সোমনাথ রায়, প্রত্নগবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, দুর্গাপুর:

মূল লেখক: আমিন কামিল

(কাশ্মীরি ছোট গল্প 'দি ক্যাটেল পাউন্ড')

দীননাথ কাকার সঙ্গে আমার জানাশোনা বহু যুগের। আমার বাবা আর দীননাথ কাকার গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। আর সে কী বন্ধুত্ব! কথায় বলে না - হরিহর আত্মা - তাই।

বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন দীননাথ কাকা সপ্তাহে একদিন বা দুদিন নিয়ম করে বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন - যদিও তিনি হয়ত তখন কয়েক মাইল দূরের থানাতে বহাল আছেন। বাবার সঙ্গে যোগাযোগের আর কোনও সুযোগ না থাকলেও তাঁর মনে এখনও আমার জন্য বিশেষ স্নেহ-ভালবাসা অটুট। থানার সব খবরাখবর কাকা আমাকে জানাতেন যদিও সে সব খবর অত্যন্ত গোপনীয়।

সেদিন একটা ব্যক্তিগত কাজে তাঁর কাছে গিয়েছিলাম। তার কয়েকদিন আগেই শহরে একটা রাজনৈতিক কারণে খুব অশান্তি হয়েছিল। একদল লোক সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে একটা বাজারে জমায়েত হয়েছিল। দীননাথ কাকার সঙ্গে কথা বলতে বলতে এমনিই বললাম যে কোন সন্দেহ নেই যে যারা আন্দোলন করছে তাদের ধরা তাঁর কর্তব্য, কিন্তু এটা কী ধরণের জঙ্গলের রাজত্ব যে লোকের বাড়ি বাড়ি ঢুকে নিরপরাধ মানুষদের ধরে ধরে গারদে পুরে দেওয়া? আমি তাঁকে বললাম যে আমি প্রায় একডজন বা তারও বেশি সংখ্যায় লোককে ব্যক্তিগতভাবে চিনি যারা এই ধরণের ঘটনায় কখনও স্বেচ্ছায় যোগদান করবে না। কর্তৃপক্ষের এই লাগামছাড়া, নির্বোধ কাজকর্মে কার কী লাভ হবে বলে তিনি আশা করেন?

আমার এই মন্তব্য শুনে দীননাথ কাকা মুচকি হাসলেন, পকেট থেকে সিগারেট কেস বার করে আমাকে একটা অফার করলেন আর নিজে একটা নিয়ে বললেন - “তাহলে তোমার প্রশ্নের জবাব চাই, তাই তো? তাহলে আমি বলি, তুমি শোন”।

দীনুকাকা আমাকে যে কৈফিয়ত দিলেন তাতে আমার একটা পুরনো ঘটনা মনে পড়ে গেল - কম করে ছাব্বিশ বছর আগের ঘটনা। এটা সেই সময়ের ঘটনা যখন কাশ্মীরে মহারাজা হরি সিং-এর রাজত্ব ছিল।

            ঘটনাটা ছিল এইরকম -

একটা সুন্দর সকালে প্রায় দশটার সময় কলেজে যাওয়ার পথে দেখলাম কয়েকজন পুলিশ আধডজন অনিচ্ছুক গরুকে দড়ি বেঁধে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। পুলিশগুলোর পিছু পিছু একদল মহিলা আর কাচ্চাবাচ্ছা বুক চাপড়াতে চাপড়াতে যাচ্ছে। একজন পুলিশ মহিলাদের বলছে - “হয় তোমরা আমাদের কথা বুঝতে পারছ না, না হলে তোমরা সোজা কথা সোজা ভাবে নাও না”। মহিলারা পুলিশগুলোর মন গলানোর জন্য বলছে - “দোহাই হুজুর, আমরা হাত জোড় করে আপনার দয়া ভিক্ষা করছি, ভগবানের দোহাই এই গরুগুলোকে ছেড়ে দিন। আপনাদের সব দুর্ভাগ্য আমাদের হোক!”

আরেকজন পুলিশ রেগে গিয়ে মুখ খারাপ করল - “কী পাপের ফল যে আমরা ভোগ করছি! তোমাদের বোধহয় বিশ্বাস হচ্ছে না যে দশ আনা পয়সাও আমরা দিয়ে দেব”। সে আরেকজন পুলিশকে বলল - “এই, ওদের হাতে পয়সাগুলো দিয়ে দাও তো। তাতে হয়ত ওদের মন ঠান্ডা হবে”। সেই পুলিশটা ওদেরকে পয়সা দিতে গেল কিন্তু তারা পয়সা নিতে অস্বীকার করল। তারা অনুনয় বিনয় করে গরুগুলোকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য ভিক্ষে চাইতে লাগল। সে এক করুণ দৃশ্য। আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। পুলিশ যদি রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো গরুগুলোকে আইনসম্মতভাবে খোঁয়াড়ে নিয়ে যাচ্ছে তাহলে এই দু’দলের মধ্যে নাটকের কারণটা কী? আর পুলিশগুলোই বা ওদেরকে টাকা দিতে চাচ্ছে কেন? আমি দলটার কাছে গিয়ে বললাম - “আমাকে দয়া করে বলবেন ঘটনাটা কী? এই গরুগুলোকে আপনারা কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”

একজন পুলিশ আমার প্রশ্নের উত্তরে বলল - “এটা কোন ব্যাপারই না। এই গরুগুলোকে আমাদেরকে খোঁয়াড়ে দিতে হবে। আমরা এই মেয়েছেলে গুলোকে এটাই বোঝাতে চেষ্টা করছি যে গরুগুলোকে যেই আইনকানুন মেনে খোঁয়াড়ে ঢোকান হয়ে যাবে অমনি তারা ওগুলোকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে পারবে। ঝামেলা শুধু একটাই যে ওদেরকে দশ আনা জরিমানা দিতে হবে - আর সে পয়সাও আমরা এখনই এইখানেই দিতে রাজি। এটা একেবারেই একটা সহজ সরল ব্যাপার কিন্তু এই বোকাদের কে বোঝাবে? তুমি ওদের এটা বুঝিয়ে বলো না! এই দেখ, দশ আনাগুলো দেখতে পাচ্ছ? এগুলো নাও আর দয়া করে আমাদের হয়ে ওদেরকে দাও”। আমি পয়সাগুলো নিলাম না, মহিলাগুলোকে বোঝানোর দায়িত্বও নিলাম না কারণ ব্যাপারটা আমি নিজেই বুঝতে পারিনি। কোন তৃতীয় ব্যক্তির গরু খোঁয়াড়ে ঢোকান হচ্ছে আর পুলিশরা তাদের পকেট থেকে সে জরিমানা মেটাচ্ছে। কেন? ওদের এত মাথাব্যাথা কীসের? যদি মহিলাগুলোর দারিদ্র্য দেখেই ওরা এত বিচলিত হয়ে পড়েছে তাহলে গরুগুলোকে ছেড়ে দিচ্ছে না কেন?

আমি পুলিশগুলোর কাছে আবার গেলাম - “আপনি যথার্থ বলেছেন। কিন্তু আপনারা ওদের হয়ে জরিমানা দিচ্ছেন কেন?”

ওদের মধ্যে একজন করুণ মুখ করে বলল - “আঃ! কী আর বলব তোমাকে - দেখ, আসলে ঘটনাটা হল গিয়ে, মহারাজা সাহেব দিল্লী থেকে গতকাল ফিরেছেন। ওই সময়ে বিমানবন্দর থেকে গুপকারে রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত সমস্ত যানবাহন বন্ধ ছিল। তুমি তো জান, মহারাজা সাহেব যখনই কোথাও যান সব সময় এই রকমই করা হয়। তুমি ভাল করেই জান মহারাজা সাহেবের কনভয় যতক্ষণ না পেরিয়ে যাচ্ছে একটা মাছিও রাস্তায় গলতে পারে না। গতকালও রাস্তার দু’পাশে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার কারণে প্রচুর পুলিশ মোতায়েন ছিল। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে যে সময় মহারাজা সাহেবের কনভয় সিল্ক ফ্যাক্টরির পাশ দিয়ে পেরচ্ছিল তখনই এই বদমাশ গরুগুলো, কোন কারণ ছাড়াই একটা গলি থেকে পাগলের মত বেরিয়ে এসে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে রাস্তা পেরতে গেল। পুলিশরা মরীয়া হয়ে তাদের আটকাবার চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু বৃথাই গেল সে সব চেষ্টা - ফলে সেই অবিশ্বাস্য ঘটনাটা ঘটে গেল - মহারাজা সাহেবের গাড়ি দাঁড়িয়ে যেতে বাধ্য হল যতক্ষণ না সব গরুগুলো রাস্তা পার হল। তৎক্ষণাৎ পুলিশের ডি আই জি সাহেবকে মহারাজা সাহেব নির্দেশ জারি করলেন ওই রাস্তা জুড়ে যত পুলিশ ছিল তাদের এই মুহূর্তে বরখাস্ত করতে হবে। এক ধাপ এগিয়ে ডি আই জি নির্দেশ জারি করলেন যে যখনই কোনও ছাড়া গরু রাস্তায় দেখা যাবে সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরে খোঁয়াড়ে ভরে দিতে হবে আর যদি কোন পুলিশের কর্তব্যে গাফিলতি দেখা যায় তাহলে তাকে বরখাস্ত করা হবে। আমাদের পরিবারের কথা ভাবতে হয় - আমাদের চাকরি নিয়ে আমরা ছেলেখেলা করতে পারি না। আমাদেরকেও কর্তব্য নিষ্ঠার প্রমাণ দিতে হবে। কিন্তু আমাদের এমন দুর্ভাগ্য যে একটাও ছাড়া গরু আমাদের চোখে পড়েনি। ফলে এই গরুগুলোকে গোয়াল থেকে বার করে খোঁয়াড়ে পাঠানো ছাড়া আমাদের সামনে আর কোন রাস্তা খোলা নেই। এই মেয়েগুলোকে দশ আনা জরিমানা দিতে হবে কিন্তু আমরা সেটা দিতে রাজি। তাতে এদের কী সমস্যা হচ্ছে?”

ওই সময়েও আমার হাসি পেয়ে গিয়েছিল - যেমন পেল ওই দিন দীনুকাকা যখন একই রকমের ব্যাখ্যা আমাকে শোনাল।                     

{আমিন কামিল (১৯২৪-২০১৪), প্রয়াত কাশ্মীরি কবি, সাহিত্য সমালোচক, গবেষক এবং সম্পাদক। কাশ্মীরি ভাষার ছোটগল্পের তিনি ছিলেন অন্যতম পথপ্রদর্শক। তিনি কাশ্মীরি ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং প্রভাবশালী নির্মাতাদের অন্যতম, যিনি সাহিত্যিক উজ্জ্বলতার উত্তরাধিকার রেখে গেছেন। ১৯৬৭ সালে তিনি সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন এবং ২০০৫ সালে পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত হন।}

(www.theoffnews.com Kashmir Amin Kamil The Cattle Pound)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours