মল্লিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার ও লেকচারার, আহমেদাবাদ: 

চারিদিকে বড় অন্ধকার ---আলো চাই! জ্ঞানের আলো, মেধার আলো, পরিশুদ্ধ মননের চিন্তনের আলো! এককালে মানে প্রায় সপ্তম শতাব্দীর কিছু আগে প্রচুর মানুষ ছিলেন সূর্যের উপাসক। ভারতবর্ষে ছিল বেশ কিছু সূর্যমন্দির, সাত ঘোড়ায় টানা রথে উপবিষ্ট সূর্যদেব, ঈষৎ রক্তিম গাত্রবর্ণ আর মাথার সোনার মুকুটের ঠিক মাঝখানে ঝকঝকে একখানি হীরক খন্ড। 

উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ভারতে সূর্যমন্দির থাকলেও পশ্চিম বা উত্তর পশ্চিম ভারতে বিশেষতঃ কাথিয়াবাড় অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়, তার একটি কারণ হয়ত, অঞ্চলটির অবস্থান –সরাসরি সূর্যের প্রখর তাপ এসে পড়ে অঞ্চলটিতে। এই কাথিয়াবাড়ের মেহসানা জেলায় রয়েছে এমনই  এক সূর্য মন্দির –মোধেরা সূর্য মন্দির, পুষ্পবতী নদীর পাশে। 

স্কন্দ পুরাণ ও ব্রহ্ম পুরাণ মতে মোধেরা ছিল এক সুপ্রাচীন জনবসতি। রামচন্দ্র রাবণকে হত্যা করায় ব্রহ্মহত্যার পাপ স্খলনের উদ্দেশ্যে এক যজ্ঞ করেন, সাথে তৈরি করেন মোধেরাক –সেই থেকে নাম মোধেরা। আবার অন্য মতে মোধ গোষ্ঠীর ব্রাক্ষণেরা সাহায্য করেছিলেন যজ্ঞে তাই জায়গার নাম মোধেরা তবে পরবর্তী কালে বহু সূর্যমন্দির ছিল ---  বল্লভীর মৈত্রকাদের সময় (শাসনকাল ৪৭৫ থেকে ৭৭৬) এবং তারপর সোলাঙ্কিদের সময় ৯৪০ থেকে ১২৪৪)। ভারতবর্ষ তথা কাথিওয়াবাড় থেকে বারোশ শতাব্দী থেকে আস্তে আস্তে সূর্য উপাসনা বন্ধ হয়, সৌর উপাসকরা মিশে যান স্মার্তদের সঙ্গে।

স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে ভারতীয়রা চিরকালই বড় উদাসীন অথচ মৈত্রকদের শাসনকাল থেকে গুজরাটের নানা জায়গায় গড়ে ওঠে প্রচুর মন্দির পরবর্তী কালে সোলাঙ্কিদের রাজত্ব কালে মন্দিরের স্থাপত্য শৈলীতে আসে নানান বৈচিত্র্য। 

এই মন্দিরে পাওয়া লিপিতে দেবনাগরী হরফে লেখা আছে "বিক্রম সংবত ১০৮৩” যা সাধারণ অব্দের হিসাবে হয় ১০২৬-২৭। ঐতিহাসিকরা এই লিপির ওপর নির্ভর করে মনে করেন সোলাঙ্কি রাজ ভীমদেবের সময় মানে ১০২৪-৬৪ এর মাঝে মন্দির নির্মাণ করেন। গজনী সুলতান মামুদ গুজরাট আক্রমন করেন ১০২৪-২৫ সাধারণ অব্দে।

সোলাঙ্কি রাজ ভীমদেব ২০,০০০ সৈন্য নিয়ে মোধেরায় মামুদকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। লড়াইতে হারলেও স্মৃতি হিসেবে মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন বলে ঐতিহাসিকরা ধারণা করেন। তবে সঠিক তথ্য অজানা।

মোধেরার সূর্য্য মন্দির তিনটি অংশে বিভক্ত ---শুরুতেই সূর্যকুন্ড, এরপর সভাগৃহ তারপর গর্ভগৃহ।

সূর্যকুন্ড বা রামকুন্ড একটি ছোট পুষ্করিণী যার চারিধার ঘিরে অসংখ্য অসম ধাপের সিঁড়ি নেমে যাওয়ায় মনে হয় ঠিক যেন ওল্টানো পিরামিড।  ধাপে ধাপে ছোট বড় মন্দির, কথিত আছে ১০৮ টি মন্দির ছিল তবে এর চার কোণে চারটি বড় মন্দির। একটি গণেশের, একটি শেষ শয্যায় শায়িত বিষ্ণুর মূর্তি আর অন্য দুটির একটিতে নটরাজ রূপী শিব এবং গাধায় উপবিষ্টা ঝাঁটা আর নিমপাতা হাতে গুটি বসন্তের দেবী শীতলা। 

ধারণা করা হয় এই পুষ্করিণীতে নেমে হাত, পা ধুয়ে  ভক্তবৃন্দ সভাগৃহে প্রবেশ করত। সভাগৃহের সামনে পূর্বদিকেই এই সূর্যকুন্ড –দৈর্ঘ্য ১৭৬ ফুট ,পূর্ব পশ্চিম প্রস্থ ১২০ ফুট। 

সভাগৃহটির চারদিক খোলা, ৫২ টি খিলান আছে, অপূর্ব কারুকার্যময়, রামায়ণ, মহাভারতের কাহিনী ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সৌর বছরের ৫২টি সপ্তাহ বোঝাতেই ৫২ টি খিলান, দেয়ালে ১২টি কুলুঙ্গি রয়েছে যাতে সূর্যের ১২টি রূপ তুলে ধরা হয়েছে---১২ মাসে এক সৌর বছর। সভাগৃহ আর গর্ভগৃহের মাঝের ফাঁকা অংশটির ছাদ ঢাকা, সভাগৃহ থেকে অল্প কটি সিঁড়ি ভেঙ্গে নেমে গর্ভগৃহে কয়েকটি সিঁড়ি ভেঙ্গে ঢুকতে হয়, এর প্রবেশদ্বারটিও পূর্বমুখী।  

গর্ভগৃহ 

এটি একটি উল্টানো পদ্মফুলের স্তম্ভ মূলের ওপর অবস্থিত, পদ্মফুল সূর্যোদয়ের সাথে ফোটে আর সূর্যাস্তের সাথে বন্ধ হয়, তাই পদ্মফুল প্রতীক হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। এক অভূতপূর্ব জ্যোতির্বিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে গর্ভগৃহটি বানানো। ২১ শে জুন সূর্য যখন নিরক্ষরেখা থেকে সবচেয়ে দূরে থাকে সেদিন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত মন্দিরের রথের ওপর রাখা সূর্যদেবের মূর্তির ওপর ফলিত হবে।

মন্দিরের গর্ভগৃহে ছিল খাঁটি সোনার তৈরি সাত ঘোড়ায় টানা রথ (সাত দিনে এক সপ্তাহ)। সারথি অরুণ চতুর্থ ঘোড়ায় উপবিষ্ট, রথটি ১৫ ফুট গভীর একটি কূপ বা গহ্বরের ওপর প্রতিষ্ঠিত। কূপটি ছিল কানায় কানায় স্বর্ণ মুদ্রায় পূর্ণ ---যা সোলাঙ্কি রাজরা তাঁদের পূজ্য দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করেছেন। মাহমুদ গজনী স্বর্ণ মুদ্রাসহ সোনার সম্পূর্ণ ভাস্কর্যটি লুঠ করেন। বর্তমানে কূপটি লোহার পাত দিয়ে আটকানো।

মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে আছে সূর্যের বারোটি  ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গি, আট জন দ্বারপাল, বিশ্বকর্মার মূর্তি (যিনি শ্রীকৃষ্ণের স্বর্ণ দ্বারকা বানিয়ে ছিলেন), সিদ্ধিদাতা গণেশ, জ্ঞানের দেবী সরস্বতী মূর্তি ---আছে সমুদ্রমন্থনের দৃশ্য। মন্দিরের ভিতরের স্তম্ভের গায়ে নানান যৌন আবেদন মূলক দৃশ্যের মোটিফ দেখা যায়। সেযুগে যৌনতা নিন্দনীয় ছিল না, বরং ছিল সন্তান উৎপাদনের মাধ্যম এবং স্বাভাবিক প্রাকৃতিক শারীর বৃত্তীয় ঘটনা । 

বর্তমানে মোধেরা সূর্যমন্দিরটি সংস্কার করে অন্যতম টুরিস্ট স্পট হিসেবে রাখা হয়েছে, এখানে প্রতিবছর জানুয়ারী মাসের তৃতীয় সপ্তাহে চলে মোধেরা নৃত্যৎসব, সে যুগে মোধেরার শিল্প, সাহিত্য কলা, জ্ঞান, বিজ্ঞানের উৎকর্ষতাকে স্মরণে রেখে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। মন্দিরের পিছনের তিন দিন ব্যাপী উত্তরায়ণ উৎসবের পরে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের নামকরা শিল্পীরা এখানে কলা প্রদর্শন করে দর্শকদের মুগ্ধ করেন। 

মোধেরার সূর্যমন্দিরটির ঢোকার মুখেই আছে আর্কিওলজিকাল মিউজিয়াম , সেখানে বেশ কিছু দশম, একাদশ শতাব্দীর মূর্তি রাখা আছে। মন্দিরটি সোমবার বন্ধ থাকে।

(www.theoffnews.com Modhera Sun temple)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours