পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

“সে যে কি অত্যাচার স্যার, বলে বোঝাতে পারব না। চারিদিকে শুধু মিলিটারি, সিআরপিএফ, পুলিশ। একসঙ্গে দুজনকে দেখলেই তেড়ে যাচ্ছে। ফোন, ইন্টারনেট বন্ধ। আত্মীয় পরিজনেদের সঙ্গে যোগাযোগের কোনও উপায় নেই। সন্ধ্যে সাতটার পরে রাস্তায় দেখলেই চলছে অমানুষিক মার। খুব কষ্টে দিন কাটিয়েছি স্যার।“ কথাগুলো আফতাবের। বলতে বলতে এক নিদারুণ যন্ত্রণায় কঠিন হয়ে উঠছিল ওর মুখ। শ্রীনগরে ডাল লেকের ধারে যে হাউজবোটটিতে ছিলাম তারই কর্মী আফতাব। অতি ভদ্র, নম্র স্বভাবের একটি ছেলে, দুদিনের একটি মুহুর্তেও ওকে আমি উচ্চস্বরে কথা বলতে শুনিনি। বয়স কত হবে মেরেকেটে কুড়ি একুশ। ওর বাড়ি অবশ্য শ্রীনগরে নয়, গুলমার্গ যেতে টানমার্গ বলে একটি গ্রাম আছে সেখানেই ওর ঘর। ইকনমিক্স নিয়ে এমএ পড়তে এসেছে শহরে, হাউজবোটে চাকরিটা ওর শহরে থাকার অবলম্বন। ৩৭০ ধারা তোলার পরে শুধু আফতাব নয় গোটা কাশ্মীরীদের জীবনটাই এমন দুঃসহ হয়ে উঠেছিল। এর পরে আসে কোভিড। ভেঙে দেয় ধুকতে থাকা মানুষগুলির শিরদাঁড়া। 

বেশ কয়েক বছর পর এ বছর থেকে কাশ্মীরে ফের পর্যটকের ঢল নেমেছে। তার প্রায় সিংহ ভাগই বাঙালি। একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে কাশ্মীরের পর্যটন, ঘুরে দাঁড়াচ্ছে অর্থনীতি। তার কাঁধে ভর দিয়ে বাঁচার আশা খুঁজছেন স্থানীয় মানুষজন। এরই মাঝে চোরা গোপ্তা আক্রমণ লেগেই আছে, আজ কাশ্মীরী পণ্ডিত খুন হচ্ছেন তো অন্যদিন পুলিশের কোনও বড় আধিকারিক। কিন্তু দিন পনেরো কাশ্মীরের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে আমার মনে হয়েছে এ সব কিছু ছাপিয়ে মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর ইচ্ছেটা ক্রমশ প্রবল হচ্ছে। দুঃখ কষ্টের ফল্গুধারাকে চেপে মুখে অনাবিল হাসি, কথায় কথায় আমাদের সম্মানীয় অতিথি বলে সম্বোধন। সেই অতিথির কাছে যেন কিছুতেই ঘরের কষ্ট বেরিয়ে না পড়ে তা ঢেকে রাখার চেষ্টা। সবই আছে, কিন্তু পাড়ায় পাড়ায়, মোড়ে মোড়ে সেনা বা আধা সেনার টহল মাঝে মাঝেই ব্যর্থ করে দিচ্ছে সেই ক্ষত ঢাকার চেষ্টাকে।

শুধু কি আফতাব? এই কদিনে যার যার সঙ্গে কথা বলেছি তারা কেউই কেন্দ্রীয় সরকারে পক্ষে কথা বলেনি। মোদির ঘোরতর বিরোধী অধিকাংশই। সেনা বা আধা সেনার বিরুদ্ধেও জমা ব্যাপক ঘৃণা। একই সঙ্গে প্রবল ক্ষোভ হিংসার কারিগরদের বিরুদ্ধেও। একটু সাহস পাচ্ছিলাম আফতাবের কথা শুনে, তার সাফ কথা, “অশিক্ষিতরাই হিংসা ছড়াচ্ছে স্যার, লেখাপড়া করতে চাওয়া আধুনিক ছেলেমেয়েরা কিন্তু এই হিংসা, বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে। তারা কাজ চায়, চায় এগিয়ে যেতে।“ আর এই এগোনোর পথেই বড় বাধা সরকার এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী দুই পক্ষই। সরকার শৃঙ্খলা রক্ষায় অতি কঠোর, আর অপর পক্ষ তাদের অন্ধ মতের দাবীতে হিংসার মানচিত্র এঁকে চলেছে। মাঝে পড়ে বিপর্যস্ত আম কাশ্মীরী। কিছু হলেই দিনের পর দিন বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট, স্কুল। বনধ পড়াশোনা, আফতাবেরই দুটি বছর নষ্ট হয়েছে এভাবেই। হিংসা দমনের নামে চলে সরকারী পীড়ন, যার অধিকাংশটাই ভুগতে হয় সাধারণ মানুষকে। 

হাউজবোটের মালিক হোক বা আমাদের থাকার তিন তারা হোটেলের মালিক। স্থানীয় মুদি দোকান চালানো মানুষ থেকে ফুটপাথে শাল বিক্রেতা, সকলেই দেখলাম একটা বিষয়ে একমত আমরা বাংলায় সেরা মুখ্যমন্ত্রী পেয়েছি। সকলেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফ্যান। বাংলা বা দেশের অন্য কোথাও গিয়ে দেখেছি মমতার নাম কমবেশি সকলেই জানেন, কিন্তু অনুভূতিটা মিশ্র। কিন্তু কাশ্মীরে মমতা বেজায় হিট। পহলগাওতে যে রিসোর্টে ছিলাম তার মালিক স্থানীয় পুরসভার কর্মী। তিনি তো বলেই বসলেন কাশ্মীরেও এমন একজন মুখ্যমন্ত্রীর খুব দরকার। বাজারে মুড়ি খুঁজতে গিয়ে শুনলাম আমরা অতি ভাগ্যবান, যে এমন মুখ্যমন্ত্রী পেয়েছি। ইউস মার্গের ঘোড়া চালক তো আমায় বেজায় সুখী করে দিলেন মমতার রাজ্যে থাকি বলে। কি ভাবছেন? তৃণমূলের জয়গান করছি? মোটেই না, এরা কিন্তু অধিকাংশই তৃণমূলের নাম শোনেনি। শুধুমাত্র মোদি বিরোধী হিসেবে মমতার নামই এখানে প্রধান। তার উপরে যোগ হয়েছে মমতার রাজ্যে মুসলিমদের ভাল থাকার প্রচার। সরকারি হিসাব যাই বলুক কাশ্মীরে প্রায় অধিকাংশ মানুষই মুসলিম। তার মধ্যে অসংখ্য মানুষ আমাদের রাজ্যে আসেন ফি বছর শাল, সোয়েটার, কম্বল এসব বিক্রির জন্য। দীর্ঘদিন ধরে আসা যাওয়ার সুবাদে এদের একটা বড় অংশ এই রাজ্যেরও বাসিন্দা হয়ে গিয়েছেন। তাদের কাছ থেকে শুনে এবং সংবাদ মাধ্যমে দেখে কাশ্মীরবাসী মুসলিমদের মনে হয়েছে এই রাজ্য তাদের জন্য সহানুভূতিশীল। মোদির প্রতি তারা মোটেই আস্থাশীল নয়, আমি থাকাকালীনই অমিত শাহ কাশ্মীর গিয়ে স্থানীয় মুসলিমদের উন্নয়নে নানা প্রকল্পের ঘোষণা করেছেন। কিন্তু সাধারণ কাশ্মীরীরা সেই সব ঘোষণাকে খুব একটা পাত্তা দিতে রাজি নন, এমনকি শাহের সফর নিয়েও তারা খুবই বিরক্ত।

এবারে আসি মূল কথায়, তৃণমূল এ রাজ্য ছাড়িয়ে অন্য রাজ্যে তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। পাশের কয়েকটি রাজ্য ছাড়াও সুদূর গোয়ায় গিয়ে খুব লড়বার চেষ্টা করেছিল তারা, সফলতা আসেনি। কিন্তু ভূস্বর্গেও যে তাদের জন্য সহানুভূতির বরফ জমে আছে, সেটা বোধহয় এখনও দিদির কর্ণগোচর হয়নি। কাশ্মীরের আনাচে কানাচে দিদির ফ্যানেরা লুকিয়ে রয়েছে, একটু উঁকি দিলেই কিন্তু তারা টুকি বলবে। তাহলে এবার একটু ভূস্বর্গ অভিযান হবে না কি দিদি? একটা চেষ্টা করা যেতেই পারে বোধহয়। দুহাজার কিলোমিটার পথ পেরিয়ে বাংলার নেতা মন্ত্রীদের দুর্নীতির দুর্গন্ধ এখনও বোধহয় পৌছয়নি ভূস্বর্গের মাটিতে। অনুপ্রেরণার আঁচ পেয়ে উষ্ণ হোক শীতল দেশের মানুষগুলি।

(www.theoffnews.com - Kashmir Mamata Banerjee)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours