সুদীপ্তা বন্দ্যোপাধ্যায়, লেখিকা, শিলিগুড়ি:
চমকে উঠেছিলাম দুঃসংবাদটা শুনে। সন্তানসম মেধাবী ছাত্রী মাত্র কুড়িতে পা রাখা মিমি আত্মহত্যা করেছে গভীর অবসাদে।
ওর ইদানিং মনে হচ্ছিল, পড়াশোনায় যথেষ্ট মনসংযোগ করতে পারছে না। ফলস্বরূপ খারাপ রেজাল্টের আশঙ্কায় সুন্দর পৃথিবীকে গুডবাই বলে অবলীলায় চলে গেল, না ফেরার দেশে। ভাবলো না একমাত্র সন্তানকে ছেড়ে বাবা-মা কেমন করে থাকবে?
আপাত নিরীহ ‘অবসাদ' বিশেষ্যপদীয় শব্দটির আভিধানিক অর্থ ক্লান্তি, শ্রান্তি, উৎসাহহীনতা, বিষন্নভাব।
‘স্বাস্থ্যের' সংজ্ঞা কেবল শারীরিক-সুস্থতা নয়, মানসিক-সুস্থতা সমান গুরুত্বপূর্ণ। দেহ-মনের মধ্যে সমন্বয় রক্ষাকারী মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে দৈনন্দিন জীবনে। পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ভাবে মানিয়ে চলার অপর নাম মানসি কসুস্থতা। ভারসাম্যে তারতম্য হলেই মানসিক অসুস্থতার লক্ষন প্রকাশ পায়, যার অবশ্য পরিনতি অবসাদ।
‘অবসাদের’ সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে ‘হু'। সর্বক্ষন মনের অভ্যন্তরে দুঃখের অনুভব, নিত্যকর্মে অনীহার পরিস্থিতি দু’সপ্তাহের অধিক স্থায়ীত্ব অবসাদের অন্যতম লক্ষ্মণ।
চিকিৎসকগন অবসাদজনিত কারণ নির্ধারিত করেছেন বেশ কয়েকটি লক্ষন অনুযায়ী, যেমন সহজেই ধৈর্য্যচ্যুতি, নেশায় আসক্তি, নিঃশ্বাসে সমস্যা, সামান্য কারনে রেগে যাওয়া, বিরক্তি, অকারনে টেনশন, অনিদ্রা, ব্লাডপ্রেশার ওঠানামা, হটাৎ হার্টবিট বেড়ে যাওয়া, হজমের গোলমাল, বমিভাব, ইত্যাদি।
মনোবিজ্ঞানীরা দৈহিক, মানসিক ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে মানসিক অবসাদের নেপথ্য কারন হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। পারিবারিক অশান্তি, পেশাগত-চাপ, কর্মস্থলে অসাফল্য, কর্মহীনতা, প্রিয়জন বিয়োগ,শারীরিক অসুস্থতা, গুমোট আবহাওয়া ইত্যাদি অবসাদের নেপথ্য কারণ।
বর্তমান বিশ্বে অতিমারীর মতো ভয়াবহ আকার নিয়েছে মানসিক অবসাদ রোগটি। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে বিশ্বের প্রায় ২৮০ মিলিয়ন মানুষ মানসিক অবসাদে আক্রান্ত। শতকরা ৩.৫% লোক এই রোগের শিকার। এরমধ্যে ৫% প্রাপ্তবয়ষ্ক এবং ৫.৭% ষাটোর্ধ। অবস্থার গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রতিবছর ১০ নভেম্বর দিনটিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস হিসেবে পালন করে।
ভারতে প্রায় ১২০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ৫ কোটি মানুষ মানসিক রোগাক্রান্ত। প্রতি দশজনের মধ্যে একজন মানসিক অবসাদের শিকার। চিকিৎসকের অপ্রতুলতা সমস্যা সমাধানের অন্তরায়। বিপুল সংখ্যক রোগীর চিকিৎসার জন্য যেখানে প্রয়োজন অন্তত ৫৪,৭৫০ জন চিকিৎসক সেখানে আছেন মাত্র সাত হাজার জন চিকিৎসক।
দুঃখজনক হল অন্যান্য শারীরিক রোগের ক্ষেত্রে রোগী ও তার আত্মীয়-সজ্জন ওয়াকিবহাল এবং সহানুভূতিশীল থাকেন অথচ অবসাদও অন্যান্য অসুখের মতোই একটি অসুখ এবং সময়মতো উপযুক্ত চিকিৎসায় এর নিরাময় সম্ভব এ তথ্য অজানা থেকে যায়, অনেকসময় করুণ বিয়োগান্ত পরিনতি নেমে আসে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানসিক-অবসাদ আক্রান্ত রোগী নিজেই রোগ সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকেন। সামান্য কারণে হয়তো চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। যার প্রতিফলন প্রতিদিনই নজরে আসে সংবাদ মাধ্যমে।
মানসিক অবসাদের কারনে বিশ্বে প্রায় ৮ লাখের বেশি মানুষ প্রতিবছর আত্মহত্যা করেন। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে পৃথিবীতে কোথাও না কোথাও একজন মানুষ স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিচ্ছেন।
ভারতের চিত্র যথেষ্ট ভয়প্রদ। ন্যাশানাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো-র রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে গড়ে প্রতিদিন ৩৮১ জন আত্মঘাতী হন। ২০১৬ তে ভারতে আত্মঘাতী হন ২,৩০,৩১৪ জন। ২০১৭ সালে আত্মহত্যা করেন ২৯,৮৮৭ জন, ২০১৮ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪,৫১৬ এবং ২০১৯ সালে এসে সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৯,১২৩। সংখ্যা প্রতিবছর বেড়ে যাচ্ছে চার হাজারের ওপর। এরমধ্যে অধিকাংশের বয়স সীমা ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। এই সংখ্যার একটি বড় অংশ শিক্ষার্থী। ২০১৫ সালের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী প্রতিবছর ৮৯৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। প্রতিদিন প্রায় ২৮ জন এবং ঘন্টায় প্রায় একজন। অভিভাবকদের অতিরিক্ত প্রত্যাশার চাপ, পরীক্ষার ফল মনোমত না হওয়া ইত্যাদি কারণে শিক্ষার্থীরা এহেন চরমপথ বেছে নেন অনেক সময়। পরিবারের সহমর্মিতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম স্বাভাবিক জীবনে। গবেষণায় জানা গেছে, আত্মহত্যার নেপথ্যে ৩২.৪% ক্ষেত্রে পরিবার দায়ী। গার্হস্থ্য হিংসার পরিনতিতে আত্মহত্যার সংখ্যাও কম নয়। এক্ষেত্রে মহিলারাই সংখ্যাগুরু। মনে রাখতে হবে এসব পরিসংখ্যান কেবল নথিবদ্ধ ঘটনাক্রমের।
আত্মহত্যায় ভারতীয় অঙ্গরাজ্যের মধ্যে মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ু প্রথম ও দ্বিতীয়স্থানে রয়েছে। তৃতীয়স্থানে আছে পশ্চিমবঙ্গ। পুরুষদের আত্মহত্যার হার মহিলাদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। দেশের প্রায় ২৬%মানুষ অল্পবিস্তর মানসিক অবসাদে ভোগেন। ১১% মানুষ মাঝারি অবসাদগ্রস্থ। ৬%মানসিক অবসাদগ্রস্থ মানুষের পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ।
সহজেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন। মানসিক অবসাদগ্রস্থ রোগী। প্রয়োজন কেবল পরিবারের সহমর্মিতা এবং সঠিক চিকিৎসা। সাইকোমেট্রিক টেস্টের মাধ্যমে অবসাদের মাত্রা নির্ধারণ করে ওষুধ নাকি কাউন্সিলিং করা হবে স্থির করা হয়। এভাবেই
অবসাদগ্রস্থ রোগী ফিরতে পারেন স্বাভাবিক জীবনে। মানসিক রোগ গুরুত্ব পায় না অথচ সময়মত চিকিৎসা না পেলে মানসিক অবসাদ কেড়ে নিতে পারে অমূল্য প্রাণ। পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা ও সহানুভূতি প্রয়োজনীয়তা কাম্য।
(www.theoffnews.com suicide mental diseases)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours