তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, কলকাতা;
Neo left feminist movement-
Supported by citizen movement.
একটি ধর্ষণ ও খুন কেন সমস্ত মানুষকে এক জায়গায় নিয়ে এলো? এটা প্রথম প্রশ্ন। মানুষ কি দুর্নীতির প্রশ্নকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে? ধর্ষণ কি গৌণ? নাকি দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। যদিও পশ্চিমে এই ধরণের দুর্নীতি দেখা যায় না এটা ওঁদের অর্থনৈতিক সাফল্য। এই আন্দোলনের প্রশ্নে অনেকে উত্তর দিচ্ছেন মানুষের মধ্যে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ জমা হচ্ছিল।যেমন পয়সা দিয়ে চাকরি কেনা, পরীক্ষায় নম্বর বাড়ানো, ঘুষ নিয়ে প্রভূত সম্পত্তি করা এই সবই হচ্ছিল সরকারি মদতে। তবে এই দুর্নীতি শুরু হয় পরের দিকে বাম আমলে। আর এর তীব্রতা ব্যাপকতা পায় তৃণমূলের আমলে। সবই আগে ছিল তবে কেন এই ধর্ষণ খুন নিয়ে এত প্রতিবাদ? আসলে এই ধর্ষণের সমস্ত প্রমান লোপাট করা হয়েছে। যাতে খুনের সঙ্গে যুক্ত অর্থনৈতিক চক্রকে ধরা না যায়। তাই তড়িঘড়ি তথ্য লোপাট আমজনতার বুকে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। ফলে এই গণ আন্দোলন গণ জাগরণে পরিণত হচ্ছে।
আসলে তৃণমুল জমানায় সিন্ডিকেট রাজ, কাট মানি আম জনতার মুখে মুখে ঘুরছে। সরকারের উৎসাহে ও অনুপ্রেরণায় জন্ম নিয়েছে মাটি মাফিয়া, কয়লা মাফিয়া এইরকম অনেক কিছু। স্কুল কলেজ ইউনিভারসিটিতে দাদাগিরি, গুন্ডাগিরিতে রূপান্তরিত হয়েছে। পার্টি আমলাতান্ত্রিক রাজ এক নয়া ফ্যাসিবাদের জন্ম দিয়েছে।
তাই ডাক্তার ও মহিলাদের লড়াই যত না ধর্ষণের বিরুদ্ধে তাঁর থেকে অনেক বেশি লড়াই এই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আবার একই সঙ্গে বঙ্গ নারীদের লড়াই চালু যার মূলে রয়েছে পিতৃতন্ত্র।
এই কারণেই নারী পুরুষ যৌথ ভাবে লড়ছে কোনও পতাকার তলায় না দাঁড়িয়ে। এই আন্দোলনের রূপ অনেকটাই পশ্চিম দ্বারা প্রভাবিত। পশ্চিমে প্রবাদ ছিল একসময়ে depolitisize political movement। অর্থাৎ পার্টি রাজনীতিকে অস্বীকার করা। এইটা এই দেশে নতুন ট্রেন্ড বলা যায়। তাই সমসাময়িক দলগুলি এই রাজনীতিকে ধরতে পারছে না। আগে ছিল পার্টি রাজনীতির ফরম্যাট তাই আজ নন পার্টি আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এইবার আসি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কথায়।বর্তমান স্বাস্থ্য পরিকাঠামো আধুনিক প্রযুক্তি ভিত্তিক ও একচেটিয়া পুজিবাদী ব্যবস্থাপনার এক অপরিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মুনাফা ও আরও মুনাফাই এই ব্যবস্থার মূল চালিকা শক্তি। মানুষের স্বাস্থ্য এখানে বাজারি পণ্য।
তাই দীর্ঘ স্থায়ী সমাধান খোঁজার ব্যপারে সম্পূর্ণ অন্য ধরনের প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ব্যপারে সবাইকে ভাবতে হবে। এটা সমকালীন সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে নতুন সমাজ গড়ে ওঠার পথ প্রশস্ত করবে।
উন্নত দেশগুলোতে সরকারি স্বাস্থ্য কাঠামো ক্রমেই ভেঙ্গে পড়ছে ও বেসরকারি ব্যবস্থা দ্রুত গজিয়ে উঠছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এইগুলো সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
আমাদের ও অন্যান্য অনুন্নত দেশগুলোও একই দিকে এগিয়ে চলেছে। বর্তমান আন্দোলনের প্রধানত কয়েকটা অভিমুখ রয়েছে। এক হচ্ছে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোয় চুড়ান্ত রাখঢাক ছাড়া সিন্ডিকেটবাজী, যেটা মূলত স্বাস্থ্য দপ্তরের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে হচ্ছে। এটারই চরম ফলস্বরূপ অভয়ার ধর্ষণ ও খুন। এটা সম্পূর্ণ বন্ধ বা সীমায়িত করতে অবশ্যই আশু কিছু কর্মসুচি সরকারকে নিতে বাধ্য করানো উচিত। এটাও বেশ কঠিন কাজ কারণ রাজনৈতিক দলের পোষা গুন্ডাবাহিনীর ও পুলিশ বাহিনীর নিপীড়ন সহ্য করেই এগোতে হবে। এইবার প্রশ্ন কেন এই মহা মিছিল? দ্বিতীয় অভিমুখ হল ধর্ষণ। এই ঘটনায় ধর্ষণের চুড়ান্ত পাশবিক দিকটা আজকের নারী সমাজকে ভীষণ ভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। পুজিবাদী ব্যবস্থা প্রায় পুরোটাই পুরুষ তান্ত্রিক ক্ষমতা ব্যবস্থার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে।একদিকে উৎপাদিকা শক্তি হিসেবে নারীদের কর্ম্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে অন্যদিকে কর্ম্মক্ষেত্রেও নিরাপত্তা অসুরক্ষিত হওয়ায় নারীরা হয় যৌন নিপীড়নের শিকার অথবা পাশবিক ধর্ষণের লক্ষ্য বস্তু।
তাই আন্দোলনের এই অভিমুখটাও আজকের দিনে গুরুত্বপূর্ণ। এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যদি নারীরা তাদের সুরক্ষার জন্য সরকার ও প্রশাসনকে বাধ্য করতে পারে ও নিজেরা কিছু মৌলিক আত্মরক্ষার্থ কলা কৌশল শিখে ও সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে নিজেদেরকে বাঁচাতে উদ্যোগী হয়, সেটাও হবে একটা বড় সামাজিক লাভ। এই আন্দোলনে কেউ কিংবা অনেকেই ভিতর থেকে প্রতিবাদ করছেন আবার কেউ ওই প্রতিবাদের আগুনে নিজের রুটি সেঁকে নিচ্ছে। এই মিছিলে কারা হাঁটছেন? এই মিছিলে হাঁটছেন অসংখ প্রতিবাদী মহিলা। আমি বিশ্বাস করি একদম ভিতর থেকে এগিয়ে আসছেন সঙ্গে বহু পুরুষ ও আছে আট থেকে আশি এই মিছিলেই আবার ধর্ষকরাও হাঁটছেন। আবার কেউ কেউ বা হাঁটছেন ফুটেজ পাওয়ার জন্য। সঙ্গে আছে আবার সংবাদ মাধ্যম, এরাও ফুটেজ চায় যাতে সংবাদ মাধ্যমের টিআরপি বাড়ে।
এখন প্রশ্ন হলো কেন সর্ব স্তরের মানুষ আবার পরস্পর বিরোধী এই একই মিছিলে জড়ো হল?সবাই কি তাঁর নিজের নিজের মত করে আউটলেট খুঁজছে? এইটাই গবেষণার বিষয় তা হয়তো আগামীতে লেখা হবে। এইবার পুজোয় দেখবেন নতুন জামা ছেলে মেয়েদের জন্য তাতে লেখা থাকবে we want justise। বস্ত্র ব্যবসায়ীর মুনাফা হবে, পুজো প্যান্ডেলের থিম হবে তিলোত্তমা বা অভয়া। এখন গানের অনুষ্ঠান হচ্ছে অভয়ার নাম দিয়ে যাতে টিকিট বিক্রি হয়। এই সবই গবেষণার বিষয় শুধু একটি ডাক্তার মহিলার খুন ও ধর্ষণকে কেন্দ্র করে ঘটছে। কিন্তু কেন? ধর্ষণ তো আগেও ছিল পরিবারের মধ্যে ও সমাজে। আমাদের দেশের প্রায় হাজার বছরের যৌন মুখর গালাগালি ধর্ষণের প্রাচীনত্বকে প্রমান করে। ধর্ষণ মগজে, চোখে তারপর মুখে এবং শারীরিক ভাবে। কেন টিকে আছে সদর্পে আর বিবর্তিত হচ্ছে বিভিন্ন রূপে।
এই উত্তর তা হয়তো আগামী দিনে পাওয়া যাবে। যে মিছিল বা গণ জাগরণ আমরা দেখছি এটা ভারত ছাড়ো আন্দোলনের থেকেও অনেক ব্যপক ও বৃহত্তর। আবার প্রশ্ন আন্দোলন কি বুকের আগুন মেটায়? বিচারের জন্য শুধু নাকি আন্দোলন রুটি রুজির ও পথ দেখায়, মানুষ কি নতুন বিকল্প ক্ষমতার স্বাদ পেতে চায় নাকি প্রভু বদলাতে চায়? বাঁচার তাগিদে। এইরকম বহু দিক আছে যা গবেষণার বিষয়। আমরা কিরকম সমাজ চাই, কিরকম হবে? তাঁর কাঠামো এই নিয়ে স্পষ্ট কোনও ধারণা কারুর কাছে নেই। কেন এইরকম সমাজ গড়া যাচ্ছে না? যেখানে ধর্ষণ থাকবে না, জেন্ডার একুইলিটি থাকবে। গরিবের ওপর ধনীর অত্যাচার হবে না, নারী পুরুষ সবাই স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিয়ে আত্মমর্যাদার সঙ্গে বাঁচবে।
কারণ আমরা কি বিকল্প চাই তাই জানি না। তাহলে কি আমাদের নৈতিক কাঠামোর ভিত্তি খুব নড়বড়ে, নাকি কারণ খুঁজতে হবে পুঁজির মধ্যে? পিতৃতন্ত্রের মধ্যে? যদি এটার উত্তর না পাওয়া যায় তাহলে বিকল্প সমাজ গড়ে তোলা অসম্ভব। তবে বিকল্প না পাওয়া গেলেও এই জাগরণ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে কিছু উত্তর নিশ্চই পাওয়া যাবে অচিরেই।
পরিশেষে বলি পূর্ব ইউরোপ ও মার্কিন মুলুকেই এইধরণের আন্দোলন শুরু হয় ষাটের দশকের শেষে। পরে ব্যাপক আকার ধারণ করে। বিশ্বজুড়ে নারীবাদী আন্দোলনের অ-রাজনীতিকরণ কয়েক দশক ধরে তীব্রতর হতে দেখা গেল। বিশ্বব্যাপী, নারীবাদকে পুঁজিবাদ দ্বারা হাইজ্যাক করা হয়েছিল এবং তারপরে আরও বেশি করে নব্য উদারবাদের দ্বারা, একটি মুক্ত-বাজার সমাজের ধারণার সঙ্গে সামাজিক সংহতির চারপাশে আবর্তিত একটি আন্দোলনকে জড়িয়ে ফেলে। নারীরা অনেক এগিয়ে ওই সব মুলুকে, এখন ওই সব দেশে নারীবাদী স্লোগান এখন খেজুরে পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন কেন?
এইখানেও কি তাই হবে? উত্তর নেই, কিন্তু চাই। শেষ বিচারে এই নারীবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত হয় পশ্চিমে পরে পুঁজি তাকে আত্মস্থ করে নেয়। পশ্চিমে নারী আন্দোলন স্তিমিত হয় কারণ নারীর ক্ষমতায়নের কর্মসূচি পুঁজির উদারনৈতিক অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। অর্থাৎ পুঁজির চৌহদ্দির মধ্যেই নারী আন্দোলন শৃঙ্খলিত হলো।তাহলে পুঁজি থেকে মুক্তির উপায় কি?
কোন পথে হাঁটলে নারীর মুক্তি তথা সমাজের মুক্তি আসবে। জানা নেই। পুঁজির দাসত্ব কি শেষ কথা না মানুষ শেষ কথা বলবে?
কবে কিভাবে আমরা কি জানি? উত্তর নেই জানা।
পুজিবাদী বা যেকোনও শোষণ ব্যবস্থা ও একই সঙ্গে পুরুষ তান্ত্রিকতা টিকে থাকে মানুষের চেতনা ও অবচেতন মনে। এর একটা গ্ৰহণ যোগ্যতা খুব ক্ষীণ ভাবে হলেও বহমান থাকে। সচেতন মনের গ্ৰহণ যোগ্যতা বাহ্য জগতের ঘটনার ঘাত প্রতিঘাতে অস্বীকৃত হলেও অবচেতন মনে এটা বহু বহু যুগ ধরে টিকে থাকতে পারে। অর্থাৎ অবচেতন মনে আমরা দাসত্বকে ভালবাসি। আর প্রশ্নহীন আনুগত্য আমাদের মজ্জাগত। যেখানে প্রশ্ন নেই সেখানে উত্তর নেই। তাই যুক্তিহীন বিশ্বাস যা আমাদের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
ফ্রয়েড এটা খুব ভালো ব্যখ্যা করে দেখিয়েছেন তার Civilization and it's discontent বইটিতে।
যুথবদ্ধ ভাবে যখন সমাজের বেশি সংখ্যক মানুষ মানুষী তাদের সচেতন ও অবচেতন মন থেকে ব্যবস্থার গ্ৰহণযোগ্যতাকে শিকড় থেকে উপড়ে ফেলে দেয় তখনই এক নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হয় ও সঠিক নেতৃত্বে নতুন পথে সমাজ পরিচালিত হতে পারে। এই আন্দোলন হয়তো তারই শুরুয়াত। (ক্রমশঃ)
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours