শামা আরজু, লেখক, বাংলাদেশ: সবে মাত্র নতুন এসেছি এখানে। তৃতীয় শ্রেণীর একটি মেয়ে বিদ্যালয়ে আসছে না দীর্ঘদিন। অনুপস্থিতির কারণ জানতে গিয়ে জানলাম, মেয়েটা গত বছর রেপ হয়েছে। বুলিং এর শিকার মেয়েটার বাড়িতে গেলাম। বারবার বুঝিয়ে মেয়েটাকে স্কুলে আনলাম। বলেছিলাম যারা তোমাকে এসব নিয়ে কথা বলে লজ্জা তাদের থাকা উচিত। তুমি কেন লজ্জায় ঘর থেকে বের হবে না! তুমি যদি ঘরে বসে থাকো তবে তো ওরাই জিতে যাবে। আর কি কি বলেছিলাম এখন আর মনে করতে পারছি না। অনেকবার আমাকে ওদের বাড়িতে যেতে হয়েছে। মেয়েটি একসময় বিদ্যালয়ে আসা শুরু করেছে। যদিও তখনও তাকে কথা শুনতে হতো। একসময় সে প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গেল। সেখানে গিয়ে আর তার পড়াশোনাটা সে চালিয়ে যেতে পারল না। ততদিনে তার বয়স কৈশোরে। খুব ইমোশনাল থাকে এই সময় শিশু। তাই মানুষের কথাকে আর কোনভাবেই নিতে পারছিল না। লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেল। ধর্ষকের বিরুদ্ধে থানায় মামলা ছিল। পুলিশ মধ্যস্থতাকারী হয়ে ধর্ষকের সাথে মেয়েটার বিয়ে দিল। পুলিশ ধর্ষকের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিল। মামলা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ওরা একটা ফাঁদ পেতেছিল। মেয়েটি সেই ফাঁদে পা দিতে বাধ্য হলো। ধর্ষকের সঙ্গেই তার বিয়ে হল। ও ধর্ষকের বাড়িতে গেল। সেখানে গিয়ে ধর্ষক এবং তার মায়ের অত্যাচারে সে বাধ্য হল বাবার বাড়িতে ফিরে আসতে। কিছুদিন পর বাবা তাকে তার দ্বিগুণ বয়সি এক মোল্লার সাথে বিয়ে দিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললো। বেশ কয়েকদিন মেয়েটি আমাকে ফোন করেছিল। আমি তার ফোন ধরিনি। কারন এর পরে আর কিছু হলে আমি সেটা নিতেও পারবো না আবার ওর জন্য কোন কিছু করতেও পারবো না। সমাজের প্রতিটি স্তরে পচন ধরেছে। রমিজ আমার স্কুলে প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ফার্স্ট হয়ে এসেছে। ওর বাবা একসময় রিক্সা চালাত। এখন কিছু করে না। কাজের মধ্যে কাজ হলো ওর মাকে মারধর করা। স্কুলে আসার সময় রমিজকে স্কুলে আসতে দিত না। সে চাইতো রমিজ কাজ করুক। রমিজকে সাথে করে নিয়ে গিয়ে হাইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলাম। বিনা বেতনে পড়ানোর ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলাম। কিন্তু রমিজের পড়াটা আর হলোই না। রমিজের কোন প্রাইভেট টিচার ছিল না। কিছুদিন আগে তার বাবা মারা গেল। ছয় মাস পর গেল মা। তার মাকে আমি যোদ্ধা বলি। কারণ এই মহিলা গ্রামে লজ্জায় চাইতে পারত না। শহরে গিয়ে মানুষের বাসায় কাজ করতো, এমনকি ভিক্ষাও করতো। চারটা সন্তান। বিয়ের বয়সী দুটি মেয়ে আছে। পাড়া পড়শী বলে মেয়েগুলির নাকি চরিত্র ভালো না। এজন্য এখানে এসে থাকতেও পারে না। ওরা নাকি আসামেও (ভারত) গিয়ে থাকে। জন্ম নিবন্ধনের জন্য আমার কাছে এসেছে। কিন্তু আমি তো দিতে পারিনি। কারণ ওরা আমার স্কুলে পড়েনি। ওদের কোন কিছুই আমার কাছে নাই। এরা কি বাংলাদেশের নাগরিক না! শুনেছি রমিজ এখন রিক্সা চালায়। আজগর পড়তো আমার স্কুলে। রমিজের মত সেও প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত বরাবরই ফার্স্ট হত। পঞ্চম শ্রেণীর পর আজগরের পড়া আর চলেনি। ওকে স্বর্ণকারের দোকানে কাজ শেখানোর জন্য দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওর মাকে বলেছিলাম ওর পড়ার খরচ আমি চালাবো। ওকে পড়তে দিন। আমার সৌভাগ্য আজগরের মা আমাকে গালিগালাজ করেনি। কারণ পেটের তাগিদের কাছে সবকিছুই হার মানে। ফাতেমার বাবা নাকি নেশা খায়। কাজকর্ম কিছুই করে না। মা আশেপাশের বাড়ি ফরমায়েশ খেটে যা পায় তাতেও ভাগ বসায় ফাতেমার বাপ। প্রাইমারি শেষ করেই ইতি টানতে হলো শিক্ষাজীবনের।করোনার বিভীষিকার সময় রাত বারোটায় নজীব উল্যা মেম্বার ফাতেমার মায়ের মাথার কাছে দুই কেজি চাল রেখে ফাতেমাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। সবাই কেবল সফলতা দেখে। কি করে দেখে জানি না। আমি সফলতা দেখি না। সফলতা আমার কাছে মিরাক্কেলের মত। অথচ মিরাক্কল নিয়েই মিডিয়া হুমড়ি খায়। সাধারণত যেটা হয় সেটা হল ব্যর্থতা। আমি তো কেবলই ব্যর্থতা দেখি। সাধারণ বিষয় নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, সাধারণ বিষয়গুলি অতি সাধারণভাবেই সবাই নেয়। কিন্তু আমি নিতে পারি না। আমি সাধারণের ব্যর্থতা নিতে পারি না। প্রচন্ড রাগ হয় সিস্টেমের ওপর। আমার তখন চে কে মনে পড়ে। আমার তখন চের মতো একটা বন্দুক খুব জরুরি মনে হয়। একহাতে থাকবে বন্দুক অন্য হাতে আমার ক্ষত-বিক্ষত বুকটা চেপে ধরব আর দমাদম কয়টা গুলি করবো।আমার বিপ্লবী হবার স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে গেল। (www.theoffnews.com - Bangladesh revolution)
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours