পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

“আগে কেবা প্রাণ, করিবেক দান”। আচ্ছা কবি কি আগে থেকেই দেখেছিলেন মানুষের সেবা করবার জন্য মানুষের এই আকুতিকে? কি জানি তখনও কি এভাবেই ভোট হত? ভোট তো জনগনের সেবা করবার জন্য স্বীকৃত পন্থা, অন্তত রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের তো তাই মত। এবারে বলুন তো নির্বাচনের জেতার জন্য অর্থাৎ মানব সেবার একটু সুযোগ পাওয়ার জন্য এই আকুলতার গুঢ় রহস্য কি? সম্প্রতি একজন বিচারপতি এই নিরীহ প্রশ্ন তুলেছেন আদালতে। “এত হানাহানি, এত হিংসা কিসের জন্য? ভোট কি তাহলে পাঁচ বছরের চাকরি? যেখান থেকে টাকা উপার্জনই মূল উদ্দেশ্য।“ আসলে মাননীয় বিচারপতিও এই উত্তরটা সম্যক জানেন। দিনের শেষে তিনিও এই রাজ্যের একজন বাসিন্দা। তার বাড়িতেও টিভি চলে, তার বাড়িতেও খবরের কাগজ আসে। বন্ধু বান্ধব আত্মীয় পরিজনের সঙ্গে তারও কথা হয়, রাজ্যের পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনিও খুব ভাল করেই জানেন। তাই তো আদালতে তার এই প্রশ্ন শুধু প্রশ্ন নয়, উত্তরও। 

আমাদেরকে বেছে নিতে হবে, ভুল বললাম আসলে আমাদেরকে মেনে নিতে হবে সামান্য কিছু উন্নয়ন এবং তার বিনিময়ে কিছু প্রাণ বিসর্জন। এটাই এখনকার রীতি। উন্নয়ন বলছি কেন? ভোট এলেই আমাদের এখানে কিছু কাজ হয়, এই ধরুন রাস্তাঘাট মেরামত, নতুন কালভার্ট বা সেতু তৈরি, কোথাও কোথাও বিদ্যুতায়ন ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই সময় দেখা মেলে মানবসেবায় ব্রতী হওয়া সারা বছর ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা নেতারও। এটুকুই লাভ ভোটের আগে। আবার ভোট এলেই এই মানবসেবা করবার অত্যুৎসাহে জীবন যায় কিছু তুচ্ছ মানবের। তো বৃহৎ স্বার্থে এই গোটা পঞ্চাশেক প্রাণ তো দেওয়াই যায়, কি বলুন। স্বাধীনতা সংগ্রামে তো কত প্রাণই গেছে, এটাও তেমনই একটা মহৎ কাজে প্রাণদান ধরে নিলেই ল্যাঠা চুকে যায়।  

কোন দলের কে মারা গেলেন তার তথ্য তলাশ এখানে করব না। কারণ সব দলই তো মানুষের সেবা ছাড়া আর কিছু বোঝেই না। তাই দল না গুনে, বরং দেহ গুনি। মৃতদের কারও বাবা, কাকা, মামা, ভাই এসব না ভেবে বরং ভাবি বীর, মহৎ, যোদ্ধা। তাহলে দেখবেন আর মন খারাপ লাগবে না। সেদিন দেখলাম চায়ের দোকানে কয়েকজন খুব খুশি আরাবুলের ভাঙ্গড়ে আই এস এফ কর্মীদের বোমাবাজিতে। সংবাদ মাধ্যমেই জানলাম আরাবুল ইসলাম নাকি ভয়ে একটি ঘরে সারারাত লুকিয়ে ছিলেন। মানুষ খুশি, আরাবুলের একছত্র আধিপত্য এভাবে চলে যেতে দেখে। কিন্তু যাদের ভয়ে আরাবুল ভিত তাদের হাতেও যে বোমা বন্দুক এ কথা ভুলে গেলে মুশকিলে পড়বেন। এক সময় বামেদের বলা ভাল সিপিএমের প্রবল অত্যাচারে জর্জরিত মানুষ তৃণমূলের জয় দেখে বা দাপট দেখে খুশি হতেন। সেই তৃণমূল এসে কি অবস্থা তা তারা নিজেরাই অনুভব করতে পারছেন। কিন্তু তৃণমূলের বিকল্পও যদি বোমা বন্দুক নিয়েই ক্ষমতায় আসে তারাও যে ধোয়া তুলসিপাতা হবে না সেটা বোঝার জন্য দূরদর্শিতার প্রয়োজন পড়ে না। 

গ্রামে গঞ্জে ঘুরে বেড়ানোর সূত্রে একটা বিষয় বেশ বুঝতে পেরেছিলাম এই পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূলের বিশেষ অসুবিধার কোনও কারণ ছিল না। প্রবল দুর্নীতি, অসৎ লোকের ভিড়, বহু নেতার হাজতে থাকা, নেতৃত্বের ঔদ্ধত্য স্বত্বেও মানুষের কাছে এই মুহূর্তে কোনও ঠিকঠাক বিকল্প ছিল না। বিজেপি কেন্দ্রে রয়েছে দীর্ঘদিন, তাদের কাজকর্ম দেখে ইতিমধ্যেই মানুষ খুব ভাল করেই চিনে গিয়েছে। সিপিএমকে এর আগেই দেখে নিয়েছে, তাই নতুন ভোটার বাদ দিলে সকলেই জানেন তারাও কতটা ভয়ঙ্কর ছিল। রইল কংগ্রেস, সে এ রাজ্যে আলোচনাতেই আসে না, এখন তো আবার তারা বামেদের সঙ্গে জোটে। আর কে আছে বলুন? আই এস এফকে আমি ধরছি না কারণ দুই একটি এলাকা ছাড়া গোটা রাজ্যে তাদের প্রভাব নেই বললেই চলে। অর্থাৎ তৃণমূল কর্মীরা অতি উৎসাহী না হলেও দল জিততো। তবে এবারে যেটা লক্ষণীয় সেটা হল এই নির্বাচন কালের মৃত্যুমিছিলে শাসকদলের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি। এবারে কিন্তু তৃণমূলের বেশ কয়েকজন কর্মী এই নির্বাচনে প্রাণ হারিয়েছেন। অর্থাৎ কারো কারো মতে প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। মানুষ শাসক দলের থেকে ভরষা হারাচ্ছেন। কিন্তু এই প্রতিরোধের কায়দাটাই অস্বস্তিকর। ইতিহাস বলছে হিংসাকে হিংসা দ্বারা জয় করে পরে হিংসাহীন থাকাটা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই তো আমাদের জীবনে হিংসা ধারাবাহিক।

একটা পঞ্চায়েত হোক বা পুরসভা, বিধানসভা হোক বা লোকসভা। জেতা মানেই ক্ষমতা। এখন ক্ষমতা মানেই অর্থ, প্রতিপত্তি। এই নেশা ছেড়ে দেওয়া কঠিন নয় অসম্ভব। তাই তো মৃত্যু আছে জেনেও জাটিঙ্গা পাখির মত ভোটের আগুনে এসে ঝাঁপ দেয় রাজনীতির কারবারিরা। তবে এখানে কিন্তু ওই প্রবাদটাই বেশি করে নজরে পড়ে “রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়”। যারা মারা যান তারা অধিকাংশই গরীব মানুষ, একজন বড়লোককে আরও বড়লোক বানাতে গিয়ে তারা প্রাণ দেন। তাদের ছেড়ে যাওয়া পরিবার গরীব থেকে আরও গরীব হয়। তবুও চলতেই থাকে এই ভোটের খেলা, মৃত্যুর মেলা, বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ।

(www.theoffnews.com - Bengal election death)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours