চন্দ্রিমা দত্ত (সাঁজবাতি), লেখিকা ও শিক্ষিকা, শ্রীরামপুর, হুগলি:

এর আগে দ্য অফনিউজ'এ আমি ঝুমুর গান নিয়ে খুব ছোট্ট একটা ফিচার লিখেছিলাম। আসলে সঙ্গীতের বিস্তৃতি এতটাই সুদূর প্রসারিত যে কোনও মানুষ সারাজীবন এটিকে পড়াশোনার বিষয় করে রাখতে পারবেন। একেকটা যুগ শেষ হয়, আরেকটা যুগ এসে পড়ে।

লোককবিতা লোকসাহিত্য বারবার মানুষকে আকৃষ্ট করে তোলে - তার কারণ দীর্ঘকালের কথন, লিখন ও বয়ান। লোকসাহিত্য বা প্রাকৃত সাহিত্যের সঙ্গে সম্মত সাহিত্যের গ্রহণ-সম্পর্ক তো আছেই, তেমনি আছে লোকসঙ্গীত থেকে মার্গসঙ্গীতের গ্রহণ। নাগরিক কবি লোকসাহিত্যে অন্য এক বার্তা খুঁজে পান, যা নগরজীবনে মেলে না।

"চর্যাপদের একটি পাতা উঠে এলো

বাউলের এই দেহ বাঙ্ময় হয়ে গেছে

বত্রিশ নাড়ি দিয়ে যন্ত্রটিকে চেপে 

বত্রিশ তন্ত্রী এক বীণা বজ্রচিত্তে নাচছে"

(গমনাগমন, ভান্ড বেভান্ড)

যে পদের কথা আলোচিত হচ্ছে, তা শুধু সাহিত্যের না, তা গানের, তা নাটকের, চলচ্চিত্রের। আসলে গান তো সাহিত্যেরই এক অঙ্গ, তাই নয় কি? মেঘ দেখে তানসেনের মিঞামল্লারের কথা মনে পড়ে যায়, আকাশ জুড়ে যার সুরবিস্তার। কোথা থেকে আসে এই লৌকিক মেঘের বয়ান "আল্লা ম্যাঘ দে পানি দে"?

সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে খেতে একটা জিনিস বুঝেছি - শব্দাবলী কবিতা গান সবকিছুর মধ্যে এক বিশাল সেতু আছে, যা অনুরাগের সোনার শিকলে বাঁধা। একে অপরের সঙ্গে যুক্ত।

কখনও একটা শব্দ থেকে আরেকটা শব্দ তৈরি হয়েছে। "সাঁঝ" হয়ে গেছে "সাঁঝালি"। মৈথিলী শব্দ "বিরিছ" (বৃক্ষ) চলে এসেছে। চলে আসে পানি। পানির সঙ্গে বহু প্রচলিত তামিল শব্দ "তান্নি" চলে এসেছে। এতো গেল গীতিকবিতার বিভিন্ন শব্দের কথা! (দুই লাইনে লেখা অসম্ভব)

আর পদাবলী ? 

পদাবলী কীর্তনকে ভারতীয় সঙ্গীতচর্চার ধারায় বাঙালির অন্যতম শ্রেষ্ঠ দান বলে উল্লেখ করা হয়। এর সুগ্রন্থিত গায়নরীতির প্রবর্তক নরোত্তম ঠাকুর উত্তর ভারতীয় ধ্রুপদে শিক্ষিত ছিলেন। তাঁর নিজের পরগনার নাম অনুযায়ী যে গায়কীর সৃষ্টি করেছিলেন, তাতে ধ্রুপদের প্রভাব যথেষ্ট। কিন্তু, সুরের বিচারে পদাবলীর যে বাঙালিয়ানা তার সৌকর্যের শক্তিটি নিহিত আছে লোকসঙ্গীতকে অবলম্বন করে ওঠার মধ্যে। রাগসঙ্গীতের মধু এমন রসদ্রব অবস্থায় পদাবলীতে এসে মিশেছে যে তাতে এক আশ্চর্য সঙ্গীতধারার সৃষ্টি হয়েছে। এ যেন বাঙালির আত্মসনাক্তকরণ!

পরবর্তীতে কীর্তনে বাঙলার নিজস্ব সুর হিসেবে যে সব সুর প্রচলিত হয় - তাতে পদাবলীর প্রভাব যথেষ্ট! তাছাড়া কীর্তনে রয়েছে তালের অপূর্ব ব্যবহার! এর মধ্যে ধ্রুপদ খেয়াল ঠুংরি অঙ্গের গায়কী ও তাল ছাড়াও আছে অসংখ্য লোকসঙ্গীত ও লোকসুরের তাল (ঝুমুর, ঝাড়খন্ডী, রাঢ়)।

"সুরে আছিল সুরের মান

সুরে আসমান

এই নাম জপ বান্দা

আল্লার দালান 

লা-হি-ইল্লাহী-আল্লাহ্।"

কীর্তন-বাউল-প্রসাদী সব একাত্মীভূত! 

পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চলে একপ্রকার সঙ্গীত আছে যাকে মনোহরসাই বলা হয়। এটি এমন একটি রীতি, যাতে কীর্তন আর বিভাস রাগের একটি মিশ্রণ ঘটেছে। বিভাস সকালের রাগ। পল্লীতে প্রচলিত অনেক গানই বিভাসে গাওয়া হয়েছে। ফলে বিভাস একটা পর্যায় হয়ে গেছে।

একসময় কলকাতায় যখন টপ্পা গানের প্রচলন হয়, তখন তার প্রভাবও পড়ে পল্লীগীতিতে। বহু পল্লীগায়ক আগমনী শ্যামাসঙ্গীত সরল টপ্পার প্রয়োগে গাইতে চেষ্টা করেন। 

আসলে মানুষের স্বভাবই হলো, মনের মতন হলেই তাকে কোনও না কোনও ভাবে গ্রহণ করা! (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - Indian songs Bengali Songs)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours