কাজী নূর, কবি, সাহিত্যিক ও ফিচার রাইটার, বাংলাদেশ:

আমাদের সোনার বাংলার রুদ্র অর্থাৎ রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। রুদ্রকে বলা হয় 'কবিতার রাজপুত্র'। রুদ্র শুধুমাত্র একজন কবি তা নয়। রুদ্র একটি গল্পের নাম, রুদ্র একটি যুগ, একটি অধ্যায়, একটি প্রতিষ্ঠান, একটি জ্বলন্ত ইতিহাস। বাংলা সাহিত্যে দ্রোহ- প্রেম, সংগ্রাম ও তারুণ্যের দীপ্ত প্রতীক কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। রুদ্র ছিলেন কঠোর সাম্যবাদ, স্বদেশপ্রেমের চেতনা ও দেশাত্মবোধ, মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ একটি বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। রুদ্র চেয়েছিলেন লেখনীর মাধ্যমে ঘুণে ধরা জীর্ণ সমাজকে বদলে দিতে। চেয়েছিলেন বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে। আমাদের রুদ্র শুধুমাত্র খ্যাতিমান কবিই ছিলেন  না। রুদ্র ছিলেন স্বনামধন্য আবৃত্তিকার, গীতিকার এবং সুরকার। প্রায় অর্ধশতাধিক গান রচনা ও সুরারোপ করেছেন তিনি। এছাড়া 'জাতীয় কবিতা পরিষদ'এর প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক, 'সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট'এর প্রথম আহ্বায়ক কমিটির সদস্য এবং 'বাংলাদেশ সংগীত পরিষদ'এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও প্রকাশনা সচিব ছিলেন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ।

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে বলা হয় আগাগোড়া কবি। বাংলা কবিতার উজ্জল নক্ষত্র রুদ্র শুধুমাত্র কবিতা লিখতেন না, তিনি কবিতার ভেতরে যাপন করতেন। রুদ্রের কবিতায় যেমন ছিল গণমানুষের প্রতি মমত্ব, মানবতার গান, গণমুক্তির পথ তেমনি ছিল প্রেম বেদনা। কবি হিসেবে রুদ্র রোমান্টিকতার অহংকার। রুদ্রের কালজয়ী একটি কবিতা পরবর্তীতে সর্বাধিক জনপ্রিয় বাংলা গান 'আমার ভিতরে বাহিরে অন্তরে অন্তরে’ কবিকে অমরত্ব এনে দেয়, রুদ্রকে নিয়ে যায় অনন্য এক উচ্চতায়। বাংলাদেশ এবং ভারতের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে এই গানটি যেমন জনপ্রিয়, তেমনি বেশ আলোচিত। গানটি আজও সাধারণ মানুষের মুখেমুখে ফেরে।

১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয় রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ'র প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উপদ্রুত উপকূলে’। প্রথম কাব্যগ্রন্থে তার বিখ্যাত কবিতা 'বাতাসে লাশের গন্ধ’ অন্তর্ভুক্ত হয়। এরপর ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম’। তারপর একে একে প্রকাশিত হয় মানুষের মানচিত্র, ছোবল, গল্প, দিয়েছিলে সকল আকাশ, মৌলিক মুখোশ’  ও  নাট্যকাব্য  ‘বিষ বিরিক্ষের বীজ’ প্রভৃতি। ভীষণ এক খামখেয়ালি জীবন যাপন করতেন কবি রুদ্র। মুক্ত বিহঙ্গের মতো ডানা মেলে এখানে ওখানে ঘুরতেন। নিখাদ ভবঘুরের মতো ছিলেন রুদ্র। চাকরির প্রাতিষ্ঠানিকতায় নিজেকে কখনও বাঁধেননি। কয়েকটা রিকশা কিনে ভাড়া দেওয়া ছিল। রোজ ভাড়া থেকে যা আয় হতো, তাতেই কোনরকম চলতেন রুদ্র। ঠিকাদারি ব্যবসা করেছেন, চিংড়ি মাছের খামার করেছেন। কিন্তু কবিতা ছাড়া জীবনে কোথাও সফলতা পাননি রুদ্র। অতি মাত্রায় মদের প্রীতি ছিল তার। যে কারনে প্রতি সন্ধ্যায় হাটখোলার নন্দের দোকানে হাজিরা দিতেই হতো রুদ্রকে। রুদ্র হুইস্কির বাংলা নাম রেখেছিলেন 'সোনালী শিশির'।

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ১৯৮১ সালে তার পরিবারের অমতে লিমা নাসরিন নামে এক এমবিবিএস ডিগ্রিধারী চিকিৎসকের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। রুদ্র ও লিমার পরিচয় হয় লেখালেখির সূত্র ধরে। প্রথম পরিচয়ে প্রণয়। অতঃপর তা চুড়ান্ত রূপ নেয় বিয়ের পিঁড়িতে। রুদ্রের স্ত্রী চিকিৎসক লিমা নাসরিন পরবর্তীকালে তসলিমা নাসরিন নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন এবং নিজের বিতর্কিত লেখালেখির জন্য ব্যাপক আলোচিত সমালোচিত এবং লোকসমাজে ব্যাপক হেনস্থার শিকার হন। রুদ্র ও তসলিমার দাম্পত্য প্রণয় বেশ ভালোই কাটছিল। সরাসরি রুদ্রের উৎসাহে তসলিমা পুরোপুরি জড়িয়ে যান লেখালেখির সঙ্গে। যদিও রুদ্র এবং তসলিমার এই দাম্পত্য জীবন দীর্ঘ হয়নি। ১৯৮৬ সালে তাদের উভয় সম্মতিতে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটার পর রুদ্র ভীষণ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। এবার যেন আগের চেয়ে আরও বেশি বেপরোয়া জীবনযাপন। নিজের প্রতি প্রচন্ড রকমের অত্যাচার শুরু করেন রুদ্র। প্রচুর ধূমপান, মদ্যপান খাবারে অনিয়ম সব মিলিয়ে ফলাফল পাকস্থলীতে আলসার সহ নানা রোগ ধরা পড়ে তার। রুদ্র অবশ্য শারীরিক অসুস্থতাকে কখনও গুরুত্ব দিতেন না। অসুস্থ অবস্থাতেই ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন সাহিত্য সভায় কবিতা পড়তে গেছেন।

প্রতিভাবান ক্ষণজন্মা কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ১৯৯১ সালের ২১ জুন আকাশ ভরা মেঘ অভিমান নিয়ে চলে যান না ফেরার দেশে। জীবনের অনেক গল্প, বিদ্রোহের কবিতা, অমোঘ প্রেমের কবিতা, করে গেছেন ঋণী, বেঁধে গেছেন অমোঘ চিরায়ত এক মায়ার জ্বালে। মৃত্যু মানেই যে হারিয়ে যাওয়া নয় তা রুদ্র নিজেই লিখে গেছেন তার লেখনিতে...

‘চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয় বিচ্ছেদ নয়

চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন করা আর্দ্র রজনী

চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে আমার না থাকা জুড়ে'।

আজ ১৬ অক্টোবর, প্রাণের কবি, প্রিয় কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ'র জন্মদিন। ১৯৫৬ সালের এই দিনে বরিশালের রেডক্রস হাসপাতালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তবে রুদ্রের শৈশব কেটেছে বাগেরহাট জেলার মংলার মিঠেখালি গ্রামে। সুন্দরবনের কাছাকাছি থাকলেও সবাই কিন্তু বাঘ হয় না। কিন্তু রুদ্র ছিলেন বাঘের চেয়েও শক্তিমান একজন কবি। তাই হয়তো তিনি কবিতার রাজপুত্র হতে পেরেছেন। রুদ্রের জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা।

(www.theoffnews.com - poet Rudra Muhammad Saifullah Bangladesh)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours