তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

হ্যাপি নিউ ইয়ার’ বলে তো নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানান সকলে। কিন্তু জানেন কি, বর্ষবরণের ইতিহাস কত প্রাচীন? এই রীতি অন্তত খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ বছরের পুরনো। বর্ষবরণকে ঘিরে নানা দেশে রাত বারোটা বাজলেও যে মজা উল্লাস, হই হুল্লোড়ে ফেটে পড়া যায়, নিউ ইয়ার সেলিব্রেশন না থাকলে এই গ্রহবাসী কি তা জানতে পারত? কিন্তু জানেন কি, নিউ ইয়ার নিয়েও অনেক কিছু জানার আছে।

যদি বলেন কবে থেকে নিউ ইয়ার সেলিব্রেশন শুরু তা হলে বলতে হবে, সেই দিন ক্ষণ তারিখ সময়, এক বাক্যে বলা সম্ভব নয়। মনে করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ থেকে এই বর্ষবরণের রীতি শুরু। তবে এ কথা ঠিক যে, ১ জানুয়ারিতেই নিউ ইয়ার হবে, এমনটা কিন্তু সব ক্ষেত্রে দেখা যায় না। যেমন জর্জিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নিউ ইয়ার হয় পয়লা মার্চ। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ অব্দে জুলিয়াস সিজারের আমলে প্রথম ১ জানুয়ারিকে নববর্ষের শুরু হিসেবে ধরা হয়। ইংল্যান্ডে এই রীতি চালু হয় অনেক পরে ১৭৫২-এর আশপাশে।

নতুন বছর, নতুন নতুন সব কিছু। ফলে সেলিব্রেশনের সঙ্গেই মিশে আছে উপহার দেওয়া-নেওয়া। রয়েছে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর বহু বিবিধ আচার-সংস্কার। যেমন অনেকে নিউ ইয়ারে একে অপরকে ডিম উপহার করেন। এই ডিম আগামীতে সু-উৎপাদনের প্রতীক। ট্র্যাডিশন সম্পর্কে বলতে গেলে অবশ্যই জানাতে হয় মলিবডোম্যান্সির কথা। নববর্ষে বহুকাল ধরে ফিনল্যান্ডের মানুষ এই বিশেষ রীতি পালন করে আসছে।

কী এই মলিবডোম্যান্সি?

ফিনল্যান্ডের মানুষ একটি বড় পাত্রে ঠান্ডা জল নেয়। তারপর শিসা জাতীয় ধাতুকে গরম করে। ততক্ষণ ধাতুটি উত্তপ্ত হতে থাকে, যতক্ষণ না তা পুরোপুরি তরলে পরিণত হচ্ছে। এর পর সেই উত্তপ্ত তরল ধাতুকে ফেলে দেওয়া হয় ঠান্ডা জলের সেই পাত্রের মধ্যে। মুহূর্তে সেই ধাতু আবার কঠিন হয়। জল থেকে তুলে আনা সেই ধাতুকে পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে মনে করা হয়। তার পর সেই ধাতুর সামনে হয় বিশেষ প্রার্থণা। ডেনমার্কে মানুষ আবার একে অপরের বাড়ির সামনে প্লেট ছোড়াছুড়ি করে। তারা মনে করে, এই প্রথার মাধ্যমে বহু মানুষ একত্রিত হতে পারবে। মানুষে মানুষে বন্ধুত্ব গাঢ় হবে।

স্প্যানিশরা ৩১ ডিসেম্বর রাতে ১২টি টাটকা আঙুর খেয়ে নববর্ষকে বরণ করে নেয়। মনে করা হয়, ১৮৯৫ থেকে এই ভাবে আঙুর খেয়ে বর্ষবরণের রীতি শুরু। ওই আঙুরগুলিকে পবিত্র ও শুভ মনে করেন সেখানকার মানুষ। তেমনই গ্রিকরা আবার নববর্ষে বাড়ির প্রবেশ দ্বারে পেঁয়াজের থোকা ঝুলিয়ে রাখেন।

ট্র্যাডিশন নিয়ে কথা হচ্ছে আর ফুডিং নিয়ে হবে না? সারা পৃথিবী জুড়েই নিউ ইয়ারের খাওয়া-দাওয়ার একটা খুব রিচ রীতি রেওয়াজ রয়েছে। স্বাভাবিক যে কোনও উৎসবই তো পালিত হয় জিভের স্বাদ আর পেটের পুজো দিয়ে। যেমন জাপানি মানুষজন একটি বিশেষ লং নুডলস খেয়ে নিউ ইয়ার পালন করেন। এই লম্বা চাউমিন তাদের বিশ্বাসে লম্বা জীবনের প্রতীক। পতুর্গাল, হাঙ্গেরি, অষ্ট্রিয়া আর কিউবাতে উৎকর্ষ ও প্রগতির প্রতীক হিসেবে পর্ক খাওয়ার রীতি রয়েছে। তেমনই গ্রিস, মেক্সিকো, নেদারল্যান্ডে আংটির মতো দেখতে কেক পেস্ট্রি খাবার চল আছে।

সেলিব্রেশনেরও বিভিন্ন রেওয়াজ এই প্রেক্ষিতে জেনে রাখা ভালো। আমেরিকার টাইমস স্কোয়ারে ৩১ জানুয়ারি ঠিক রাত ১১টা ৫৯মিনিটে নিউ ইয়ার বল ড্রপ করার রীতি এবং তার পর চোখ ধাঁধানো আতসবাজির খেলা, সঙ্গে লাউড মিউজিকের নেশায় সারা বিশ্বের মানুষ সেখানে জড়ো হয়। এ বছর অবশ্য করোনার কারণে সেই আশায় খানিকটা জল পড়েছে। ডাচরা আবার বর্ষশেষের অন্তিম প্রহরে আতসবাজি ফাটানোর সঙ্গে সঙ্গে ক্রিসমাস ট্রিকে পুড়িয়ে খোলা রাস্তার উপর দল বেঁধে বনফায়ার করেন। আর অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরে ৪০ মাইল ধরে রাস্তার দু’ধারে মানুষ ৩১ জানুয়ারি রাতে জড়ো হন। কেবল বাজির খেলা আর বর্ষবরণ করবেন বলে।

ও হ্যাঁ…, শেষ করার আগে বলে রাখি, নিউ ইয়ারের নিউ রেজোলিউশন তো অনেকেই নেন। জানেন কী ‘কুইট স্মোকিং’ আর ‘লুজ ওয়েট’ এই দু’টি নিউ ইয়ারের সবচেয়ে জনপ্রিয় রেজোলিউশন। 

এখন দেখা যাক এই বছর হ্যাপি কি আন হ্যাপি হয়। তবে বাঁচতে গেলে আনন্দে হ্যাপি থাকবো আশা করতেই হবে। সবাই ভালো থাকার চেষ্টা করুন এবং ভালো রাখুন সব্বাইকে।

সেকালের কলকাতায় বাঙালিদের সঙ্গে ইংরেজরাও মেতে উঠতেন নববর্ষ উৎসবে। 

“এসো, এসো হে বৈশাখ / তাপনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক”।

বঙ্গ জীবনে নানান উৎসব আসে ঋতুকে ঘিরে। তেরো পার্বণের মধ্যে পয়লা বৈশাখ কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। গাজন চড়কের শেষে আসে এই দিনটি। বাংলা আর্থিক বছরটাও শুরু মার্চ-এপ্রিলে। এই দিনটিতে ব্যবসায়ীরা গাঢ় লাল রঙের নতুন জাবদা খাতায় মঙ্গলচিহ্ন এঁকে লক্ষ্মী ও সিদ্ধিদাতা গণেশের আরাধনা করেন। সারা বছর নগদ যাঁরা কেনেন না, তারা সাধারণত খাতায় লিখে জিনিসপত্র নিয়ে থাকেন। আর সে খাতায় ধার বাকি খরচের হিসেব বৈশাখের প্রথম দিন মিটিয়ে দেওয়া হয়। শোনা যায়, মুর্শিদকুলি খাঁ পয়লা বৈশাখের সময় রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা চালু করেন। তখন এর নাম ছিল ‘পুণ্যাহ উৎসব’। চৈত্রের শেষে ধান উঠত খামারে। আর সেই সময়েই রাজস্ব আদায়ের দিনটি বেছে নেওয়া হয়। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অনাদায়কৃত রাজস্ব মুকুব করাও হত। ইংরেজদের দেওয়ানি লাভের পরও মুর্শিদাবাদে এই উৎসব পালিত হত। 

পুরোনো কলকাতায় বাবুরা নববর্ষের বিশেষ দিনে কোঁচানো ধুতি চাদরে উৎসবের মেজাজে মেতে উঠতেন। আমন্ত্রিত থাকতেন বহু অতিথি। বাবুদের বৈঠকখানা সেজে উঠত। সাহেবদের নিমন্ত্রণ করে এনে সঙ নৃত্যের ব্যবস্থা করা হত। সঙ্গে প্রচুর খানা পিনার ব্যবস্থা থাকত। একবার দ্বারকানাথ ঠাকুর তার নতুন বাগানবাড়িতে সাহেব ও মেমসাহেবদের নিমন্ত্রণ করে আনলেন। অনেক রকম সুস্বাদু খাবার সাহেবগণকে খাওয়ালেন। পাশ্চাত্য সঙ্গীতে এবং নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে নববর্ষের সন্ধ্যা মহাসমারোহে কাটলো।

“আজ বৎসরের শেষ দিন। যুবত্বকালের একবছর গেল দেখে যুবক-যুবতীরা বিষণ্ণ হলেন.... আগামীর মুখ চেয়ে, আশার যন্ত্রণায় আমরা সেসব মন থেকে তারই সঙ্গে বিসর্জন দিলাম। ভূতকাল যেন আমাদের ভ্যাংচাতে ভ্যাংচাতে চলে গেলেন। বর্তমান বৎসর স্কুল মাস্টারের মত গম্ভীরভাবে এসে পড়লেন। ভয়ে হর্ষে তটস্থ ও বিস্মিত” হুটমের  নকশাতে কলকাতার নববর্ষ এভাবেই ধরা পড়েছিল। বাঙালিদের দোকানে হাতে তৈরি খাস্তা, নোনতা আর মিষ্টির দরাজ আয়োজন থাকতো আপ্যায়িতদের জন্য। অতিথিদের খাওয়ানোকে বলা হতো ‘উঠনো’। দোকানে হালখাতার ধুম থাকতো চোখে পড়ার মতো। 

মুসলমান ব্যবসায়ীরাও পয়লা বৈশাখের দিনটি হিন্দুদের সাথে মেতে ওঠেন উৎসবে। তাদের দোকানগুলি সুন্দর করে সাজিয়ে তোলেন। আগেকার দিনে দোকানে ঢোকার সময়ে তারা প্রথমে সুগন্ধি গোলাপ জল ছিটিয়ে দিতেন মাথায় গায়ে। সেকালে দোকানে খদ্দের এলে কেওড়া ভেজানো ঠান্ডা সরবত খাওয়ানো হতো। সাথে মিষ্টিমুখ ও ভূরিভোজের ব্যবস্থা। পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে আগে আয়োজন হতো বৈশাখী মেলার। মেলাতে নানা রকম হস্তশিল্প সামগ্রী বিক্রি হতো। প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগে শহরের চেহারাটা পাল্টেছে। পুরানো দিনের নিয়মগুলো আজ বেমানান তবু বোধহয় ঋতুর স্পর্শে আজও মন স্মরণ করায় বাঙালির নিজস্বতাকে।

তথ্যসূত্র-

১. হুতোম প্যাঁচার নকশা, কালীপ্রসন্ন সিংহ

২. Calcutta Past & Present, Kathleen Blechynden

(www.theoffnews.com - happy new year)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours