পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
একটু মন মরা, বেশ যেন দুশ্চিন্তায়। আমার খুব কাছের ভাই, বন্ধু, নিকটাত্মীয় সে। খুবই ভাল সম্পর্ক আমার সঙ্গে। দুশ্চিন্তার কারণ জিজ্ঞাসা করে জানলাম আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে তার ডিউটি পড়বার কথা ভেবেই আতঙ্কিত সে। পেশায় শিক্ষক, খুবই বিনয়ী, মিতভাষী মানুষটির এই ভয় দেখে একটু চিন্তা জাগল আমারও। এ নিয়ে পরিচিত মহলে কথা বাড়াতেই দেখলাম জাতি, ধর্ম, চাকুরী নির্বিশেষে প্রায় সকলেই পঞ্চায়েত ভোটে ডিউটি নিয়ে আতঙ্কিত।
আসলে এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচন কেমন হতে চলেছে তার ট্রেলার কিন্তু রোজই দেখতে পাচ্ছি আমরা। শাসক দলের অতি উচ্চ পদস্থ নেতা ইতিমধ্যেই হিংসাহীন, শান্তিপূর্ণ পঞ্চায়েত নির্বাচন উপহার দেওয়ার ঘোষণা করেছেন। সেই ঘোষণা তিনি কলকাতা পুরনির্বাচনের আগেও করেছিলেন। তার পরে কি হয়েছে সকলেরই জানা। এবারেও পঞ্চায়েত নির্বাচনে স্বচ্ছ ভাবমুর্তি এবং সর্বজনগ্রাহ্য প্রার্থী দিতে চেয়ে তার উদ্যোগ বেশ প্রশংসনীয়। কিন্তু নবীন এই নেতার এখনও ঠিক ভাবে জানা হয়নি তিনি ঠিক কাদের নিয়ে এই দলটি চালান। দলে নবজোয়ারের নামে যে আত্মশুদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা এখন রীতিমত ব্যুমেরাং। পঞ্চায়েত নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী কে হবে তা ভোটাভুটির মাধ্যমে স্থির করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেখানেই বাধে গোল। এই সামান্য প্রার্থী বাছাইয়ের নিজেদের মধ্যে হওয়া নির্বাচনেও প্রতিদিন গোলমাল লেগেই আছে। না, ছোটখাটো কোনও মনোমালিন্য নয়। রীতিমত মারামারি, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ব্যালট ছেঁড়া, গালিগালাজ কি নেই এই গোলমালে।
আচ্ছা ভাবুন তো, যারা নিজেদের মধ্যে হওয়া নিতান্ত ঘরোয়া একটা নির্বাচনে তাদের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের সামনে এমন হিংসা ঘটাতে পারে, তারা পঞ্চায়েত নির্বাচনে জিততে কি কি করতে পারে? ভাবার দরকার নেই, এর আগে এগুলি ঘটেছে, এবার তারই ড্রেস রিহার্সাল চলছে। এটা কিন্তু ধারাবাহিক, মানে এক আধবার ঘটেছে এমনটা কিন্তু নয়। যবে থেকে এই নবজোয়ারের নামে প্রহসন শুরু হয়েছে, তবে থেকেই কোনও না কোনও জায়গাতে প্রার্থী বাছাইয়ের নামে গোলমাল, অশান্তি লেগেই আছে। এইসব অবাধ্য কর্মীদের খুব যে কড়া শাস্তি হয়েছে এমনটাও এখনও শোনা যায়নি। তাই তো কোচবিহার থেকে মুর্শিদাবাদ প্রার্থী বাছাই ঘিরে এই ব্যালট ছিনতাই এর রিহার্সাল অব্যাহত ফি দিনই। শাস্তির ভয় যখন নেই তখন ধরে নিতেই হয় এই কাণ্ডে দলের নেতৃত্বেরও হয়তো আলগা প্রশ্রয় রয়েছে।
সরকারী এই ছাপোষা কর্মীদের এমন ধারাবাহিক ঘটনাক্রম দেখে কি ভয় হওয়া অস্বাভাবিক নয়? শাসক দলের কথা রেখে এবার বিরোধীদের কথায় আসা যাক। আগামী পঞ্চায়েত ভোটে ঠিক কি ইস্যু সামনে রেখে লড়াই হবে তা এখনও তাদের কাছে পরিস্কার নয়। তারা দুর্নীতি ইস্যুতে গলা ফাটাবেন না কি গ্রামে না হওয়া কাজের জিগির তুলবেন তা নিয়ে স্পটতই দ্বিধাবিভক্ত। প্রধান বিরোধী দল বিজেপি তাদের রাজ্যের বহু জায়গাতে বুথ কমিটি গঠনের লোক নেই। বিরোধী দলনেতা যা বলেন, দলের রাজ্য সভাপতি বা অন্য নেতারা সেটাকেই নস্যাৎ করে দেন। অর্থাৎ এখানেও সমন্বয়ের বড় অভাব। কংগ্রেস এবং বামেরা সাম্প্রতিক একটু উপনির্বাচনে জিতে প্রাসঙ্গিক হওয়ার চেষ্টা করলেও, এখনও গ্রামে তাদের ভিত্তি সেভাবে মজবুত হয়নি। বামেদের আধুনিক বা এই প্রজন্মের নেতারা এখনও গ্রামের গভীরে গিয়ে কাজ করতে স্বচ্ছন্দ নন। সব মিলিয়ে খুবই ভজঘট একটা অবস্থায় রাজ্যের রাজনৈতিক চালচিত্র।
নয়তো এমন ভাবে বিভিন্ন বিষয়ে দুর্নীতিতে জড়িয়ে থাকা একটি সরকারের বিরুদ্ধে সেভাবে জনমত গড়ে তুলতে বিরোধীরা পারছে কই? শাসক দলের সর্বোচ্চ নের্তৃত্ব যখন কাটমানি ফেরৎ দেওয়ার ঘোষণা করেছিলেন তখন পঞ্চায়েত স্তরে রীতিমত শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। স্থানীয় বহু নেতা কিছু কিছু টাকা ফেরতও দিয়েছিলেন। এই ঘটনা প্রমাণ করে দিয়েছিল এই সরকার বা তার চালকরা কাটমানি খেয়ে থাকেন। ফুলে ফেঁপে উঠেছিলেন না খেতে পাওয়া গরীব পঞ্চায়েত সদস্য থেকে প্রধান সকলেই। এতটা নগ্নভাবে না হলেও হতদরিদ্র সর্বহারা পঞ্চায়েত সদস্যদের ফুলে ওঠার নজির বাম আমলেও অজস্র আছে। ভাবুন তো এই যে মধুর ভাণ্ডার এ কি কেউ ছেড়ে দিতে চায়? যারা এই সুখ পেয়েছেন তারাও ছাড়তে চাইবেন না, আবার যারা কাছে থেকে দেখছেন কি মধু আছে এতে তারাও তা হাতাতে মরিয়া হবেনই। ঘটেও তাই। তাই তো দলের প্রার্থী বাছাই থেকেই মরিয়া সকলে। যেনতেন প্রকারেণ পঞ্চায়েত প্রার্থী হতেই হবে। আর প্রার্থী হলে তো জিততেই হবে যেভাবেই হোক। দলের নের্তৃত্বও সব জানেন বৈকি। তাই তো তারাও দূর থেকেই মজা দেখেন। আর এই মজা দেখে শিউরে ওঠেন সাধারণ ছাপোষা মানুষগুলি। যাদের চাকরির দোহাই দিয়ে, পরিবার পরিজন রেখে প্রাণ হাতে করেই যেতে হয় ভোটের ডিউটিতে।
(www.theoffnews.com - ballots looted West Bengal)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours