চন্দ্রিমা দত্ত (সাঁজবাতি), লেখিকা ও শিক্ষিকা, শ্রীরামপুর, হুগলি:

অপর্ণা সেনের কথা লিখতে বসে যে কথাটা সর্বপ্রথম মনে আসে - তা হলো - অপর্ণা সেন- একজন একশো বছর এগিয়ে থাকা মানুষের নাম। এই ক্ষয়ে যাওয়া আধুনিকতার ধ্বজাধারী সমাজ যখন পোশাকে আর বাতেলার হাওয়াবাজি করে করে নিজের বুদবুদ সমান আধুনিকতা বহন করে আত্মশ্লাঘা আর সন্তুষ্টি নিয়ে কমপ্লেক্সে ভোগে এবং সেই কমপ্লেক্স কখনো ইনফিরিওরিটি কখনো সুপিরিওরিটির অন্ধকার -- তখন অপর্ণা সেনের সৃষ্টিগুলি একটা খোলা বড় জানলা দিয়ে নিঃশ্বাস নেবার মতো বাতাস ও দৃষ্টিকোণে আলোকপাত করে যায় - যা আগে খুব কম মানুষই ভেবেছেন! 

ভাবুন তো 'পরমা' সিনেমাটির কথা! ওটা যে সময় রিলিজ হয়েছিল...সেই সময় তা দেখা বা বোঝবার বয়স আমার ছিল না! কিন্তু বড় হয়ে বারবার দেখেছি! পরমার (রাখি গুলজার) মিডিল্ এজ ক্রাইসিস এবং একটি গৃহবধূকে ঘানি টানবার জন্য বা তথাকথিত 'ভালো'র মোড়কে ঠুসে রাখবার জন্য যতটা ভুয়ো প্রশংসার খাঁচায় বন্দী করে তার স্বপ্নের সমাধি সৌধ নির্মাণ করা হয়--তার কি আশ্চর্য বর্ণনা ওই কয়েক ঘন্টায় তিনি যে সময়ে দেখিয়েছেন - তা আজকে এসে খানিকটা উপলব্ধি করা যায়! 

ব্যক্তিগত ভাবে বলি, প্রত্যেকটি মানুষের একটি বা দুটি গর্বের জায়গা থাকে - আমার তালিকাটি সৌভাগ্যবশত একটু বড় এবং সেই তালিকার প্রথম নামটি অপর্ণা সেনের অর্থাৎ রীণা মাসির। তাঁর সম্পর্কে যা যা তথ্য লিখছি তা নব্বই শতাংশ মানুষের জানা, যেটা অজানা বা অদেখা দিতে পারলাম, সেটা পারিবারিক ছবি - যেমন এর আগে ওনার পিতা শ্রী চিদানন্দ দাশগুপ্তকে নিয়ে লেখা ফিচারে দিয়েছিলাম।

অপর্ণা সেন, কলকাতার এক বিখ্যাত বৈদ্য, ব্রাহ্ম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ২৫শে অক্টোবর ১৯৪৫ সালে। তাঁর পরিবার পূর্ববঙ্গের বরিশাল থেকে এসেছিলেন। পিতা - বিখ্যাত চলচ্চিত্র সমালোচক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা শ্রী চিদানন্দ দাশগুপ্ত, মাতা কবি জীবনানন্দ দাশের দাদা শ্রী ব্রহ্মানন্দ দাসের কন্যা সুপ্রিয়া দাশ। অপর্ণা সেন বিবাহ করেন ব্যারিষ্টার সঞ্জয় সেনকে এবং তাঁদের কন্যা কমলিনী। সঞ্জয় সেনকে হারানোর পর তিনি বিবাহ করেন মুকুল শর্মাকে ও তাঁদেরই কন্যা অভিনেত্রী কঙ্কনা সেন শর্মা। অপর্ণা সেনের বর্তমান স্বামী - ইন্ডিয়ান আমেরিকান লেখক কল্যাণ রায়। 

তাঁর শৈশব অতিবাহিত হয়েছিল হাজারিবাগ ও কলকাতায়। কলকাতার মডার্ণ হাই স্কুল ফর গার্লস এ লেখাপড়া শুরু করে প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজি অনার্স পড়েছিলেন। 

১৯৬১ সালে পিতৃবন্ধু সত্যজিৎ রায়ের 'তিন কন্যা' সিনেমায় অভিনয় করে অভিনয় জগতে প্রথম পদার্পণ করেন। ১৯৬৯ সালের পর যথাক্রমে 'অপরিচিত' ও 'অরণ্যের দিনরাত্রি' সিনেমায় অভিনয় করে নিজের অসামান্য অভিনয় - দক্ষতার প্রকাশ ঘটান এবং বাংলা চলচ্চিত্রের একজন প্রথম সারির নায়িকা হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন।

১৯৮১ সালের পর থেকে অভিনয়ের পাশাপাশি সিনেমা পরিচালনাতেও যোগ্যতার সঙ্গে আগ্রহী হয়ে ওঠেন । তাঁর পরিচালিত প্রথম সিনেমা '36 চৌরঙ্গী লেন '। এই সিনেমাটির জন্য তিনি জাতীয় পুরস্কার পান শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে। তারপর আসে সতী, পরমা, পারমিতার একদিন, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার, ১৫ পার্ক অ্যাভিনিউ, দি জাপানিজ ওয়াইফ, গয়নার বাক্স ইত্যাদি ইত্যাদি। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার এর জন্য দ্বিতীয় বার শ্রেষ্ঠ পরিচালকের জাতীয় পুরস্কার পান। 

তাঁর অভিনীত কিছু সিনেমার নাম আমি দিয়ে দিচ্ছি যদিও সে তালিকা খুবই দীর্ঘ! যেমন - তিনকন্যা, মেমসাহেব, আকাশ কুসুম, বসন্ত বিলাপ, অরণ্যের দিনরাত্রি, জীবন সৈকতে, নায়িকার ভূমিকায়, রাতের রজনীগন্ধা, যদুবংশ, ইতি মৃণালিনী, চতুষ্কোণ, তিতলি, অন্তহীন ইত্যাদি ইত্যাদি।

তাঁর প্রাপ্ত পুরস্কার গুলি হলো - ১৯৮৭ তে পদ্মশ্রী, ১৯৭০ এ বি এফ জে। শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে পুরস্কার পান- সুজাতা (১৯৭৫), একান্ত আপন (১৯৮৮), মহাপৃথিবী (১৯৯২), শ্বেত পাথরের থালা (১৯৯৩), অভিশপ্ত প্রেম (১৯৯৭), পারমিতার একদিন (২০০১)। ২০০২ সালে শ্রেষ্ঠ নামকরণের জন্য আনন্দলোক পুরস্কার পান, ১৯৯৩ তে নাট্যমঞ্চের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে পান কলাকার পুরস্কার। ২০১৩ তে লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কারে সম্মানিত হন। 

আপনারা ভেবে দেখবেন - তাঁর এ বিশাল কর্মজীবনের কথা কয়েকটা বাক্যে উল্লেখ করা আমার পক্ষে কতটা দুঃসাধ্য ও স্পর্ধার কাজ! কিন্তু ভালবাসা থেকে বোধহয় সবকিছু করা যায়! 

আনন্দের সাথে একটা পারিবারিক ছবি দিয়ে দিলাম লেখার সাথে । ছবিতে রীণা মাসি এবং তাঁর সাথে তাঁর একমাত্র পিসি মীরা দাশগুপ্ত (দত্তরায় ) ও একমাত্র ভাই স্বর্গীয় সুশোভন দত্তরায়ের কন্যা অবতীর্ণা (ভাইঝি)।

(ছবি সৌজন্যে প্রতিবেদক স্বয়ং)

(www.theoffnews.com - Aparna Sen)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours