্প বলা শুরু করল যে অনেকদিন আগে তারাও কেমন করে বড় বড় বাড়িতে বাস করত।
দিনের পর দিন পেরিয়ে গেল, তারপর বছরের পর বছর। কিন্তু মেরিকে রক্ষা করতে কেউ এলো না। আমাদের মেয়েবেলা কেটে গেল আর দু’পা বেয়ে রক্ত গড়াতে শুরু করল। আমরা বড় হয়ে গেলাম। আর মেরি, সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় রোদে রোদে ঘুরে ফেরার জন্য বাদামী থেকে কালো হয়ে গেল আমাদের মত। তার পায়ের নখে পোকা হল, মাড়িতে দশ জায়গায় ফাঁক রেখে নতুন দাঁত বেরল। আঠা শুঁকতে শুঁকতে সে তার বাবার নাম আর মায়ের নাম ভুলে গেল। দিনকে দিন তার মাথা খারাপ বাড়তে লাগল – জামাকাপড় খুলে ফেলতে লাগল আর মাটি দিয়ে গা পরিষ্কার করতে লাগল যতক্ষণ না আমরা ওকে তাড়া করতাম - ওকে ধরে ফেলতাম - ওর ওপর চেপে বসতাম – ওকে খিমচোতাম – আচ্ছা কষে চড় লাগাতাম – ওর চুল টানতাম – ওর চোখ ফেটে জল বের হলেই তবে থামতাম।
আমরা এখন ধাড়ি মেয়েছেলে। আমরা যখন রাস্তায় লোকের কাছে ভিক্ষে চাই, তারা আমাদের পাকা আমের মত বড় বড় ঝোলা মাইগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। আমাদের লজ্জা লাগে কারণ ওরা জানে আমরা নিকম্মার ধাড়ি।
শেষমেশ আমাদের সবাই, এমনকি মেরিও, রাস্তায় ভিক্ষে চাওয়া বন্ধ করে দিলাম। আমরা যখন রাত্তিরে ব্যাঙ্কের ওয়াচম্যানের কাছে যেতাম মেরিও আমাদের পিছু পিছু যেত।
লোকটা বলল, “মেরি, তোমার জন্য করছি, শুধুমাত্র তোমার বন্ধু বলে”। সে বলল, “মেরি, তুমি আমাকে দশ দাও আর তোমার কাছে দশ রাখ”। সে বলল, “মেরি, তোমাকে খুব ভাল কাস্টমার খুঁজে দেব”। যদিও লোকটা আমাদের বন্ধু ছিল কিন্তু তাকে যখন জিগ্যেস করা হল যে মেরির পেটের বাচ্চাটাকে কীভাবে নষ্ট করা হবে সে আমাদের শয়তান, ডাইনি বলে গাল দিতে দিতে তাড়িয়ে দিল।
পেছন থেকে হেঁকে বলল, “কে তোদের বলল যে আমি পেট খসাতে পারি?”
মেরির জন্য আমাদের সকলের কষ্ট হচ্ছিল। হয়ত কোন খদ্দের কাজ শেষ করার পর মেরি নুনজল দিয়ে জায়গাটা ধুতে ভুলে গিয়েছিল। আমাদের কেউ কেউ বলল তারা তার দিয়ে বাচ্চা খসাতে জানে। কেউ কেউ জানে জেবানজী পার্কের কোন গাছের পাতা দিয়ে কীভাবে করতে হয়। কেউ কেউ ভয়ে কাঁদতে শুরু করল যে তাদের পেটেও বাচ্চা এসে গেছে।
মেরি কিন্তু শুধু আঠা শুঁকতে লাগল আর নিজের মনেই গান করতে লাগল। তখন যে পোড়ো বাড়িটায় আমরা থাকতাম সেটার দুটো দেওয়াল আর ছাদের খানিকটা ভেঙে পড়েছিল, মেরি সারাদিন কোথাও না গিয়ে সিঁড়ির নীচে বসে বসে আমাদের বলতে থাকল কে তার পেটে বাচ্চা ভরে দিয়েছে। প্রথমের লোকটা লাঠি নিয়ে চলত আর তাকে একশো টাকার একটা নতুন নোট দিয়েছিল, তারপরের লোকটা মুজুং জুংগু [সাদা চামড়ার লোক বা ফর্সাটে যে কেউ] – নাকিসুরে ইংরিশ বলত। তারপর সে তার পায়ের নখ থেকে কৃমি টেনে টেনে বার করতে থাকল আর মাথার উকুনগুলো চুলকে চুলকে নখে টিপে মারতে থাকল আর বলল - না, এটা করেছে সেই লোকটা যে তাকে নতুন গাড়িতে চাপিয়ে তার বিশাল বড় বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল আর তার সারা শরীর পরিষ্কার করে সোন্দর গন্ধতেল মাখিয়ে জিগ্যেস করেছিল, দেখছ, তোমাকে কত সুন্দর দেখতে লাগছে। আমরা নিজেদের মধ্যে কথা চালাচালি করলাম, ও কি ওই লোকটাকে খুঁজে বের করার কথা ভাবছে। সে কী ভাবছে লোকটা বিয়ে করবে আর ওই বড় বাড়িটাতে থাকবার জন্য নিয়ে যাবে, পাঁউরুটি আর দুধ খাবে।
আমরা সবাই মুখ দিয়ে হাওয়া টেনে মেরির দিকে লম্বা আওয়াজ করতে থাকলাম কারণ ও ফাঁপা মাথায় চিন্তা করছিল। কিন্তু আমাদের কেউ কেউ মেরিকে অত খুশি খুশি দেখে ওকে ঘুষ দিল – তিনবার চান করা যাবে এমন সাবানের টুকরো; দাঁত ভাঙ্গা চিরুনি; এখনও সবুজ রং থাকা আম। তারা চাইছিল বাচ্চাটা যখন নেমে আসবে মেরি যেন ওটাকে কোলে নিতে বারণ না করে আর ওটার পেটে কুতুকুতু দিয়ে হাসাতে না বারণ করে। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ওকে বাচ্চাটার ভাল ভাল নাম বাতলাতে শুরু করল। আমরা চাইছিলাম যে মেয়ে হোক, কেন না ছেলেরা যদিও ভাল, কারণ ওরা আস্তাকুঁড়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে টিন, কাগজ, বোতল হাসিল করতে পারে আর ওয়েস্টল্যান্ডের একটা জায়গায় গিয়ে বিক্রি করে কিছু মালকড়িও বাগাতে পারে কিন্তু মেয়েরা সোন্দর আর তাদের চুলের বেণী করতে পারবে আর অনেক রঙের জামাকাপড় পরাতে পারবে। আমরা সবাই এরকমই ভাবছিলাম কিন্তু আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছিলাম যে দুর্ভাগ্যের মেঘ মেরির মাথায় খুব শিগগিরই আছড়ে পড়তে চলেছে।
আমরা ওয়াচম্যানের কাছে আবার কাকুতিমিনতি করলাম কিন্তু সে সাফ বলে দিল, “না, না, না। কাস্টমাররা পেটে বাচ্চা সমেত কাউকে চায় না”।
আমরা মেরিকে আমাদের টাকার ভাগ দিতে পারতাম না। আমাদের যতটা সম্ভব ওকে সাহায্য করতাম। ও একটা সুপারমার্কেটের বাইরে দাঁড়াতে শুরু করল আর যেসব লোকেরা তাদের বাচ্চাদের জন্য নাইলন ব্যাগ ভর্তি করে দুধ, পাঁউরুটি, চিনি নিয়ে বেরত তাদের পিছু নিত। তারপর মওকা বুঝে তাদের সামনে গিয়ে হাত পেতে বলত, সাইদিয়া মাসকিনি – “গরীবকে দয়া করুন”। কেউ কেউ মাটিতে থুতু ফেলত কিন্তু ভগবান সবসময় মেরিকে ভালবাসত। গুড সামারিটানরা যখন দেখত মেরি কীরকম ফুটোফাটা গাভীন মায়ের জামা পরে আছে আর পায়ে কোন জুতো নেই, তাদের মনে কষ্ট হত। দুপুরের খাওয়ার আগেই ওর চল্লিশ পঞ্চাশ টাকা হয়ে যেত। কিন্তু ওই সুপারমার্কেটের বাইরে অনেক ভিখিরিও বসে থাকত যারা তাদের নুলো পা আর পোড়া চোখ দেখাত। মেরির ওপর ওদের খুব হিংসে হল। যখন লোকেরা দেখছে না, ওরা উঠে দাঁড়িয়ে তাদের হাঁটার লাঠি নিয়ে মেরিকে তাড়া করত।
ওখান থেকে মেরি গ্লোব সিনেমার কাছে গোলাইয়ে ট্র্যাফিক জ্যামে গাড়িতে আটকে থাকা লোকেদের কাছে হাত পাততে শুরু করল। চোখে জল এনে কান্না কান্না গলায় বলত, “সাইদিয়া মাসকিনি” – মা, গরীবকে দয়া কর। কিন্তু ওদের দয়া হত না। ওরা গাড়ির কাঁচ তুলে দিয়ে কাঁচের ওধার থেকে দেখত, ভাবত যে আস্তাকুঁড়ের ছোঁড়াদের মত ও তাদের নোকিয়া নিয়ে পালাবে। আবারও কখনোও গাড়ি এত জোরে আসত যে ওকে প্রায় চাপাই দিয়ে দিত আর ড্রাইভার গাড়ি থেকে মুখ বার করে চিৎকার করত – “এই ছুঁড়ি, রাস্তা থেকে সর না হলে তোকে চাপা দিয়ে দেব”। আঠা শুঁকতে থাকার জন্য মেরি এইসব লোকের চিৎকার শুনতেই পেত না। কিন্তু ও জানত না ওই জায়গায় ধাড়ি ধাড়ি মাগীরা রাস্তার ধারে বসে থাকে আর লোকদেরকে দেখে দেখে ঠিক করে কার পিছনে ওদের বাচ্ছাগুলোকে ভিখ মাগার জন্য লেলিয়ে দেবে। ওরা যখন দেখল মেরিকে দশ টাকা দেওয়া হল, ওকে ধরে ওরা থাপ্পড় মারতে লাগল কারণ ওটা ছিল ওদের ভিখ মাগার জায়গা আর ওদেরও বাচ্চার মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য টাকার দরকার ছিল।
আমরা বললাম, “মেরি, ওই মাগীগুলোকে ভয় পাসনি”।
আমরা বললাম, “নাইরোবি ওদের বাপের জমিদারি নয়”।
কিন্তু আমরা সকলেই জানতাম মেরি ডগির মত নয় যে ওর জিনিস কাড়তে গেলে ও আঙুল কামড়ে ধরবে। বা যে আস্তাকুঁড়ের ছোঁড়া ওকে রাত্তিরে খুঁজতে আসত তার পায়ের মাঝখানে ও কুংফুর স্টাইলে লাথি কষাতে পারবে। আমরা সবাই মেরির জন্য কষ্ট পেতাম কিন্তু ওকে যথাসাধ্য সাহায্যও করতাম।
মেরি তার বস্তা বিছানায় টানা দুদিন ঘুমিয়ে কাটাল আর ওর খাবার শেষ হয়ে গিয়েছিল। ওর সব জিনিসপত্র একটা নাইলনের ব্যাগের মধ্যে ভরে একটা ফালি কাপড় দিয়ে পিঠের পেছনে বাঁধল যেভাবে মায়েরা বাচ্চা বেঁধে রাখে। সে কোথায় যাচ্ছে কিচ্ছুটি বলল না।
একদিন, দুদিন, তিনদিন আমরা মেরিকে নিয়ে মাথা ঘামাইনি। আমাদের বস্তা বিছানায় ঘুমিয়ে রাত্তিরে আমাদের মুখ পরিষ্কার করে, পাউডার লাগিয়ে রাস্তায় কাস্টমারের জন্য দাঁড়ানো যারা গাড়ি থামিয়ে ক্শ-ক্শ-ক্শ আওয়াজ করবে আমাদের তাড়াতাড়ি আসার জন্য; আমাদের রোজগার গুনেগেঁথে দেখা, আমাদের পাওয়া উপহারগুলো দেখা – প্লাস্টিকের চুড়ি, বিস্কুটের একটা বাস্কো যাতে দু’টো বিস্কুট পড়ে আছে, একটা কাঁচ ফাটা ঘড়ি – সারাক্ষণ আমরা নিজেদের জিনিস নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম – হেলাফেলা সারাবেলা একি খেলা আপনসনে। আমরা ভাবছিলাম আমাদের নখের মধ্যেও চিগো মাছির লার্ভা হয়েছে কিনা – আমরা কেউ কেউ ভাবছিলাম আমাদের জীবন কেমন হত যদি ‘মোলোর দাঙ্গা’য় আমাদের বাপ-মা’রা নিকেশ না হত। [কেনিয়ার মানুষের কাছে সবথেকে ভয় ও আতঙ্কের ব্যাপার হল জাতিগত দাঙ্গা। ১৯৯২ সালে রিফট ভ্যালি’তে মোলোর দাঙ্গা’য় ৫০০০ কেনিয়াবাসী খুন আর ৭৫,০০০ ভিটেমাটি ছাড়া হয়েছিল। কালেঞ্জিন আর কিকুয়ু গোষ্ঠীর মধ্যে জমির মালিকানা নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়েছিল বলে মনে করা হয় -অনুবাদক]। আমরা সবাই আঠা শুঁকতাম আর দিন গুনতাম কবে আমাদের এই আস্তাকুঁড়ের নেড়িকুত্তীর জীবন শেষ হবে।
চারদিন, পাঁচদিন, ছ’দিন – এবার আমাদের মেরির জন্য চিন্তা হতে লাগল। আমরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলাম যদি ওকে রাস্তার ছোঁড়ারা একা পেয়েছে আর মেরি ওর ছুরি দিয়ে ওদেরকে না কেটে ফেলতে পেরেছে? যদি সিটি কাউন্সিল ওকে ধরে লরিতে চাপিয়ে থানায় চালান করেছে? যারা আমাদের মধ্যে কখনও পুলিশ লকআপে থাকেনি, তারা চোখকান বন্ধ করল যখন আমরা লকআপে থাকার গল্প বলতে শুরু করলাম যে কিভাবে আরশোলা আর ইঁদুর আর বড় মানুষদের সঙ্গে একই সেলে রেখেছিল আর একটাই ডাব্বা ছিল যেটাতে সবার সামনে বাথরুম করতে হত। তারা জিগ্যেস করল, “তোরা কী করে থানা থেকে বেরিয়ে এলি?” আমরা আমাদের গপ্পো বললাম। বললাম, “পুলিসেরা কাস্টমারের মত ১০ টাকা দেয় না”।
আর তারপর মেরি ফিরে এল। সে একটা ড্রেস পরেছিল যেটা আমরা আগে কখনও দেখিনি আর তার ওপরে একটা এত বড় সোয়েটার পরেছিল যে তার ফোলা পেট ঢাকা পড়ে গেছে। ও সাবান আর পরিষ্কার জলে গা ধুয়েছে। নজরে পড়ল ওর নাইলনের ব্যাগের জিনিসগুলো পাল্টে গেছে – যাবার সময় যা ছিল তা এখন নেই। রাস্তায় বেঁচে থাকার জন্য যে জিনিসগুলো দরকার – গুড সামারিটানদের দেওয়া খাবার রাখার জন্য প্লাস্টিকের টিয়াপাখি ছাপের রান্নার তেলের পুরনো ডিব্বা, জল আনবার জন্য বোতল, ভুট্টা, বিনস্, কাগজ আর আগুন জ্বালবার জন্য কাঠির গোছা, শরীর খারাপের রক্ত টানার জন্য ন্যাকড়া, নুন আর রান্না করার জন্য টিনের কৌটো। রাস্তায় যা কুড়িয়ে পাওয়া যায় যেমন জুতো আর চপ্পল – কারুর সঙ্গেই কারুর মিল নেই – এক কানের দুল, হাতলভাঙ্গা কাপ, মজার জিনিস লেখা কাগজ – এসব আর মেরির কাছে নেই। অনেকদিন আগেই সে হারিয়েছে যা নিয়ে সে রাস্তায় নেমেছিল – ওর মায়ের রোজারিও [ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের জপের মালা]; যে ছোরাটা দিয়ে তার বাবাকে খুন করা হয়েছিল; যে গানটা ওর ভাই ওর জন্য গেয়েছিল।
আমাদের খালি মন চাইছিল ওর নাইলনের ব্যাগের ভেতরে কী আছে হাঁটকে দেখতে। আমরা খারাপ কিছু করতে চাইনি, শুধু চোখের দেখা। সেওতো আমাদের ঝোলা নেড়ে বহুবার দেখেছে, এখন কিন্তু ও শুধু সিঁড়ির নিচে বসে থাকে, কোথাও নড়ে না, ওর পেটের বাচ্চাটাকে গান শোনায়ঃ “লালা, মটোটো, লালা” [লা লা, ছোট্ট সোনা, লা লা]। আমাদের দলের কেউ কেউ বলল ওর মাথাটা একেবারে গেছে। কেউ বলল ও খুব স্বার্থপর। যেভাবে সে তার নাইলনের পোঁটলাটাকে আঁকড়ে ধরে থাকে আমর নিজেদের মধ্যে বলাবলি করলাম, ও কি ভাবছে আমরা ওর সম্পত্তি ঝেড়ে দিতে চাইছি? আমাদেরও কিন্তু জিনিস ছিল, টাকা ছিল, খাবার ছিল। যখন সে পেট খালি করতে গেল আমরা হুমড়ি খেয়ে ওর পোঁটলা ঘেঁটে দেখলাম আর সবাই চেঁচিয়ে উঠলাম “বাব্বা!”।
মেরি বয়ে বেড়াচ্ছিল তিনটে পাঁউরুটি, চার প্যাকেট দুধ আর দু’ প্যাকেট চিনি, আর ছিল একটা রুমালে বাঁধা মিষ্টি, আর বাঁধাকপি আর ভাত। নাইলনের ব্যাগ থেকে বেরনো গন্ধতে মালুম হল ওটাতে চিকেন আর চিপস্ও ছিল। একদম নীচে ছিল দুটো সাবান, ওর মাথায় লাগানোর প্লাস্টিকের ফুল আর ফ্যান্টা ব্ল্যাককারান্টের তিনটে ফাঁকা বোতল।
মেরি আমাদেরকে দেখে “চোর, চোর” বলে চীৎকার করে উঠল।
ও আমাদের মুখ থেকে পাঁউরুটিগুলো বার করে নিল আর নাইলনের ব্যাগের ভেতর সব কিছু আবার ঢুকিয়ে রাখল। কী ভাবে আমরা ওকে সাহায্য করেছি মনে পড়তেই আমাদের মনে হচ্ছিল ওকে আচ্ছা করে থাপ্পড় কষাই; ওর চুল ধরে টানি আর ওকে কামড়ে ছিঁড়ে দিই। মনে হচ্ছিল ওর সারা গায়ে চিমটি কাটি আর ওর মুখে ধুলো ভরে দিই। কিন্তু ওর পেটে বাচ্চা থাকার জন্য আমাদের কারুর কারুর খারাপ লাগল। আমরা মেরির কাছে ক্ষমা চাইতে গেলাম আর আধখামচা তৈরি সিঁড়ির নীচে ওর সঙ্গে বসে থাকলাম।
আমরা বললাম, “মেরি, আমরা কাউকে বলব না”।
আমরা বললাম, “মেরি, তোর মনে আছে কে তোর সঙ্গে দাঁত মাজার বুরুশ শেয়ার করেছিল?”
কিন্তু মেরি তার গোপন কথা কিছুতেই আমাদের কাছে কবুললো না। রাত্তিরে যখন আমরা ওয়াচম্যানের কাছে দেখা করতে গেলাম, মেরিকে আমাদের আস্তানায় একা ঘুমন্ত অবস্থায় ফেলে গেলাম, একবারের জন্যও মাথায় এল না যে রাস্তার ছেলেরা ওকে একা পেয়ে যাবে। সকালে যখন আমরা ফিরে এলাম, ও ওখানে ছিল না। আর যখন ও ফিরে এল, ওর সঙ্গে আরও জিনিস ছিল। আমরা সবাই বুঝলাম মেরি কোথাও চুরি করছে।
আর তারপর মেরি একদিন ধরা পড়ল। মাসটা ছিল জানুয়ারী আর আকাশের মাঝখানে সূর্যটা গন্গন্ করে জ্বলছে। প্ল্যাস্টিকের ব্যাগগুলো উড়ছিল আর অফিসের মেয়েদের স্কার্টের তলায় ঢুকে যাচ্ছিল। গাড়ীর দালালরা (makangas) যাত্রীদের ডাকছিল মিনিবাস-ট্যাক্সিতে (matatus) উঠিয়ে বাহাওয়া, কাঙ্গেমি আরও অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। লোকেরা মাটাটুসে উঠতে চাইছিল না কারণ ওতে কুড়ি টাকার বদলে চল্লিশ টাকা লাগে। আমরা কেউ কেউ ঘুমোচ্ছিলাম আর মনে হচ্ছিল মরেই যাব; আরও কেউ কেউ আগুন জ্বালাচ্ছিল আমাদের খাবার রান্না করার জন্য; কেউ কেউ লাফদড়ি খেলছিল আর মেয়েবেলার কথা মনে করছিল। কেউ আবার আঠা শুঁকতে শুঁকতে চিপস্ আর চিকেন খাওয়ার খোয়াব দেখছিল।
আমরা মেরিকে ছুটে আসতে শুনলাম। আর তারপর আমাদের আস্তানার চারপাশের টিনের বেড়ার নীচ দিয়ে ও ঢুকল। আমরা সবাই দেখলাম ওর হাতে সেই নাইলনের ব্যাগটা নেই আর তারপরই ওর পেছন পেছন চারজন লোক ঢুকল। ওদের একজন ঢ্যাঙা, একজন বেঁটে, একজনের গায়ে লাল জামা ছিল আর লিডারের হাতে ছিল বড় একটা ঠ্যাঙা। ওরা আমাদেরকে কিচ্ছুটি বলল না। এদিক ওদিক কোথাও না তাকিয়ে ওরা সোজা হাজির হল সিঁড়ির নীচে মেরি যেখানে লুকিয়ে ছিল আর ওর মুখটা চেপে ধরল যাতে ও চীৎকার করতে না পারে। আমরা অনেকে আঠা শুঁকতে শুঁকতে অন্য দিকে দূরে তাকিয়ে রইলাম, কেউ কেউ কানে হাত চাপা দিয়ে আমাদের বস্তা বিছানার তলায় সেঁধিয়ে গেলাম।
এবার আমরা জানতে পারলাম মেরি চুরি করেছিল। রাস্তার চাকুরে মহিলাগুলোর থেকে। অফিসের মহিলাগুলো এমন সুন্দর পোশাক পরে যে ওদের বডি দেখায় যেন ‘৪’। সে ধীরে ধীরে ওদের পিছু ধাওয়া করত, রাস্তার চারপাশে নজর রাখতে রাখতে কোন পুলিশ বা সিটি কাউন্সিলের কাউকে দেখা যাচ্ছে কিনা। চাকুরে মহিলারা জোরে হাঁটে না কারণ ছুঁচলো জুতো পরে আর সব দোকানের জানলায় নিজেদেরকে দেখতে দেখতে যায়। রাস্তা পেরবার সময় ওরা থেমে যায় কারণ ওরা চায় না গাড়ি বা মাটাটুস থেকে নোংরা জল ছিট্কে এসে ওদের গায়ে লাগে। ঠিক এই সময়ে মেরি ছুটে গিয়ে ওদের সামনে গিয়ে হাত পাতত আর বলত – সাইদিয়া মাসকিনি।
চাকুরে মহিলাগুলো যদি কিছু টাকা দিত তাহলে মেরি কিছু করত না কিন্তু মহিলা যদি নোংরা কিছু বলত – ওকে বেশ্যা বলত বা শুধোত যে ও যখন পা ফাঁক করেছিল তখন কেমন লাগছিল, তখন মেরি ওর সোয়েটারের ভেতর থেকে নাইলনের ব্যাগ বার করে আনত। প্রত্যেকদিন সকালে পায়খানা করার পর গু-টা সোয়াটারের নীচে লুকিয়ে নিয়ে আসত। চাপা গলায় ওই রোজগেরে মহিলাকে বলত – টাকা দে নাহলে গায়ে হাগা লাগিয়ে দেব আর গায়ে গুয়ের গন্ধ নিয়ে অফিসে যাবি। আর চাকুরে মেয়েগুলো গায়ের দুর্গন্ধকে সবচেয়ে ভয় করত, ওরা ওকে ১০০ টাকা এমনকি ২০০ টাকাও দিয়ে দিত।
তারপরেই মেরির বুদ্ধির খেল শুরু হত - ও ছুটে পালাত না। অফিসের মহিলা ‘চোর চোর’ বলে চেঁচাবার আগেই সে নিজের মনেই কথা বলতে শুরু করত আর মাটিতে পড়ে যেত আর নিজের মুখে গু-টা মাখাত যতক্ষণ না লোকেরা মনে করে ও একটা পাগলি।
ভগবান মেরিকে ভালবাসত কিন্তু ও জানত না যে ওই জায়গাটা ছিল ধাড়ি ধাড়ি চোর বদমাশদের এলাকা। মেরিকে এত সেয়ানাগিরি করে চুরি করতে দেখে ওদের মনে জ্বলন ধরে গেল। তাদের চারজন আমাদের আস্তানায় হাজির হল মস্ত ঠ্যাঙা দিয়ে ওকে পেটাবার জন্য; ওরা ওকে ওদের বড় বড় জুতো দিয়ে দমাদ্দম লাথি কষাতে লাগল – যেন মটরশুঁটির বস্তা পিটিয়ে সবুজ খোসা ছাড়ানো হচ্ছে। ওর মাথা, ঘাড়, ওর হাতগুলো, ওর পায়ের ফাঁক থেকে রক্ত বেরতে লাগল। ওদের মনে মেরির জন্য কোন দয়া ছিল না।
মেরিকে আমরা সবাই সাহায্য করতে চাইছিলাম। ওর চেপে ধরা মুখ থেকে বেরনো আর্তনাদ আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম। আমরা সবাই ভাবছিলাম ছুটে গিয়ে রাস্তার লোকদের ডাকি, পুলিশকে ডাকি আর সিটি কাউন্সিলকে ডাকি। কিন্তু আমরা সবাই ভাবলাম অত বড় পেট হওয়া মেরিকেই যদি ওই ধাড়ি ধাড়ি বদমাশ চোরগুলো রেয়াৎ না করে তাহলে আমাদের কী হাল করবে।
দিনের পর দিন যেতে লাগল, মেরি মড়ার মত ওর বস্তায় ঘুমোতে লাগল – নড়াচড়াও করছিল না, আমাদের সঙ্গে কথাও বলছিল না। আমরা ওকে জল এনে দিতাম। আমাদের মুখে খাবার পোরার সঙ্গে সঙ্গে ওর মুখেও খাবার পুরে দিতাম, সে ছিল আমাদের বোন আর বন্ধুও। আমরা ওর জামাকাপড় আর সোয়েটার খুলে নিয়ে নাইরোবি নদীতে কাচতাম। ওর শরীরের যেখান যেখান থেকে রক্ত বেরচ্ছিল সেখানে সেখানে কাদা লেপে দিলাম। ওর মরা বাচ্চাটাকে একটা নাইলনের ব্যাগে ভরে অনেক দূরের আস্তাকুঁড়ে ফেলে এলাম। মেরির জন্য আমাদের চোখ ফেটে জল এল। আমাদের কেউ কেউ চাপা গলায় বলল মেরি মরে যাচ্ছে। ওরা বলল আমাদের থাকার জন্য অন্য একটা আস্তানা খোঁজা উচিত – মেরির থেকে অনেক দূরে। আমরা তাদেরকে থাপ্পড় মারলাম, ওদের চুল ধরে টানলাম, ওদের মুখে মাটি ভরে দিলাম।
আমরা বললাম, ‘মেরি, এটাই ভাল হল’।
আমরা বললাম, ‘মেরি, ওয়াচম্যান আবার তোর জন্য খদ্দের খুঁজে দিতে পারবে’।
কিন্তু মেরির কানে কথাগুলো গেল না।
একদিন আমরা সবাই দেখলাম মেরি নিজের মনেই বিড়বিড় করে বকছে, তারপর ওর সব জিনিসপত্র নাইলন ব্যাগে ভরে ওর পিঠে ফেত্তি করে বাঁধছে যেন ওটা ওর মরা বাচ্চাটা। সে আমাদের পেরিয়ে গেল, তারপর আমাদের আস্তানার টিনের বেড়াটাও। একটুক্ষণ সে চোখ বন্ধ করে রইল – চারদিকে কড়া রোদ আগুন ঝরাচ্ছিল – গাড়ির কাঁচের ওপর, রাস্তার লোকের মাথার ওপর, কালো চক্চকে রাস্তার ওপর। ও মাটাটুসগুলো পার হয়ে গেল – যেগুলো হর্ণ বাজাচ্ছিল আর লোকের গায়ে কাদা ছেটাচ্ছিল। সিটি কাউন্সিলের হাত থেকে পালানো হকারগুলোকে পেরিয়ে গেল। ব্যাঙ্কগুলো আর অফিসগুলোর ওয়াচম্যানদের পেরিয়ে গেল। আস্তাকুঁড়ের যে ছোঁড়াগুলো ডাস্টবিনে উঠছিল কাগজ, বোতল আর টিন খোঁজার জন্য, তাদেরকেও পেরিয়ে গেল। রাস্তার হলুদ আর কালো চোখের আলোগুলোও পেরিয়ে গেল। একটা লোকের থেকে তার জুতো, তার পকেটের টাকা পয়সা, তার জামাকাপড় কেড়ে নেওয়া হচ্ছিল ও তাকেও পেরিয়ে গেল। প্রতিটি জায়গায় আমরা ওর পিছু পিছু গিয়ে হাজারবার শুধোলাম সে কোথায় যাচ্ছে।
‘মেরি, কুয়ো ভাদিস, তুই কোথায় চলেছিস?’
‘মেরি, কুয়ো ভাদিস, তুই কোথায় চলেছিস?’
দিনের পর দিন, বছরের পর বছর চলে গেল, আমাদের কেউ কেউ পুলিশ আর সিটি কাউন্সিলের হাতে ধরা পড়ল। আমাদের প্রথমে থানায় তারপর জাজের কাছে নিয়ে গেল। সে চশমার ভেতর দিয়ে দেখতে লাগল আমরা ভাল না মন্দ। সে একটা কাঠের হাতুড়ি দিয়ে টেবিলে পিটতে লাগল আর আমাদের কাউকে কাউকে ল্যাংগাটাতে [ল্যাংগাটা উইমেন ম্যাক্সিমাম সিকিউরিটি প্রিজন, ওটিয়েন্ডে, নাইরোবি অঞ্চল, কেনিয়া। কেনিয়ার সর্ববৃহৎ মেয়েদের জেল, সব ধরণের অপরাধীদের এখানে রাখা হয় – অনুবাদক] পাঠাল ধাড়ি মেয়ে অপরাধীদের সঙ্গে থাকতে আবার কাউকে পাঠাল একটা ইস্কুলে ঘাস কাটতে। আমাদের কেউ কেউ পুলিশের একে ফরটি সেভেন বলে একটা বন্দুকের গুলিতে মারা গেল। আমাদের কারুর কারুর রাস্তার ছোঁড়াদের বউ হবার মন করল। আমাদের কেউ কেউ, বহু বছর পর, যথেষ্ট টাকা করলাম ‘মাথারে’ বস্তিতে একটা বাড়িতে থাকার মত আর আমরা নিজেদের খদ্দের নিজেরাই জোগাড় করে নিতে লাগলাম। আর আমাদের কেউ কেউ এত আঠা শুঁকত যে মাথাগুলো এক্কেবারে গেল, আর তারা জামাকাপড় খুলে নাইরোবির রাস্তায় রাস্তায় লোকদের তাড়া করে বেড়াতে লাগল।
কিন্তু মেরি, নাইরোবি নদী পেরিয়ে কোথায় যে চলে গেল, আমরা কেউ কোনদিন জানতে পারিনি।
(মাকেনা ওঞ্জেরিকা:
কেনিয়ান লেখক মাকেনা ওঞ্জেরিকা-র ছোট গল্প ‘ফান্টা ব্ল্যাককারান্ট’ নাইরোবির বস্তিশিশুদের জীবন নিয়ে একটি হৃদয়বিদারক আখ্যান। ২০১৭তে ‘ওসাফিরি’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত এই গল্পটি ২০১৮র ‘আফ্রিকান সাহিত্যের জন্য কেন পুরস্কার’ জয় করেছে এবং বিচারকরা ওঞ্জেরিকা-র লেখায় “কৌতুক, দুঃখ এবং অন্তরঙ্গতার মিশেল”-র প্রশংসা করেছেন। ‘কেন পুরস্কার’ প্রবর্তকদের থেকে ওঞ্জেরিকা ১০,০০০ পাউন্ড বা ৯ লক্ষ ৩৬ হাজার টাকা পেয়েছেন যার অর্ধেকই তিনি ঐ বস্তিশিশুদের উন্নতির জন্য দান করেছেন যারা তাঁকে এই গল্পটি লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
ন্যু ইয়র্ক য়ুনিভার্সিটি-র ‘ক্রিয়েটিভ রাইটিং’ পাঠক্রমের স্নাতক মাকেনার লেখা ‘ওসাফিরি’ ছাড়াও ‘আর্বান কনফিউশনস্’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। মাকেনা ওঞ্জেরিকা কেনিয়ার নাইরোবিতে থাকেন আর বর্তমানে একটি ফ্যান্টাসি নভেল লেখায় ব্যস্ত।)
(www.theoffnews.com story Fanta Blackcurrant Maneka Onjerika)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours