শক্তিপদ মাইতি, ফিচার রাইটার, কলকাতা:

মানুষ ঘরমুখো হতেই দূরে সরে গেল বিষাক্ত বাতাস। ঝলমলে নীল আকাশটা উঁকি দিল খোলা জানালার ফাঁক দিয়ে। মানুষ ঘরমুখো হতেই রাস্তার ধারের গুল্মলতার কচিপাতাগুলো ঝেড়ে ফেলল ধুলোবালির কালচে আস্তরণ। হাসি মুখে সবুজ পাতাগুলো তাকিয়ে আছে নীল আকাশে দিকে। আর সারাটা দিন উজ্জ্বল আলো উপভোগ করে বেশি বেশি অক্সিজেন ফিরিয়ে দিল বাতাসে। মানুষ ঘরমুখো হতেই গাছের কুঁড়ি ফুলগুলি আর শুকিয়ে পচছে না পাথরের গায়ে, পরিনত হল ফলে। নতুন চারাগাছ জন্ম নেবে একটু বর্ষা পেলে। প্রজাপতি, মৌমাছি ফুলে ফুলে মধু খায় আর গুনগুন গান গায়। উড়ে বেড়ায় আপন সুখে। মানুষ ঘরমুখো হতেই জঙ্গলের মধ্যে বিকট বন্দুকের আওয়াজ শোনা গেল না আর। বন্য প্রাণীরা নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ায় যত্রতত্র। এমনকি শহরের রাজপথে দিবালোকে হেঁটে বেড়ায় ভাম, বেইজি, শেয়াল আরও কতকি। ভয় নেই কারো আজ।

মানুষ ঘরমুখো হতেই Fossil fuel তো বেঁচে গেল আরও কিছু দিনের জন্য। গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আসবে অদূরেই - প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা খুব আশাবাদী। পৃথিবীর উষ্ণতার পারদ ক্রমশ নিম্নগামী আর দক্ষিণ মেরুর বরফ গলা কমে গেল বেশ কিছুটা।

শুধু কি তাই?

মানুষ ঘরমুখো হতেই আজ রাস্তায় নেই কোন জঞ্জাল। আবর্জনার স্তুপের দুর্গন্ধ নেই কোন অলিতে গলিতে। ঝকঝকে শহর আর নির্মল গ্রাম উপহার দেবে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ। মানুষ ঘরমুখো হতেই পরিযায়ী পাখিরা ফিরে এল আপন ঘরে। নির্ভয়ের সংসারে জন্ম নেবে নতুন অতিথি।

মানুষ ঘরমুখো হতেই উৎসবের উচ্ছিষ্ট, থার্মোকলের থালা, বোতল, প্লাস্টিক ভাসল না নদীর জলে। মা গঙ্গা রূপ পেল নদী গঙ্গায়। না, কোনো সমস্যা নেই। পানকৌড়ি, মাছরাঙা সহজেই ঝাঁপ দিতে পারে নদীর জলে। মানুষ ঘরমুখো হতেই উপকূলে সমুদ্রের জলে ফিরে পেল স্বাভাবিক স্বচ্ছতা। নীল তিমি, ডলফিন ফিরে এল নিজের আস্তানায়। আপন মনে গড়বে আবার ভালোবাসার সংসার। 

মানুষ ঘরমুখো হতেই, আকাশ পথ আজ সম্পূর্ণ উন্মুক্ত। শঙ্খচিল, শকুন আর ঈগলেরা খুশি মনে উড়ে বেড়ায় দূর আকাশের সীমানায়। নেই কোনো আপদ, নেই কোনো আশঙ্কা। আকাশটা খান খান করার সত্যিই কেউ নেই আজ।

মানুষ ঘরমুখো হতেই রাজনীতিক হানাহানি, মারামারি কিছুটা তো কমেছে। মানুষ প্রকৃত ঘরমুখো হলেই থেমে যাবে সীমান্ত যুদ্ধ। অচিরেই নিভে যাবে হিংসার আগুন, অনেকটাই আশাবাদী সাধারণ মানুষ।

মানুষ ঘরমুখো হতেই, পৃথিবীটা দেখা দিল এক নতুন রূপে। সকল জীবজন্তু, পশুপাখি, কীট পতঙ্গ-সবাই সর্বোপরি প্রকৃতিও ফিরে এল স্বাভাবিক ছন্দে।

আর মানুষ?

ছন্দ পতন হয়েছিল মানুষের। মানুষেরাই কেবল গৃহবন্দি ছিল কয়েকটা মাস। ব্যক্তি জীবন, কর্ম জীবন থেকে সমাজ জীবনে সর্বত্রই সংকট। সময়ের নিরাময়ে ধীরে ধীরে জন জীবন ফিরছে স্বাভাবিক ছন্দে। সকল আঁধার ঘুচিয়ে আবার ঘরে ঘরে ফিরে আসবে আলো, ঘরে ফিরে আসবে উৎসবের অফুরান আনন্দ। ফিরে আসবে জনজীবনে খুশির জোয়ার। ভালোবাসার উষ্ণতা বাড়বে। কিন্তু জ্বর আসবে না একটি বারও।

তারপর?

তারপর মানুষের জীবন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসবে। হয়তো বা একটু সময় লাগবে। তারপর শুরু হবে জীবনের তৎপরতা। স্বাভাবিক ভাবেই ধসে পড়া অর্থনীতি চাঙ্গা করতে কারখানার চিমনি তিন গুনা দাউ দাউ করে জ্বলবে। স্বাভাবিক ভাবেই অ্যাপ ক্যাব ছাড়া একটি পাও হাঁটব না আমরা। স্বাভাবিক ভাবেই বড় লোকের বেপরোয়া গাড়ী ভ্যঁস্ ভ্যঁস্ করে ধোঁয়া ছেড়ে কালো করে দেবে রাস্তার ঘুমিয়ে থাকা নেড়ি কুত্তার মুখ। স্বাভাবিক ভাবেই জঞ্জাল ভরে যাবে গ্রাম শহরের রাস্তায়। স্বাভাবিক ভাবেই পলিথিনের ব্যাগ, গেরস্থের আবর্জনা আটকে দেবে নালা নর্দমার মুখ। স্বাভাবিক ভাবেই বেশি লাভের আশায় কৃষি জমিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার বেড়ে যাবে বহু গুন। উচ্চ ফলনশীল ফসলের আশায় জিনে জিনে শঙ্করায়ণ ঘটিয়ে যাব আমরণ। স্বাভাবিক ভাবেই নতুন নতুন নগর গড়তে বন জঙ্গল উজাড় করতে লেগে পড়ব আমরা সবাই। স্বাভাবিক ভাবেই আকাশটা খান খান করবে কত না যান। স্বাভাবিক ভাবেই স্যাটেলাইটের জঞ্জাল ঘিরে ধরবে পৃথিবীর পরিমণ্ডল। 

তারপর আমরা ক্রমে ক্রমে 4G, 5G, 6G, 7G করে এগিয়ে যাব ভবিষ্যতের লক্ষ্যে। 

কোন লক্ষ্যে? জানা নেই কারোর।

কিন্তু আমাদের সব সুবিধাই চাই। স্মার্ট ফোন সোয়াইপ করেই কিনতে চাই সতেজ সবজি। একটা ফোন কলেই নিজের পছন্দ মতো সুস্বাদু খাবার ডাইনিং টেবিলে আসা চাই। ড্রয়িং রুমে বসেই সব কিছু পেতে চাই। আমরা সব কিছু উপভোগ করব প্রয়োজন চেয়ে অনেক বেশি।

তারপর ? 

শেষমেশ পশুপাখি, জীবজন্তু, প্রকৃতি ফিরে আসবে সেই বিষন্ন ভবিষ্যতে। ওরা হয়তো অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করবে আরও একটা লকডাউনের জন্য। তবু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়।

এ বিশ্ব চরাচরে কারোর জন্য কিছুই ভাবতে হবে না, শুধু নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে মানুষ কোনো দিনই কি স্বেচ্ছায় লকডাউন মানতে পারে?

(www.theoffnews.com - lockdown)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours