রূদ্রাণী মিশ্র, লেখিকা ও কবি, কলকাতা:
সকালে রোদ ঝলমলে আকাশ দেখা গেলেও কোনও কোনও দিন কালো মেঘ মুখভার করে ঢেকে রাখে। এখনকার সময়টায় মনে হয়, ওইরকম কালো মেঘে ঢাকা এক মুখভার করা সকাল। জনজীবনে প্রত্যেকেই যেন নিজের পরিবারের সদস্য বিয়োগের ব্যথা অনুভব করছেন। যারা গতানুগতিক চিন্তা করেন না, তারা বলবেন এটা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের একটা দিক। কেউ উল্টোদিক থেকে বলতেই পারে, আগে কী পিতৃতন্ত্র ছিল না? না, নাগাল্যান্ডের মত কয়েকটি রাজ্য ছাড়া পৃথিবীর সর্বত্রই, সবসময় পিতৃতান্ত্রিকতা রাজত্ব করছে। কিন্তু এটাও ঠিক, আগেকার সময়ে নানা কুপ্রথা বা কুসংস্কার থাকলেও এই মতবাদের কু দিকটা এত প্রবলভাবে প্রদর্শিত হয়নি। সেটা বোধহয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া সত্তর দশকের নারীদের ছবি দেখলেই বোঝা যায়। তখন তাঁরা বিদ্যাচর্চা থেকে শুরু করে, পোষাক পরিধানেও অনেক স্বাধীন ছিল। এখনকার মত এতটা সমালোচিত হতে হত না।
এই পিতৃতান্ত্রিকতার অঙ্কুশ যত বড় ও ধারাল হবে, তত সমাজে নারীদের নিগ্ৰহের লক্ষ্য বানানো হবে। এক্ষেত্রে শরৎচন্দ্রের নারীর মূল্য পড়লে এখনও মনে হয়, লেখক সময়ের থেকে কতটা এগিয়ে ছিলেন। একজন পুরুষ হয়েও তিনি কত গভীরভাবে নারীদের অপমান, লাঞ্ছনা, ব্যথা উপলব্ধি করেছেন। আর সেই কথাগুলো যে আজও জ্বলন্ত বাস্তব, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আজও নারী অবহেলার ও ভোগ্য বস্তু রূপেই পরিগণিত হয়ে আসছে। সে যে জায়গাকে নিরাপদ মনে করে। তাও তার কাছে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, যে কোনও মুহূর্তে। তারপরেও তার কাছে কৈফিয়ত তলব করা হয়, সে টানা খেটে ওখানে বিশ্রাম নিতে গেল কেন? বা, একা থাকার সাহস করল কেন? এই পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয়, নারী এখনও মানুষ হতে পারল না। মাণ্টোর ওই গল্পটা তো নিশ্চয়ই অনেকে পড়েছেন, যেখানে বারাঙ্গনা মেয়েটি কয়েক রাত না ঘুমিয়ে অমানুষের মত খেটে গেছে। শেষে লেখক দেখতে পান সে ইট দিয়ে থেতলে দালালটিকে মেরে পাশে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে।
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, নয় অগাস্টের সেই কুখ্যাত ঘটনার কথাই বলতে চাইছি। এর মধ্যেই আমরা কেন সারা বিশ্ব জেনে গেছে, একজন গরীব বাপ মায়ের একমাত্র কন্যা সন্তানটি, কতটা নৃশংশভাবে পঞ্চত্ব লাভ করেছে। যার আগামীতে অনেকটাই পথ চলা বাকি ছিল। খবর ও অন্যান্য তথ্যসূত্র থেকে যা জানা যাচ্ছে, সেই হাসপাতালে অপরাধ চক্রের জন্য এর আগেও এরকম ছয়টা ‘আত্মহত্যার’ ঘটনা ঘটেছে। এখানেও অপরাধীরা শুধুমাত্র মেয়েটিকে হত্যা করেই ক্ষান্ত দিতে পারত। কিন্তু তারা সে পথে না হেঁটে মেয়েটিকে নির্মমভাবে অত্যাচার করে ও ধর্ষণ করে। তারপর খুন করে। এই চিত্র আমাদের কাছে মোটামুটি স্পষ্ট। এখানে তাই প্রশ্ন এসেই যাচ্ছে মেয়েটিকে ধর্ষণ করা হল কেন? কারণ একটাই, তার লিঙ্গ নারী। আর নারী যুগ যুগ ধরে তার ইজ্জতের জন্য প্রাণ ত্যাগও করেছে। অপরদিকে পুরুষটি দোষী হয়েও বুকের ছাতি ফুলিয়ে বেরিয়েছে।
এইসব ঘটনার পেছনে দেখা যায়, সর্বতোভাবে পিতৃতন্ত্র দায়ী থাকে। শুধু এত বড় ঘটনা নয়, অনেক স্ত্রীকেও তাঁর পুরুষ সঙ্গীটি ম্যারিটাল রেপের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়ে থাকেন। এটাই পৌরুষত্ব জাহিরের একমাত্র পথ। এখানেও কিন্তু সেই পৌরুষত্বের নির্মম নির্লজ্জতার প্রকাশ দেখা যায়। ঘটনাটির পরিপ্রেক্ষিত হুমায়ুন আজাদের সেই বিখ্যাত বাণীটি উল্লেখ করতে ইচ্ছে করছে। যেখানে তিনি বলেছিলেন, পিতৃতন্ত্রের বাহক পুরুষ থেকে আরও ভয়ঙ্কর এই মতবাদ বিশ্বাসী নারীরা। তবে এর সঙ্গে একথাও সত্যি, নারী কখনও নারীর শত্রু নয়। তাহলে তো বিভূতিভূষণের ডাইনি গল্পটির সুরে বলতে হয়, পুরুষও পুরুষের শত্রু। এভাবে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার রাজ্য নায়ক কিন্তু নারী হলেও, হিসেবে সেই গনিতজ্ঞ কে সি নাগের নাতনি হওয়ার ক্ষমতা রাখেন। তিনি তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ যোগ বিয়োগ গুন ভাগ করে ফেলছেন। একমাত্র সন্তানহীনা বাবা, মায়ের কথা আগের মত ভাবতে পারছেন না। কারণ গঙ্গা দিয়ে সময়ের সঙ্গে অনেক জল বাহিত হয়েছে। তিনি এখন আর বিরোধী পক্ষ নন। তাই আবেগের তল্পিতল্পা টালি নালায় ফেলতে দ্বিধা করেননি। এখন সেই আবেগী সমাজসেবিকা থেকে স্বৈরাচরী হয়ে উঠতে বেশি সময় নষ্ট করেননি। তিনি নিজেই এখন সেই পিতৃতন্ত্রের ধারক, যা অতীব বিশ্বের কাছে লজ্জার বিষয়।
(www.theoffnews.com rape Kolkata)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours