সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর:
(ল্যাটিন আমেরিকান লোককথা)
[‘প্রথম মন্টেজুমার প্রস্তর’ আসলে কলোম্বিয়া যুগের পূর্বের একটি একশিলা পাথর যেটি প্রথম মন্টেজুমা বা প্রথম মটিকোজুমা (১৪৪০-১৪৬৯) এবং তেনক্তাইতলাঁর পঞ্চম তালতোয়ানির (মানে শাসক) আমলে খোদিত হয়েছিল। এই একশিলা পাথরটির ব্যাস ১২ ফুট এবং এটি লম্বায় ৩৯ ইঞ্চি। এটি ‘মন্টেজুমা ইলুইকামিনা’, ‘মন্টেজুমা ইলুইকামিনার কুয়াজিকলি’, ‘আর্চবিশপস্ স্টোন’, ‘দ্য এক্স-আর্যবিস্প্যাদো স্টোন ‘ এবং ‘দ্য সেঞ্চেচ নাভা মনোলিথ’ নামেও পরিচিত। ঐতিহাসিক বিবরণীগুলিতে এটিকে স্রেফ ‘তেমলক্যাত্ল’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে যেটির আক্ষরিক মানে “গোল পাথর”।]
বিখ্যাত হয়ে ওঠার জন্য মন্টেজুমা সবসময় বিরাট কিছু তৈরি করতে চাইত। এটা অবশ্য মিথ্যে নয় যে তার আগের সম্রাটরাও অসাধারণ সুন্দর সব জিনিস বানিয়েছেন কিন্তু মন্টেজুমার কাছে সেসব বিখ্যাত জিনিসের কোন মূল্য নেই। সে খালি বলত, “মেক্সিকোর পক্ষে এগুলো যথেষ্ট জমকালো নয়” আর দিন যত যেতে লাগল বিশাল যে পাথরটার ওপর হুইটজিলোপোচলির উদ্দেশ্যে বন্দীদের বলি দেওয়া হত - সেটা নিয়েও তার মনে ধীরে ধীরে অসন্তুোষ দেখা দিতে লাগল। অবশেষে একদিন সে বলেই ফেলল, “আমার একটা নতুন পাথর চাই সেটা যেন আরও একহাত বেশি চওড়া হয় আর হাত দুয়েক বেশি লম্বা বেশি লম্বা হয়”। ফলে পাথর কাটা মিস্ত্রীদের কাছে আদেশ গেল যে গ্রামের দিকে একটা খুব বড় পাথর খুঁজে বের করতে হবে যেটাকে আগেরটা থেকে আরও একহাত বেশি চওড়া আর হাত দুয়েক বেশি উঁচু করে কাটা যাবে। যখন অ্যাকোলকো নামের একটা জায়গায় সঠিক পাথরের সন্ধান পাওয়া গেল তখন সেটাকে টানবার আর টেনে তোলবার লোকদের ছ’টা শহর থেকে দড়িদড়া আর লিভার সঙ্গে নিয়ে চলে আসতে হুকুম দেওয়া হল। তারা সেখানে এসে লিভার ব্যবহার করে পাহাড় থেকে পাথরটাকে আলগা করে একটা সমতল জায়গায় টেনে নিয়ে এল সেটার ওপর খোদাই করার জন্য। যেই ওটা সঠিক জায়গায় বসে গেল অমনি তিরিশ জন পাথর কাটিয়ে মিস্ত্রী তাদের চকমকি পাথরের বাটালি দিয়ে খোদাইয়ের কাজ শুরু করে দিল – আগের যে কোনও গোল পাথরের থেকে বড় করে বানাতে শুধু নয় আরও অদ্ভুত আরও সুন্দর করার জন্য। যতদিন ধরে তারা কাজ করল ততদিন তারা মন্টেজুমার পাঠানো আর অ্যাকোলকোর লোকেদের পরিবেশিত দুষ্প্রাপ্যতম সুখাদ্য খেতে থাকল।
পাথরটা যখন মেক্সিকো নিয়ে যাওয়ার মত তৈরি হয়ে গেল, খোদাইকাররা সম্রাটকে খবর পাঠাল, সঙ্গে সঙ্গে সম্রাটও মন্দিরের পুরোহিতদের ধূপধুনো আর তিতির পাখি নিয়ে আসতে বললেন। পাথরটার কাছে পৌঁছে পুরোহিতরা সেটাকে কাগজের মালা দিয়ে সাজালো, ধূপধুনো দিয়ে আরতি করল আর গলানো রবার ছিটিয়ে দিল। তারপর তারা তিতিরগুলোর ঘাড় মটকে সেগুলোর রক্ত পাথরটার ওপর ছিটিয়ে দিল। ওখানে বাজনার লোকেরাও হাজির ছিল – শাঁখ আর ঢাক নিয়ে। ভাঁড়েরাও এসেছিল – যাতে রঙ্গব্যঙ্গ করে রাস্তায় যাওয়ার সময় পাথরটাকে খুশী রাখা যায়।
কিন্তু সব আয়োজন শেষ করে তারা যখন পাথরটাকে নিয়ে তাদের যাত্রা শুরু করতে গেল তখন আর সেটা কিছুতেই নড়ে না। ওদের মনে হ’ল ওটার যেন মাটিতে শিকড় গজিয়ে গেছে আর দড়িদড়াগুলো সরু সুতোর মত পটাপট ছিঁড়ে গেল। এবার আরও দুটো শহরে আদেশ পাঠানো হ’ল আরও টানবার মজদুর পাঠাবার জন্য কিন্তু তারা যখন সেখানে এসে নতুন দড়িদড়া দিয়ে বেঁধেছেঁদে হেঁইয়ো হেঁইয়ো করে টানতে লাগল, পাথরটা আচমকা কথা বলে উঠল – “যতই কর, লাভ হবে না কিছু”।
লোকেদের চিৎকার থেমে গেল। পাথরটা বলল -
“কেন তোমরা আমাকে নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া করছো? আমি কোথাও যাব না। তোমরা আমাকে যতই টানাটানি করো আর যেখানেই নিয়ে যেতে চাও কিছুতেই সেখানে নিয়ে যেতে পারবে না”।
লোকেরা নিঃশব্দে কাজ করতে লাগল। পাথরটা বলল – “তাহলে টানতে থাক। আমি তোমাদের সঙ্গে পরে কথা বলব”। এই বলেই সে পিছলে পিছলে এগিয়ে যেতে লাগল আর খুব সহজেই ট্ল্যাপিডজ্যাহুয়ান পর্যন্ত চলে এল। সেখানে পাথর-টানিয়েরা ঠিক করল যে ওই দিনের মত কাজ সারা, এবার তারা বিশ্রাম নেবে। আর দু’জন খোদাইকারী এগিয়ে গেল মন্টেজুমাকে সতর্ক করতে যে বিশাল পাথর কথা বলতে শুরু করেছে।
সম্রাটকে বার্তা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বললেন – “তোমরা কি নেশা করেছ? এতদূর উজিয়ে এসে আমাকে মিথ্যে খবর দেওয়ার মানে কী?” তারপরে তিনি তার সেনাপতিকে দিয়ে ওই দু’জন বার্তাবাহককে আটক করে রাখালেন। কিন্তু তিনি ছ’জন সামন্ত রাজাকেও পাঠালেন আসল ঘটনাটা জানার জন্য। রাজারা যখন স্বকর্ণে পাথরটাকে বলতে শুনল – “যত পারো চেষ্টা করে যাও, আমাকে কিন্তু নড়াতে পারবে না” – তারা সোজা মেক্সিকো ফিরে গিয়ে মন্টেজুমাকে সব কথা জানাল আর ফলে বন্দী দু’জনকে মুক্তি দেওয়া হ’ল।
পরের দিন সকালে পাথরটি আবার মুখ খুলল –
“তোমরা কি কিছুতেই বুঝবে না? কেন আমাকে টানাটানি করছ? মেক্সিকোতে আমাকে নিয়ে যেতে পারবে না। মন্টেজুমাকে গিয়ে বল যে এসব করে কিছু হবে না, সময়টা ভালো নয় কারণ তার দিন ঘনিয়ে এসেছে। সে আমাদের আকাশ আর পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা ভগবানের থেকেও বড় হওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু তোমরা তো নিরুপায়, তোমাদের যদি আমাকে টানতেই হয়, টানতে থাক। বেশ, চলো তাহলে, যাওয়া যাক” - এই কথা বলে সে পিছলে পিছলে এগুতে থাকল যতক্ষণ না ইজটাপালাপান পৌঁছল।
আবার সে নিশ্চল হয়ে গেল, আর শ্রমিকরা আবার বার্তাবাহকদের মন্টেজুমার কাছে পাঠাল পাথরটা কী বলেছে জানানোর জন্য। আগের মতই সম্রাট রাগে আগুন তেলে বেগুন হয়ে গেলেন কিন্তু এবারে সঙ্গোপনে তার মনের ভেতর ভয় ঢুকে গেল। যদিও সত্যি কথা জানানোর জন্য তিনি সংবাদবাহকদের কোনও কৃতিত্ব দিলেন না কিন্তু তাদের আর কয়েদও করালেন না, বরং তাদেরকে ফিরে গিয়ে তাঁর আদেশ পালন করতে বললেন।
পরের দিন সকালে টানিয়েরা যেই দড়ি ধরে মেরেছে টান, পাথরটার গড়ান আবার সহজেই শুরু হয়ে গেল আর মেক্সিকোর জাঙ্গাল (বাঁধ) পর্যন্ত পিছলে পিছলে চলে গেল। মন্টেজুমা যখনই খবর পেলেন যে পাথরটা নদীর অপর পাড়ে পৌঁছে গেছে, সঙ্গে সঙ্গে পুরোহিতদের ফুল আর ধূপধুনো দিয়ে পাথরটাকে বরণ করতে পাঠালেন আর যদি সেটা এখনও রেগে আছে তাহলে রক্ত উৎসর্গ করে তাকে খুশী করতে বললেন।
বিরাট পাথর আবার গড়াতে শুরু করল। কিন্তু হ্রদের মাঝখানে এসে সে দাঁড়িয়ে গেল আর বলল – “এই পর্যন্ত, আর নয়”। সেতুটা যদিও সাত হাত চওড়া সিডার গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি ছিল, পাথরটা সেগুলো ভেদ করে বজ্রপাতের মত আওয়াজ করে জলের মধ্যে তলিয়ে গেল। আর যত লোক দড়িদড়া ধরে ছিল সকলেরই পাথরটার টানে সলিল সমাধি হল আর আরও অনেক লোক আহত হলো।
এই দুঃসংবাদটা যখন মন্টেজুমাকে পৌঁছে দেওয়া হলো তিনি নিজেই সেতুটার ওপরে উঠে এলেন পাথরটাকে খুঁজে দেখতে। এরপরেও হাল না ছেড়ে ডুবুরীদের আদেশ দিলেন যে হ্রদের নীচে পাথরটা কোথায় রয়েছে সেটা হদিশ করতে যাতে সেখান থেকে টেনে তাকে ডাঙ্গায় তোলা যায়। কিন্তু তারা না দেখা পেল পাথরটাকে, না দেখতে পেল মৃত লোকগুলোর দেহাবশেষ। ডুবুরীদেরকে দ্বিতীয় বার জলে নামানো হলো আর তারা ফিরে এসে বলল, “মহারাজ, আমরা জলের নীচে একটা সরু দাগ দেখতে পেয়েছি যেটা অ্যাকোলকোর দিকে চলে গেছে”।
“খুব ভালো” - এই বলে মন্টেজুমা আর কোনও প্রশ্ন না করে তাঁর পাথর কাটিয়েদের অ্যাকোলকোতে পাঠালেন ওখানে কী আছে দেখার জন্য। তারা এসে যে খবরটা দিল সেটা সম্রাট আগে থেকেই জানতেন। দড়িদড়া বাঁধা আর ধূপধুনো আর রক্ত ছিটোনো অবস্থায় পাথরটা পাহাড়ের সেই জায়গায় পৌঁছে গেছে সেখানে তাকে প্রথমে পাওয়া গিয়েছিল।
তখন মন্টেজুমা তাঁর সামন্ত রাজাদের উদ্দেশ্যে বললেন – “ভাইসব, আমি এখন বুঝতে পারছি যে আমাদের জীবনে প্রচুর দুঃখ কষ্ট আসছে আর আমাদের দিন ফুরিয়ে আসছে। আর আমার ক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করাই শ্রেয় হবে যেমনটা আমার পূর্বপুরুষরা করেছিলেন। সৃষ্টিকর্তা যেমন ভাল বোঝেন তেমনই করুন”।
(www.theoffnews Montezuma)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours