রণজিৎ গুহ, লেখক ও সমাজকর্মী, দুর্গাপুর:

আজ ভাদ্র সংক্রান্তি। শ্রমশক্তির প্রতিভু দেবতা  বিশ্বকর্মা পুজো। বলা ভাল মিস্ত্রি দিবস। 

এক প্রাক্তন বিজলি মিস্ত্রির তরফ থেকে সবধরনের সব মিস্ত্রিদের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই। কলকব্জা যন্ত্রপাতি হাত হাতিয়ার সচল রাখুন। নিজের ওপর ভরসা রাখুন। আপনিই বিশ্বকর্মা। জগৎ স্রষ্টা। মিস্ত্রিদের নেতৃত্বেই এই গ্রহ সুন্দরতর হয়ে উঠবে। বাবুমশাইদের এড়িয়ে চলুন।

মহাকাব্যর যুগ থেকেই বিশ্বকর্মাকে স্থাপত্যবিদ্যার ও অস্ত্রনির্মাণ এর দেবতা হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে। পুরাণগাথা অনুযায়ী বিশ্বকর্মা কৃষ্ণের রাজধানী পবিত্র দ্বারকা শহরটি নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়াও তিনি রামায়ণে বর্ণিত লঙ্কা নগরী, অলকা পুরী, পাণ্ডবদের মায়া সভা, রামায়ণে উল্লিখিত  পুষ্পক রথ, দেবতাদের বিভিন্ন গমনাগমনের জন্য বিভিন্ন বাহন, দেবপুরী এবং বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র, শিবের ত্রিশূল, কুবেরের অস্ত্র, ইন্দ্রের বজ্র, কার্তিকের শক্তি সহ নানান দেবতাদের জন্য বহু কল্পিত অস্ত্রের স্রষ্টা।বৈদিক যুগে বিশ্বকর্মা স্থাপত্যবিদ্যা অস্ত্রনির্মাণ এবং দারু বা কাষ্ঠ শিল্পীর দেবতা হিসাবে অর্চিত হতেন।এমনকি কোনও কোনও পুরাণকার ব্রহ্মাণ্ড স্রষ্টা বলেও উল্লেখ করেছেন। বোঝাই যায় যে একজন ব্যক্তি বিশ্বকর্মা এত সব নির্মানে যুক্ত ছিলেন না। বিশ্বকর্মা প্রকৃতপক্ষে একটা পেশাগত পরিচয়। 

অনেক পরবর্তিকালে বিশ্বকর্মা ক্রমশ বৈদিক আভিজাত্য হারিয়ে লৌকিক দেবতা হয়ে ওঠেন। পুরীর বিখ্যাত জগন্নাথ দেবের দারুমূর্তির শিল্পী হিসাবে সুখ্যাতির জোরেই প্রধানত কাঠের মিস্ত্রী বা সুত্রধরদের উপাস্য হয়ে ওঠেন। ক্রমে কর্মকার কুম্ভকার স্বর্ণকার ইত্যাদি সবধরণের মিস্ত্রিদের মধ্যেই প্রভাব প্রতিপত্তি ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি মুদি ব্যবসাদাররাও বিশ্বকর্মাকে নিজেদের দেবতা মেনে নেন। বৈদিক যুগে বিশ্বকর্মা কল্পনায় দেবতাকে চার হাত ভাবলেও হাতে কি ধারণ করতেন তা স্পষ্ট জানা যায় না। বিশ্বকর্মার ধ্যান বা প্রণাম মন্ত্রে তা অনুল্লেখিত।

'দেবশিল্পি মহাভাগ দেবানাং কার্য্যসাধক ।

বিশ্বকর্মন্নমস্তুভ্যং সর্বাভীষ্টপ্রদয়ক।।'

লৌকিক চেহারায় বিশ্বকর্মার হাতে হাতুড়ি বাটালি দাড়িপাল্লা শোভা পায়।

এই সময়ে প্রযুক্তি কল্যানে বিপুলায়তন কলকারখানার শ্রমিক কর্মীরা অবশ্য হাতের কাজ জানা মিস্ত্রীদের সমগোত্রীয় মনে করেন না। কিন্তু আরাধ্য হিসাবে মিস্ত্রির দেবতা বিশ্বকর্মাকে মেনে নিয়েছেন। ইদানীং শুধু কায়িক শ্রমিকরা নয় মেধা শ্রমিকরাও সাড়ম্বরে বিশ্বকর্মা পুজোয় আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠেন। ভাদ্র সংক্রান্তিতে বিশ্বকর্মা আরাধনা শ্রমশক্তির স্বীকৃতি ও সম্মাননা হিসাবেও দেখা যেতে পারে। একটি সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন কয়েকবছর এই দৃষ্টিভঙ্গীতেই সরকারে কাছে বিশ্বকর্মা পুজোর দিনটি শ্রমিক দিবস হিসাবে ঘোষণার দাবী জানিয়েছিল। বিজেপি সরকারে আসার পর অবশ্য আর তা নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য  নেই। আন্তর্জাতিক ভাবনায় বিশ্ব শ্রমিক দিবসে আন্তরিক অংশীদারত্ব স্বীকার করেও নিজস্ব দেশজ সংস্কৃতির অঙ্গ হিসাবে বিশ্বকর্মা পুজোর দিনটি খেটে খাওয়া মানুষজনের নিজস্ব উৎসবের দিন।

(www.theoffnews.com - Biswakarma)



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours