পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

লোকসভা নির্বাচনের পরে কেটে গিয়েছে বেশ কিছুটা সময়। এখনও বিভিন্ন দলের ফলাফল নিয়ে চলছে আলাপ আলোচনা, তর্ক বিতর্ক। মানুষ এখনও প্রবল উৎসাহী ভোটের ফলাফল নিয়ে কাটাছেঁড়ায়। এই উত্তেজনা এবং উদ্দীপনার মাঝেই একটা ছোট্ট খবর আপনার চোখ এড়িয়ে গেছে নিশ্চয়। কিন্তু এই খবরে আপনি ভারতবাসী হিসেবে গর্বিত হতেই পারেন। আমরাই সেরা গোটা বিশ্বে। কিসে? ভোটের খরচে। ঠিকই শুনেছেন, সারা বিশ্বে নির্বাচনে খরচের বহরে ভারত এক নম্বরে। কি গর্ব হচ্ছে না? ‘সেন্টার ফর মিডিয়া স্টাডিজ’ এর দেওয়া তথ্য বলছে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল হল ২০২৪-এ ভারতের লোকসভা নির্বাচন। এই নির্বাচনে খরচ হয়েছে ১.৩৫ লক্ষ কোটি টাকা, অর্থাৎ প্রতিটি ভোট সংগ্রহে খরচ ১৪০০ টাকা। খরচের বহরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকেও পিছনে ফেলে দিয়েছে ভারতের অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন। সেখানে খরচ হয়েছিল ১.২০ লক্ষ কোটি টাকা।

যে দেশে এখনও অপুষ্টিতে মারা যায় অসংখ্য শিশু, চাকরি না পেয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয় বেকার যুবক, দারিদ্রের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে নিজের সন্তানকে হত্যা করে আত্মঘাতী হন মা, যেখানে ঋণের টাকা শোধ করতে না পেরে কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন হাজার হাজার কৃষক, যে দেশে বন্ধ কারখানার শ্রমিক দুবেলা দুমুঠো খাবার যোগাড় করতে না পেরে সপরিবারে আত্মঘাতী হন সে দেশ শাসক বাছতে খরচ করে সব চেয়ে বেশি। 

‘সেন্টার ফর মিডিয়া স্টাডিজ’ দেশে ভোটে খরচের হিসাব দিয়ে জানিয়েছে, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে খরচ হয়েছিল ৫৫-৬০ হাজার কোটি টাকা। এ বার দ্বিগুণেরও বেশি খরচ হয়েছে। সংস্থাটি আরও জানিয়েছে, ১৯৫১-৫২ সালের সঙ্গে তুলনা করলে খরচসীমার বৃদ্ধি হয়েছে ৩০০ গুণ। তখন একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা খরচ করতে পারতেন। আর এ বার একজন প্রার্থী ৯৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে পারেন। কত গুণ বেড়েছে হিসাব করুন! তাও খরচ-সীমা প্রযোজ্য হচ্ছে মনোনয়ন জমা দেওয়ার পরে হওয়া জনসভা, রোড শো, বিজ্ঞাপন ও পরিবহণ সংক্রান্ত খরচের ক্ষেত্রে। তা ছাড়াও প্রতিটি নির্বাচনে নানা জাতীয় ও আঞ্চলিক দলের হিসাব-বহির্ভূত উপহার, টাকা, সোনা দিয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা তো রয়েইছে। এগুলি নির্বাচন কমিশনের কাছে দেওয়া হিসাবের বাইরে। আরও একটা বিষয় গর্ব করার মত, যারা ভোটে দাঁড়াচ্ছেন, তাদের একটা বড় অংশই হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। গত লোকসভায় এক একজন সাংসদদের গড় সম্পদের পরিমাণ ছিল প্রায় ২১ কোটি টাকা। তার উপর নির্বাচন কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী, রাজনৈতিক দলের খরচের ক্ষেত্রে কোনও উর্ধ্বসীমা নেই। ফলে ভোটে যে কোনও প্রকারে জেতার তাড়নায় বেড়েই চলেছে খরচের বহর। নির্বাচন কমিশনে শাসক রাজনৈতিক দলগুলির জমা দেওয়া তথ্য দেখে অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস (এডিআর) আশঙ্কা করেছে, অর্থ সংগ্রহ ও খরচ এবং তার হিসাবে স্বচ্ছতার চূড়ান্ত অভাব রয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, ২০০৪-০৫ থেকে ২০২২-২৩ এই সময়কালে দেশের ৬টি বৃহৎ রাজনৈতিক দল ৬০ শতাংশ অর্থাৎ ১৯ হাজার ৮৩ কোটি টাকা অনুদান পেয়েছে গোপন উৎস থেকে। এর মধ্যে নির্বাচনী বন্ডও রয়েছে। এই টাকা ঘুরে ফিরে আপনার আমার কাছ থেকেই তো যায়। 

এ তো গেল খরচের কথা। কি ভাবছেন এই সব দেখে রাজনৈতিক দলগুলি একটু রাশ টানবে? আজ্ঞে না, তাদের নির্বুদ্ধিতা, খামখেয়ালিপনা এবং স্বেচ্ছাচারিতার মাশুল দিতে হবে আপনাকে আমাকেই। কারণ প্রার্থী বাছাই। রায়গঞ্জ ও রানাঘাট ২ টি লোকসভা আসনেই এবার জয়ী হয়েছে বিজেপি। আর রায়গঞ্জ ও রানাঘাট দক্ষিণ বিধানসভা ওয়ারি ফলাফলে চোখ রাখলে দেখা যাচ্ছে, রায়গঞ্জ বিধানসভা থেকে বিজেপি পেয়েছে ৯৩,৪০২ টি ভোট। যেখানে তৃণমূল পেয়েছে মাত্র ৪৬,৬৬৩ ভোট। অন্যদিকে, রানাঘাট দক্ষিণ বিধানসভা থেকে বিজেপি পেয়েছে ১,২৩,৫৬৮ ভোট, এখানে তৃণমূল পেয়েছে ৮৬,৬৩২ ভোট। আর এই ২ লোকসভা কেন্দ্রে যে ২ জন তৃণমূল প্রার্থীর কার্যত ভরাডুবি হয়েছে, ১ মাসের মধ্যে তাঁদেরকেই ফের টিকিট দিল তৃণমূল কংগ্রেস। যদিও বনগাঁর পরাজিত তৃণমূল প্রার্থী বিশ্বজিৎ দাসকে বাগদা বিধানসভা থেকে টিকিট দেয়নি দল। বদলে টিকিট দেওয়া হয়েছে ঠাকুরবাড়ির তরুণ প্রজন্মের সদস্য মমতা ঠাকুরের কন্যা মধুপর্ণা ঠাকুরকে। বিধায়কদের লোকসভায় প্রার্থী না করে অন্য কাউকে প্রার্থী করলেই তো লোকসভার পরেই আবার বিধানসভা উপনির্বাচনের দরকার পড়ত না। মানিকতলা কেন্দ্র বাদ দিলে বাকি তিনটি বিধানসভায় উপনির্বাচন হচ্ছে শুধুমাত্র তৃণমূল কংগ্রেস নের্তৃত্বের খামখেয়ালিপনা বা তুঘলকি ইচ্ছার কারণে। এই দোষ থেকে বিজেপিও মুক্ত নয়। তাদের বিধায়ক প্রার্থীরা জিততে পারলে সেখানেও উপনির্বাচন করতে হত আবার। এই উপনির্বাচনেও খরচ হবে কোটি কোটি টাকা, সে টাকাও যাবে আপনার আমার পকেট থেকেই। অতএব, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রতিরক্ষা, প্রযুক্তি এসব ক্ষেত্র চুলোয় যাক, ভোটের খরচে আমরা সবার আগে। এতেই আপনি ভারতবাসী হিসেবে গর্বিত হোন।

(www.theoffnews.com Indian election expenses)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours