দেবিকা ভট্টাচার্য, লেখিকা ও লেকচারার, চন্দননগর, হুগলি:
'সংস্কৃত সাহিত্যের জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া', 'সর্ববিদ্যাবিশারদ এবং অদ্বিতীয় বৈয়াকরণিক' তারানাথ তর্কবাচস্পতি। যে মানুষটির জন্ম ও কর্ম কালনাকে ঘিরে এবং যে মানুষটি আজীবন বিভিন্ন রকম কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকেও বিদ্যাচর্চা করে গেছেন, পাণিনির ব্যাকরণের টীকা প্রস্তুত করেছেন, একসময়ের সংস্কৃত পাঠ্য পুস্তক ছাত্রদের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন সেই মানুষটির গল্প, একই বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করা পরবর্তী প্রজন্মের মুখে শোনা যাবে না এমন হয়! স্বাভাবিক কারণেই আমার দাদু লক্ষ্মীনারায়ণ ভট্টাচার্য একসময় যিনি সকলের কাছে 'ভানু পণ্ডিত' নামে পরিচিত ছিলেন, তিনি তাঁর কাজের ফাঁকে ফাঁকে এসব গল্প বলতেন। রামায়ণ মহাভারতের গল্পের থেকে কোনও অংশে কম আকর্ষণীয় ছিল না দাদুর জন্মের আগেকার বা তাঁর ছেলেবেলার কালনার গৌরবের গল্প। বর্ধমান মহারাজার গল্প, তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় সম্মানিত গুণীজনের গল্প, যেখানে রয়েছেন তারানাথ তর্কবাচস্পতির পূর্বপুরুষ (রামরাম তর্ক সিদ্ধান্ত), এমনকি আমাদের পূর্বপুরুষ (রামতনু তর্ক সিদ্ধান্ত)। সেখানে সদ্য 'রূপকথার গল্প' শোনার বয়স পেরোনো আমার কল্পনা ডানা মেলে দিত। চোখের সামনে ভেসে উঠত পুরনো কালনার পথঘাট, ভাগীরথীর গতিপ্রকৃতি। কত বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের সাক্ষী আমাদের কালনা! ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় অম্বিকা কালনায় এসেছিলেন পায়ে হেঁটে, যাঁর কাছে এসেছিলেন তিনিই তো তারানাথ তর্কবাচস্পতি! তারানাথের বাবার দোর্দণ্ড প্রতাপের কথা শুনলে তো অবাক হতে হয়। এ গল্প অবশ্য আমার বাবার কাছে শোনা। আর বাবাও এ গল্প শুনে থাকবেন দাদু বা অন্য কারও কাছে।
শ্যামরায় পাড়ার ওঁদের বাড়ির সামনে দিয়ে (আমার এখনও ওদিকটা বাড়ির পিছন দিক বলেই মনে হয়) রাস্তা ছিল (নিশ্চয় কাঁচা বা মোরামের!) কোর্ট বা নীলকুঠি পর্যন্ত। ঐ রাস্তা দিয়ে গাড়ি করে যাওয়া যাবে না এমন নিয়ম তৈরি করেছিলেন তারানাথের বাবা কালিদাস সার্বভৌম। একবার এক লালমুখো সাহেব জোর করে মোটর গাড়ি চড়ে যেতে গিয়ে কী বিপদ! লোক লস্কর দিয়ে সেই সাহেবকে বেঁধে আচ্ছা দাওয়াই! বোঝো কেমন প্রতাপ! ফল কী হয়েছিল, সে কথা যারা দেখেছে তারা জানে। তবে সাহেবকে বেঁধে মারের কথা বংশ পরম্পরায় ধারাবাহিক ভাবে চলে আসছে।
একটা সংস্কার আমার দাদুর মধ্যে দেখেছিলাম, তিনি বাইরে কোথাও অন্ন গ্রহণ করতেন না। এটি নাকি তারানাথের নিদান।
বিলেত গেলে ধর্ম নাশ হয়, এমন তত্ত্বে তারানাথ বিশ্বাস করতেন না। নিয়মিত শাস্ত্র অধ্যয়ন করলে এবং সেখানে কারও হাতে অন্ন গ্রহণ না করলে, অধ্যয়নের জন্য বিলেত গেলে কোনও ক্ষতি হয় না, এমনটাই বলতেন তিনি। এ তত্ত্ব বিলেত গেলে জাত যাওয়ার মতো দুঃস্বপ্নের হাত থেকে রেহাই দিয়েছিল অনেককে। আমার দাদু বিলেত কেন পুরী কখনও যাননি, কিন্তু অন্য কোথাও অন্নগ্রহণের ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকতেন। একেই বলে বোধহয় প্রভাব!
এ পর্যন্ত সবই শোনা গল্প। মাস কয়েক আগে বিশেষ একটি কারণে তারানাথ তর্কবাচস্পতির প্রসঙ্গ আসায় তাঁর বিষয়ে বিশদ জানতে ইচ্ছুক হয়েছিলাম। অনুসন্ধানের ফলে মনে হয়েছিল তারানাথ তর্কবাচস্পতি বহুযুগ আগের এমন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত নন যাঁর পাণ্ডিত্য তাঁর নিজের মধ্যেই বদ্ধ ছিল, দেশের লোককে দান করেননি; এমন নয়, তাঁর 'অসম্পূর্ণ পাণ্ডিত্য' কেবল বিরোধ এবং অশান্তির সৃষ্টি করেছিল। বরং তাঁর মেধা এবং পাণ্ডিত্যে আলো এবং উত্তাপ দুই'ই যথেষ্ট পরিমাণ ছিল। অন্তঃপুরে তিনি পরিচিত আত্মীয়ের মতো প্রবেশ করতে পারেন আর বিদ্বৎসভাতে তো তিনি সমাদৃত অতিথির আসন পেয়েইছিলেন।
এই পণ্ডিত ব্যক্তির কর্মযজ্ঞের বিবরণ পাওয়া খুব দুঃসাধ্য কাজ নয়, কিন্তু একসময় এ যজ্ঞ সম্পাদন করাই ছিল দুঃসাধ্য।
১৮১২ খ্রিস্টাব্দে তারানাথ তর্কবাচস্পতি ঘোষপাঁচকা গ্রামে(মামার বাড়ি) জন্মগ্রহণ করেন, এবং ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে কাশীতে দেহরক্ষা করেন।তাঁকে লোকমুখে প্রচলিত 'বাঙাল ভট্টাচার্য' তকমা না দিয়ে কালনাবাসী না হয় বলি 'আমাদের লোক'। কারণ রামরাম তর্ক সিদ্ধান্ত যিনি বর্ধমান রাজ তিলোক চাঁদের আহ্বানে বরিশালের বৈচণ্ডী গ্রাম থেকে কালনায় এসেছিলেন, তাঁর পৌত্র এই তারানাথ তর্কবাচস্পতি। রামরাম তর্ক সিদ্ধান্তের পুত্র কালিদাস সার্বভৌম কালনাতে একটি পাঠশালা বসানোর ব্যবস্থা করেন। পুত্র তারানাথের হাতেখড়ি অবশ্য খোঁড়া কৃষ্ণমোহনের টোলে, যদিও পরবর্তী কালে এই টোলের হদিশ পাওয়া যায়নি। দিনে দিনে তিনি ব্যাকরণ শিক্ষাও করেন ভালোমতো। তাঁর জ্যেঠতুতো দাদা বর্ধমানের 'জজ পণ্ডিত' তারিণীপ্রসাদ ন্যায়রত্নের কাছে তিনি ব্যাকরণ, ‘অমরকোষ’, ‘ভট্টিকাব্য’, ‘শিশুপালবধকাব্য’ অধ্যয়ন করেছিলেন।
কলকাতা সংস্কৃত কলেজের সম্পাদক রামকমল সেনের উদ্যোগে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে আঠারো বছর বয়সে তারানাথকে সংস্কৃত কলেজের অলঙ্কার শ্রেণীতে ভর্তি করান জজ পণ্ডিত। জয়গোপাল তর্কালংকার সে সময় কাব্যের অধ্যাপক ছিলেন। অধ্যাপক ছিলেন নাথুরাম শাস্ত্রী, নিমচাঁদ শিরোমণি।
নিমচাঁদ শিরোমণিকে এশিয়াটিক সোসাইটি যখন মহাভারত পুনর্মুদ্রণ এবং তার প্রুফ দেখার দায়িত্ব দেয়, তখন বৃদ্ধ অধ্যাপক নিমচাঁদ, ছাত্র তারানাথের উপরই ভরসা রাখেন এবং সে কাজ সুসম্পন্নও হয়। বছর আষ্টেকের ছোটো সহপাঠী ঈশ্বরচন্দ্রকে তারানাথ অত্যন্ত স্নেহ করতেন। বিশ্বনাথ কবিরাজের 'সাহিত্য দর্পণ' অধ্যয়নের জন্য ঈশ্বরচন্দ্র তারানাথের বাসাবাড়িতে যেতেন।পাঁচবছরে সংস্কৃত কলেজের পাঠ শেষ করে ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে আইন কমিটির পরীক্ষায় তারানাথ উত্তীর্ণ হন। সরকার বর্ধমানের সদর আমিন পদে নিয়োগ করতে চাইলেও তিনি চাকুরি না নিয়ে বেনারস যান উচ্চশিক্ষার জন্য। সেখানে ব্যাকরণ, দর্শন, গণিত, ফলিত জ্যোতিষ নিয়ে চর্চা করতে থাকেন। তিন বছর পর ফিরে আসেন কালনায় এবং নিজের টোল প্রতিষ্ঠা করেন।
রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় বলেছেন, "ঐশ্বর্যের আড়ম্বরই বিলাতি ধনীর প্রধান শোভা, মঙ্গলের আয়োজন ভারতের ধনীর প্রধান শোভা।" তারানাথ তর্কবাচস্পতিকৃত মঙ্গলের আয়োজনের আভাস পেলে উক্তিটির যাথার্থ্য বোঝা যায়। (ক্রমশঃ)
ঋণস্বীকারঃ তারাসাধন ভট্টাচার্য (আমার বাবা) ও ত্রিদিবসন্তপা কুণ্ডু
(www.theoffnews.com - Taranath TarkaBachaspati)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours