রূদ্রাণী মিশ্র, লেখিকা ও কবি, কলকাতা:

১৭ অক্টোবর আন্তর্জাতিক ট্রমা দিবস (International Trauma Day).  আপনি বলতেই পারেন, ক‍্যালেন্ডারে তো কিছু না কিছু দিবস তো লেগেই আছে। এতে আর বলার কী আছে? না, বস্ এই দিনটি নিয়ে সত‍্যি সত‍্যি অনেক কিছু বলার আছে। ভাববার আছে। এই বিষয়টি নিয়ে আমরা যদি এখন থেকে চিন্তা ভাবনা না করি, তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম সুস্থ সমাজ গড়ার কথা ভাবতে পারবে না। একটি সুস্থ সমাজ মানে কিন্তু কেকের ক্রীম স্তরটি নয়। আর তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায়, যে একটি সমাজের পরিভাষা তাতে কতজন দিকপাল রয়েছেন। যেমনটা জাপান করছে। তাতেও কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য অবহেলিত রয়ে যাচ্ছে। তাই জাপান আত্মহত্যার তালিকায় প্রথম স্থান লাভ করেছে। আপনি কি এরকম একটা সমাজ চাইছেন? 

যাক, অনেক অন‍্য কথা হলো। এবার একটু দেখা যাক। ট্রমা কী? কেন হয়? কোথা থেকে জন্মায় ইত্যাদি। এখানে একটা কথা বলা জরুরি। বাঙলায়  ভয় বলে ইংরেজীর Fear আর Trauma কে এক পংক্তিতে আনা যাবে না। ভয় মানে হল, কিছু ভেবে নেওয়া। যাকে ইংরেজীতে বলা হয় Fight or Flight. কিন্তু ট্রমা হল মনে বসে যাওয়া এক বিভীষিকাময় স্মৃতি। আচ্ছা দুটির পার্থক্য বোঝাতে উদাহরণ দিয়ে বলতে চেষ্টা করছি। ধরা যাক আমার সাপের ভয় আছে। মানে হল, সাপ আমার সঙ্গে কি কি করতে পারে, আমি ভেবে নিলাম। এবার ধরা যাক আমি অ্যামাজনে ঘুরতে গেছি, অ্যানাকোন্ডা সাপের কবল থেকে কোনও ক্রমে বেরিয়ে আসতে পেরেছি। সেটা আমার কাছে ট্রমা বা বিভীষিকাময় স্মৃতি হয়ে উঠবে।

ট্রমার সংজ্ঞা গুগল থেকে পাওয়া যায়। Trauma is an emotional response to a terrible event like an accident rape or natural disaster. তাহলে বলা যেতে পারে যে বিভীষিকাময় স্মৃতি। তাহলে এটাও দেখতে হবে যে ট্রমা কত ধরনের হয়। ১) acute trauma (শুধুমাত্র একটি ঘটনার জন্য…) 

২) chronic trauma (গার্হস্থ্য হিংসা। এজন্যই আমি বলি ডিভোর্স খারাপ শব্দ নয়)

৩) complex trauma (যা বারবার ঘটায় সৃষ্টি হয়)

এছাড়া কিছু ধরনের ট্রমার কারণ আছে। যেমন

১) বুলিং

২) কমিউনিটি ভায়োলেন্স

৩) ডিজাস্টার

৪) ছোট বয়সের কোনও ট্রমা

৫) খুব কাছের সঙ্গীর হিংসাত্মক ব‍্যবহার

৬) মেডিকেল ট্রমা

৭) ফিজিক্যাল এ্যাবিউজ

৮) যুদ্ধ

৯) প্রাকৃতিক ধ্বংস লীলা

১০) কিডন‍্যাপ

১১) টেররিস্ট কাজ

এই যে এত ধরনের ট্রমা আছে। জানেন এদের থেকে কি কি শারীরিক অসুস্থতা হতে পারে। হ‍্যাঁ আশ্চর্য হলেও ঠিক পড়েছেন। ট্রমা থেকে অনেক অসুস্থতাও তৈরি হতে পারে। যেমন,

১) বুকে ব‍্যথা

২) শুকনো ঠোঁট

৩) বমি বমি ভাব

৪) বুক ধড়ফড় করা

৫) ঘেমে যাওয়া

৭) কাঁপতে থাকা

৮) পেটের সমস্যা। (এটি কিন্তু আমার স্বচক্ষে দেখা একটি অভিজ্ঞতা আছে। আমরা তখন বেহালা থাকতাম। পাশের বাড়ির বাচ্ছাটি সবসময় পেটের অসুখে ভুগতো। তাদের বাড়িতে বাচ্ছাটিকে সবসময় রীতিমতো নানা রকম মানসিক চাপের মধ্যে রাখা হতো।)

৯)সবসময় ক্লান্ত

১০) মাথা ব‍্যথা

এতো গেল ট্রমার ভূমিকা। ট্রমার শিকার ৫০ শতাংশ লোকজন নিজে নিজেই ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। কান্না অনেক সময় ট্রমা কম করতে সাহায্য করে। তবে আমি এমন মাকেও দেখেছি, যিনি বাচ্চা কাঁদলে মারতেন। কি নৃশংস, না? যারা ট্রমা থেকে নিজে নিজেই বেরিয়ে আসতে পারেন না, সেক্ষেত্রে তাদের চিকিৎসার মাধ্যমে বের করে আনতে হয়। নয়তো তা আরও গভীরে গিয়ে PTSD (post traumatic stress disorder)তে পরিণত হয়। যা ট্রমার আরও ভয়ঙ্কর জটিল ধাপ।

এতো গেল নানা রকম ট্রমার গল্প। এবার খুব সাধারণ চিত্র, যা আমাদের অনেকের চোখের সামনে ঘটে থাকে। যা একপ্রকার ট্রমার চিত্র। তা নিয়ে দুটো কথা বলছি। যেমন অনেক মায়েরা মনে করেন যে বাচ্চাদের কথা শোনানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে, বেত্রাঘাত। বাচ্চাটি কথা শুনছে না যখন, তখন তাকে মেরে বা জুজুর ভয় দেখিয়ে তাকে দিয়ে কাজটা হাসিল করা যেতেই পারে। কারণ তার হিতার্থে এই মারপিট বা ভয় দেখানো। এটা একটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। আপনার থেকে খাওয়া মার বাচ্চাটির ট্রমা হতে পারে। আপনার দেখানো জুজুর ভয় বাচ্চাটির প্রাণহানির কারণ ঘটতে পারে (এরকম ঘটনা ঘটেছে)। এখানে আরেকটি কথা না বলে থাকতে পারছি না। সেদিন আমার এক বন্ধু থেকে শুনলাম, কোনও এক বিশাল নামকরা মনোবিদ নাকি বলেছেন, আপনার ছেলে যখন কথা শুনছে না, তাকে আড়ং ধোলাই দিয়ে কথা শোনান। আপনারা চিন্তা করতে পারছেন, কতটা অশিক্ষিত হলে একজন মনোবিদ হয়ে একথা বলতে পারেন? (আমি মনে করি না, আপনার শংসাপত্র আপনার শিক্ষার মাপকাঠি)। যে শিশু আপনাকে আশ্রয় করে বড় হচ্ছে। যার সবকিছু আপনাকে জুড়ে, তার কাছে চেঙ্গিস খাঁ হয়ে আপনি কৃতিত্ব লাভ করতে চাইছেন? কি ভয়ঙ্কর চিত্র! শিশুটি তো তার জীবনে চলার শুরুতেই নিজেকে একাকী মনে করবে। হ‍্যাঁ জানি, আপনি তর্ক করবেন, প্রমাণ দেবেন। সে আপনাকে কতটা ভালবাসে। একটু চিন্তা করুন তো। সে যদি আরেকটি আশ্রয় পেত, যেখানে তাকে নির্যাতন সহ‍্য করতে হয় না। তাহলেও কি আপনাকে ততটাই ভালবাসত? জানেন তো, আমরা মা বাবা হয়ে কি মনে করি। আমি যখন শিশুটির মা, বাবা, আমি তার সঙ্গে যা ব‍্যবহার করছি। সব ঠিক। না। একদম ভুল ভাবছেন, আপনি। আপনার খারাপ ব‍্যবহার শিশুটিকে যদি ট্রমাটাইজ করে। তাহলে আপনি যা করছেন, পুরোটাই ভুল। আজ যে শান্ত শিষ্ট ভদ্র মানুষ আছেন। তিনি যদি এই ট্রমার অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ হন। তাহলে তিনি পুরো বদলে যেতে পারেন। আচ্ছা বলছি, ট্রমার জন্য চরিত্রে কি কি বদল আসতে পারে। 

১) denial 2) anger 3) fear 4) sadness 5) shame 6) confusion 7) anxiety 8) depression 9) numbness 10) guilt 11) hopelessness 12) irritability 13) difficulty concentration  

এগুলো হলো ট্রমা আক্রান্ত ব‍্যক্তির আবেগের বহিঃপ্রকাশ। 

আপনি যদি কখনও কাউকে ট্রমা আক্রান্ত মানুষ খুঁজে পান। তাহলে পারলে তাকে একটু মানসিক ভাবে সাপোর্ট দিন। আর কাউকে ট্রমাটাইজ করার আগে, একটু ভাবুন, এটা কি একজন মানুষের কাজ? আমার তো কমপক্ষে চেষ্টা করতে পারি, একটি সুন্দর সমাজ গড়ে তোলার। তাই না?

(www.theoffnews.com - trauma)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours