কৃষ্ণা গুহ রায়, লেখিকা ও সমাজকর্মী, কলকাতা:

তোমায় কিছু দেবো বলে চায় যে আমার মন নাইবা তোমার থাকলো প্রয়োজন।" নতুন যুগের বাণীদূত রবীন্দ্রনাথ। খন্ডকালের হয়েও তিনি সর্বকালের।  বিশেষ দেশের হয়েও সব দেশেই তার সাদর প্রতিষ্ঠা। 

আমাদের জীবনের নানা অনুভূতির সঙ্গে তিনি জড়িয়ে আছেন। তাঁর গানের বাণী ও সুরে  মর্মে মর্মে অনুভব করি বিচিত্র ভাবনা, বেদনা, আকুলতা ও জীবন দর্শন। মানুষের হৃদয় কন্দরে সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার, গভীর গম্ভীর অনুভূতিতে যে নিত্যলীলা তাকেই তিনি রূপময় করে তুলেছেন৷  তার অনুভুতিকে সঙ্গে নিয়েই কর্মমুখর জীবনে শুরু হয় পথ চলা৷ 

ও আলোর পথযাত্রী  লক্ষ্যে অবিচল থেকে সমস্ত তমসার বুক চিরে এগিয়ে চলো৷ আজ বরণ করে নাও  যা সত্য, যা শাশ্বত মানবকল্যাণে যা কিছু ভালো তাকেই। সৌন্দর্য পিয়াসী বিশ্ববরেণ্য কবিকে আমরা খুঁজে পাই তার জীবনের টুকরো টুকরো ঘটনার মধ্য দিয়ে। 

রবীন্দ্রনাথের বড়দিদি সৌদামিনী দেবী পুত্রসম ছোট ভাইকে মানুষ করেছেন৷ কবি বলতেন, "আমার বড় দিদি আমাকে মানুষ করেছেন তিনি আমাকে খুব ভালবাসতেন৷ মার ঝোঁক ছিল জ্যোতিদা আর বড়দার উপরেই৷ আমিতো তার কালো ছেলে৷ বড়দির কাছে কিন্তু সেই কালো ছেলেই ছিল সবচেয়ে ভালো৷ তিনি বলতেন, যাই বলো রবির মতন কেউ না। বড়দিদির হাত থেকে আমাকে তুলে নিলেন নতুন বৌঠান৷" পরবর্তীকালে সেই কালো ছেলেই সারা বিশ্ব আলো করেছিলেন৷ 

একবার একটা জোর গুজব ওঠে রাশিয়া বুঝি ভারত আক্রমণ করবে। রবীন্দ্রনাথের মা সারদা দেবীর কাছেও এ গুজব পৌঁছায়৷ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তখন হিমালয় অঞ্চলে। গুজবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে  সারদা দেবী রাশিয়ানদের সম্পর্কে  স্বামীকে সাবধান করে দেবার জন্য একটি চিঠি লেখার বিশেষ প্রয়োজন বোধ করেন। 

কিন্তু বাড়িতে যার কাছেই এর জন্য শরনাপন্ন হন৷ তিনি তাতে কান দেন না৷ কেন না এই গুজবে তারা সামান্য বিচলিত নন৷ অগত্যা তিনি বাধ্য হয়ে শরণ নিলেন কনিষ্ঠ বালক পুত্রের৷ বালক রবীন্দ্রনাথ মহা উৎসাহে মায়ের সেই ইচ্ছা পূরণ করলেন৷ 

১৯০৫ এর ১৯শে জানুয়ারি। সকাল থেকেই টিপ টিপ বৃষ্টি৷ মহর্ষির অবস্থা আশঙ্কাজনক৷ স্থির হয়ে শুয়ে আছেন শয্যায়৷ আত্মীয়-স্বজন, ছেলে মেয়ে সবাই একে একে তার সামনে যাচ্ছেন৷ রবীন্দ্রনাথ কাছে গেলে সৌদামিনী দেবী আচ্ছন্নের মতন পরে থাকা পিতার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলতে থাকেন, "রবি, রবি এসেছে৷"

পিতা একবার একটু চোখ মেলে হাতের আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করলেন পুত্রকে বসতে৷ দেবেন্দ্রনাথ মাথাটি একটু হেলিয়ে দিলেন পুত্রের দিকে৷ যেন কিছু শুনতে চান৷

সৌদামিনী ছোট ভাইকে বললেন, "আজ সকালে উপাসনা হয়নি, বোধহয় তাই শুনতে চাইছেন৷ তুমি ব্রাহ্মধর্ম পড়ো ৷" রবীন্দ্রনাথ পিতার কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে পড়তে লাগলেন, "অসতো মা সদ্গময় / তমসো মা জ্যোতির্গময়৷" মহর্ষি বলে ওঠেন, "আমি বাড়ি যাব"৷ তারপরেই বাকরুদ্ধ৷  চলে গেলেন, দুপুর তখন একটা পঞ্চান্ন মিনিট৷ 

সেবার বৈশাখের দাবদাহে শান্তিনিকেতনের শান্তি বিপন্ন৷ গাছের একটি পাতাও নড়ে না৷ হঠাৎ করে সম্পুর্ন আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেল৷ বৃষ্টির কয়েক ফোটা ক্ষিতি মোহন সেনের গায়ে পরতেই সোল্লাসে ছুটে এলেন, গুরুদেব গুরুদেব বৃষ্টি এসেছে৷ রবীন্দ্রনাথ স্মিত হেসে লিখে ফেললেন, "ঐ আসে , ঐ অতি ভৈরব হরোষে, জল সিঞ্চিত ক্ষিতি সৌরভ রভসে"৷ রচিত হল কালবৈশাখী কবিতা৷ 

সেই ক্ষিতি মোহন সেনের কন্যা, নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মা, আশ্রম কন্যা অমিতা সেন ১৯৯৫ সালে আমাকে আকাশবাণীর "বসন্ত উৎসব" উপলক্ষ্যে এক ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, এই যে আজকে আমার কাছে এসেছো সে তো তারই জন্য৷ শান্তিনিকেতনে তার "প্রতীচীর" বারান্দায় রাখা বেতের চেয়ারগুলো দেখিয়ে বলেছিলেন, এখানে বসতেন আমাদের প্রিয় কবি ৷ 

সেদিন দুপুরে খাবার টেবিলে শুধুই কবির গল্প৷ কবিগুরু যেবার বসন্ত উৎসবের সূচনা করলেন, অমিতাদি তখন ছাত্রী৷ পলাশের ডাল হাতে নিয়ে শুরু হতো "ওরে গৃহবাসী দ্বার খোল দিয়ে"৷ আক্ষেপ করে বলেছিলেন, তখন আবীর খেলা হতো না৷ রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করতেন না৷ আর রাত হলেই উনি আমাদেরকে নিয়ে যেতেন কোপাইয়ের ধারে৷ সবাই মিলে গোল হয়ে বসে আমরা গাইতাম, "আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে৷" 

একজন রাজার কথা শুনেছিলাম শৈশবে৷ তিনি আসতেন একা একা বৈশাখে৷ গানে, কবিতায়, নৃত্যে, নাটকে ফুলের সভায়৷ শুনেছি বিশাল তাঁর চক মিলান বাড়ি৷ তাঁর মনোজগতে ছিল না পরিখা কোনও, ছিল না প্রহরা৷ সে খোলা জানালার ধারে বসে কখনও অমল হয়ে নিত্য পথচারীদের আনাগোনা প্রত্যক্ষ করতো, কখনও তারাপদ হয়ে আতিথেয়তার আরাম বর্জন করে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছিল প্রকৃতির উন্মুক্ত ঠিকানায়৷ আবার কখনওবা সেই রাজাই বীরপুরুষ হয়ে উন্মুক্ত তরবারী হাতে ভয়ঙ্কর দস্যুদের হাত থেকে মাকে রক্ষা করতে দৃঢ়সঙ্কল্প৷ 

শিলাইদহের প্রজারা বুঝেছিল সেই রাজার স্নেহচ্ছায়া৷ দেশ, কালের গন্ডী ছাড়িয়ে তিনি যে তখন সবার হৃদয়ের রাজা৷ বিশ্বজয়ের মুকুট মাথায় পরেও নিরহঙ্কারী রাজাই যে একমাত্র বলতে পারেন, "এ মনিহার আমায় নাহি সাজে" 

ভানুসিংহের হাতে খড়ি, মাটি, শ্রীরাধার ছবি ঝুরঝুর। পাখোয়াজে জমজমাট গানের আসর ভেঙ্গে, শূন্য ভিটে, রিক্ত তালগাছের মাথায় ভাঙা জীবনের গান, কাক ডেকে যায়, হু হু বাতাসের শব্দে শুনি বাস্তুসাপের গাজন৷ মেহের আলীর মতন চিৎকার করে উঠি —— 

"সব ঝুট হ্যায়"।

(www.theoffnews.com - Rabindranath Tagore)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours