কাজী নূর, কবি, সাহিত্যিক ও ফিচার রাইটার, বাংলাদেশ:

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার আর মুক্তিযোদ্ধারা এ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন এবং আত্মদানের জন্য সাতজন সেনা সদস্য পেয়েছেন বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব। শ্রেষ্ঠ সাত বীর বাঙালীর একজন হলেন বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল। ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দরুনই গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে শাহীদ হন তিনি। মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল ১৯৪৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভোলা জেলার দৌলতখান উপজেলার হাজীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মোস্তফা কামালের বাবা হাবিবুর রহমান ছিলেন সেনা সদস্য এবং মা মালেকা খাতুন গৃহিণী। বাবার চাকরী সূত্রে কুমিল্লা সেনানিবাসে কাটে তার ছেলেবেলা। সেনানিবাসে সেনাদের কুচকাওয়াজ, মার্চপাস্ট ইত্যাদি ভালো লাগতো তার। বাদ্যধ্বনির তালে তালে পা ফেলে সেনাদের সুশৃঙ্খল কুচকাওয়াজ দেখে তার কিশোর মনে সেনা সদস্য হবার আকাঙ্খা জাগে। মনে মনে স্থির করেন সেনাবাহিনীতে যোগ দেবেন। পরিবার থেকে আপত্তি করায় ১৯৬৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাড়ী থেকে নিরুদ্দেশে হয়ে যান। পালিয়ে গিয়ে পাকিস্তান ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন। সফলতার সাথে দীর্ঘ প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৬৮ সালে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কুমিল্লায় সৈনিক হিসেবে তাকে ন্যস্ত করে।

মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল ১৯৭০ সালে ১৬ বছরের কিশোরী পেয়ারা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। যখন তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন তখন স্ত্রী পেয়ারা বেগম ছিলেন অন্তঃস্বত্তা। সাধ করে স্ত্রীকে বলেছিলেন তার অনুপস্থিতিতে যদি পুত্রসন্তান হয় তবে তার নাম 'বাচ্চু' আর কন্যা সন্তান হলে 'টুনি' নাম রাখতে। তবে যুদ্ধে যাবার পর প্রাণ নিয়ে আর ফিরে আসেননি মোস্তফা কামাল। পরিবার, সন্তান সম্ভবা স্ত্রী আর অনাগত সন্তানের কথা না ভেবে দেশমাতৃকা রক্ষায় যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি।

ভালো বক্সার হিসেবে রেজিমেন্টে সুনাম ছিল মোস্তফা কামালের। নানা কর্মতৎপরতার জন্য অবৈতনিক ল্যান্স নায়েক নিয়ন্ত্রণের অজুহাতে পাকিস্তানিরা সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চতুর্থ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে মোতায়েন করে। পাকিস্তানিদের চক্রান্ত বুঝতে পেরে কয়েকজন বাঙালি সৈনিককে সাথে নিয়ে মেজর শাফায়াত জামিল রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্ণেল খিজির হায়াত খান সহ সকল পাকিস্তানি অফিসার ও সেনাদের গ্রেফতার করেন। এরপর তারা মেজর খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে আশুগঞ্জ, উজানিস্বর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এন্ডারসন খালের পাশ দিয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহন করে। ১৪ এপ্রিল পাকিস্তানিরা হেলিকপ্টার গানশীপ, নেভাল গানবোট ও এফ- ৮৬ বিমান যোগে মুক্তিবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিরক্ষা অবস্থানের উপর ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। গঙ্গাসাগর প্রতিরক্ষা অবস্থানের দরুইন গ্রামে নিয়োজিত আলফা কোম্পানির ২নং প্লাটুনের একজন সেকশন কমান্ডার ছিলেন মোস্তফা কামাল। পাকিস্তানি আক্রমণে প্লাটুনটির সমস্ত রেশন ধ্বংস হয়ে যায়। নতুন করে কোন রেশন না পাওয়ায় দীর্ঘ সময় ধরে সবাই অভুক্ত অবস্থায় ছিলেন। এমন অবস্থায় মোস্তফা কামাল তার এলএমজি সাথে নিয়ে আখাউড়া রেল স্টেশনে মেজর শাফায়াত জামিলকে রেশনের জন্য অনুরোধ করেন। মেজর শাফায়াত জামিল তাদেরকে অনতিবিলম্বে প্রতিরক্ষা অবস্থানে যেতে নির্দেশ দেন এবং সেখানে রেশনের বন্দোবস্ত করেন। ১৭ এপ্রিল সকাল থেকে পাকিস্তানি বাহিনী প্লাটুন পজিশনের উপরে তীব্র গোলাবর্ষণ শুরু করে। এমন সময় মুষলধারে বৃষ্টিও শুরু হয়। প্রচন্ড আক্রমণের খবর পেয়ে মেজর শাফায়াত হাবিলদার মুনিরের নেতৃত্বে ডি কোম্পানির ১১নং প্লাটুন পাঠান অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করতে। সারাদিন যুদ্ধ চলে।

পরদিন ১৮ এপ্রিল সকালে বর্ষণমুখর পরিস্থিতিতে শত্রুরা দরুইন গ্রামের কাছে পৌছে যায়। মূল আক্রমণ আরম্ভ হয় বেলা ১২ টায় অবস্থানের পশ্চিম দিক থেকে। শত্রুর একটি দল প্রতিরক্ষা অবস্থানের পেছন দিক থেকে মুক্তিবাহিনীকে ঘিরে ফেলে। মুক্তিবাহিনী দরুইন গ্রাম থেকে আখাউড়া রেল স্টেশনের দিকে পশ্চাদপসরণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু নিরাপদে সেখান থেকে সরে আসতে হলে তাদের প্রয়োজন ছিলো নিরবিচ্ছিন্ন কাভারিং ফায়ার। সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল সহযোদ্ধাদের জানান তিনি নিজে এই কাভারিং ফায়ার করবেন এবং সবাইকে দ্রুত পিছু হটতে নির্দেশ দেন। সহযোদ্ধারা মোস্তফা কামালকেও পশ্চাদপসরণের অনুরোধ করেন। কিন্তু কর্তব্যর টানে মোস্তফা কামাল ছিলেন অবিচল। সহযোদ্ধাদের তিনি বললেন, তার প্রাণের তুলনায় সহযোদ্ধাদের প্রাণের মূল্য অধিক। সিপাহী মোস্তফা কামালের ক্রমাগত নিখুঁত ফায়ারে পাকিস্তানিদের প্রায় ২০/২৫ জন হতাহত হয় এবং তাদের সম্মুখ গতি মন্থর হয়ে পড়ে।মৃত্যু অবধারিত জেনেও আত্নসমর্পণ করা বা ভয় পাননি মোস্তফা কামাল। বরং প্রাণপণ শত্রুর উপর ঝাপিয়ে পড়েছেন বাঘের মতো। পাকিস্তানিরা মরিয়া হয়ে মোস্তফা কামালের অবস্থানের উপরে মেশিনগান এবং মর্টার সেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এরই এক পর্যায়ে মোস্তফা কামালের এলএমজি'র গুলি শেষ হয়ে যায়। এমন সময় হঠাৎ একটি গুলি এসে বিদ্ধ হয় মোস্তফা কামালের শরীরে। গুরুতর আহত হন তিনি। এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি সেনারা মোস্তফা কামালের ওপর চড়াও হয় এবং বেয়নেট দিয়ে নির্মমভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে। পরে গ্রামবাসীদের সহায়তায় দরুইন গ্রামে সমাহিত করা হয় তাকে। মোস্তফা কামালের নামানুসারে তার গ্রামের নাম মৌটুপীর নাম পরিবর্তন করে 'কামালনগর' রাখা হয়েছে।

মোস্তফা কামাল তার জীবন দিয়ে সহযোদ্ধাদের জীবন বাঁচিয়েছিলেন, চেষ্টা করেছিলেন দেশকে শত্রুমুক্ত করার। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান এবং অসীম সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা বীরত্বসূচক খেতাব 'বীরশ্রেষ্ঠ' প্রদান করে। বাংলার মানুষের গর্ব, অহংকার বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোস্তফা কামালের অবদান কোনদিন ভুলবেনা বাংলাদেশ।

(www.theoffnews.com - Bangladesh Muktijuddho)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours