তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

এই শহরের নারীবাদীরা তাঁর কথা ভুলে গিয়েছেন। কিন্তু তিনি, গোবিন্দরাম ঠাকুরের স্ত্রী রামপ্রিয়া ঠাকুরানিই সম্ভবত কলকাতার প্রথম প্রতিবাদিনী। মৃত স্বামীর সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে, দুই ভাশুর নীলমণি ঠাকুর ও দর্পনারায়ণ ঠাকুরের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা রুজু করতেও পিছপা হননি তিনি।

এই ইতিহাস অষ্টাদশ শতকের। তখনও কলকাতা শহর ঠিক মতো গড়ে ওঠেনি। মরাঠা আক্রমণ ঠেকাতে এখনকার সার্কুলার রোডের ‘মারহাট্টা ডিচ’, উত্তরে অস্বাস্থ্যকর ‘ব্ল্যাক টাউন’-এই ছিল সীমাবদ্ধ। ছিল সেন্ট জন’স চার্চে জোব চার্নকের সমাধি, সুপ্রিম কোর্ট। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, হিন্দু কলেজ, স্বামী বিবেকানন্দ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর— তখন ভবিষ্যতের গর্ভে।

রবীন্দ্রনাথের পূর্বসূরিদের সঙ্গে অবশ্য এই কাহিনির প্রগাঢ় যোগাযোগ। মামলার বাদী রামপ্রিয়া ঠাকুরানি, ঠাকুরবাড়ির এক বিধবা স্ত্রী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীর বঞ্চনার বিরুদ্ধে রামপ্রিয়ার প্রতিবাদের রেশ ঠাকুর পরিবারে দীর্ঘ দিন পরেও গুঞ্জরিত হয়েছিল। রামপ্রিয়ার দুই পুরুষ পরে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের স্ত্রী দিগম্বরী দেবীও তাঁর দেখানো পথেই হেঁটেছিলেন বললে অত্যুক্তি হবে না। নিজের বিশ্বাস, আদর্শ ও পরম্পরার পরিপন্থী কাজের জন্য স্বামী দ্বারকানাথকে ত্যাগের মাধ্যমে ঠাকুর পরিবারের কুলবধূ দিগম্বরী যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তা আজ প্রবাদে পরিণত। দ্বারকানাথের ইংরেজ-সংসর্গ তাঁর মা বা স্ত্রী কেউই ভাল চোখে দেখেননি। দ্বারকানাথ এ ব্যাপারে স্ত্রীর মতামত অগ্রাহ্য করলে দিগম্বরী স্বামীর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতেও ইতি টানেন। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ায় যে, দিগম্বরী হিন্দু পণ্ডিতদের ডেকে ম্লেচ্ছদের সঙ্গে একত্রে পানভোজন করা স্বামীর বিরুদ্ধে বিবাহ বিচ্ছেদের বিধানও চেয়েছিলেন। পণ্ডিতেরা নিদান দেন, ‘স্বামীকে ভক্তি ও তাঁহার সেবা অবশ্য কর্তব্য, তবে তাঁহার সহিত একত্র সহবাস প্রভৃতি কার্য্য অকর্তব্য।’ স্ত্রীর সাংসারিক দায়িত্বটুকু পালন করা ছাড়া দিগম্বরী স্বামীর সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক রাখেননি। কাজের সূত্রে দ্বারকানাথের সঙ্গে যত বার কথা বলতে হত, তত বারই নাকি তিনি গঙ্গাজলে স্নান করতেন, এমন কথাও শোনা যায়। ইতিহাসেরও যেমন ইতিহাস থাকে, তেমনই দিগম্বরীর ছক ভাঙার পিছনেও হয়তো ছিল রামপ্রিয়ার দৃষ্টান্ত।

যশোর জেলার মহেশ্বর কুশারী ও তাঁর ছেলে পঞ্চানন জ্ঞাতিকলহের ফলে ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় চলে আসেন। সময়টা সপ্তদশ শতকের শেষ ভাগ, কলকাতা তখন সবে গড়ে উঠছে। পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ইংরেজ বণিকদের যাতায়াত, বড়বাজারের কাছে শেঠ, বসাকদের সুতাবস্ত্রের হাট তখন বহু লোককে এ দিকে বসতি স্থাপনে আকৃষ্ট করেছিল। পঞ্চানন এই আকর্ষণেই কলকাতা গ্রামের দক্ষিণে, আদিগঙ্গার তীরে গোবিন্দপুর গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। আদিগঙ্গার মুখে নোঙর ফেলা ইউরোপীয় জাহাজে নানা জিনিসপত্র সরবরাহ করে সে সময় বেশ রোজগারও করতে থাকেন। এর পর বর্গিদের হাঙ্গামার সময় ইংরেজদের কলকাতার কুঠি কেল্লায় পরিণত হলে সেখানেও প্রয়োজনীয় রসদ সরবরাহের সুযোগ পান তিনি। এই সূত্রে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ কর্তাদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। ঘটনাচক্রে এই সময় পতিত ব্রাহ্মণ কুশারীরা তাঁদের নিম্নশ্রেণির প্রতিবেশীদের কাছে ‘ঠাকুরমশাই’ নামে অভিহিত হতেন, তাঁদের দেখাদেখি ইংরেজ সাহেবরাও তাঁকে ‘ঠাকুর’ বলতেন। পঞ্চানন কুশারী এ ভাবেই হয়ে গেলেন পঞ্চানন ঠাকুর।

পঞ্চাননের দুই ছেলে। জয়রাম ও রামসন্তোষ। কলকাতা, সুতানুটি ও গোবিন্দপুর ইংরেজদের অধীনে আসার পর ১৭০৭ সালে প্রথম এখানে জরিপের কাজ হয়। জরিপের কাজে দু’জন আমিনের প্রয়োজন ছিল, পঞ্চাননের অনুরোধে তৎকালীন কালেক্টর শেল্ডন জয়রাম ও রামসন্তোষকে ওই কাজে নিয়োগ করেন। এর পর ১৭১৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতার দক্ষিণে ৩৮টি গ্রাম কেনে। জয়রাম ও রামসন্তোষ সেখানেও জরিপের দায়িত্ব পান। ঠাকুর গোষ্ঠী এ ভাবেই বিত্তশালী হয়ে ওঠে। ১৭৪১-৪২ সালে বর্গি আক্রমণ রুখতে কলকাতায় যে মারহাট্টা খাল খনন করা হয়, পঞ্চানন-তনয় জয়রাম ঠাকুর ছিলেন তার অন্যতম পরিদর্শক, এমন মতও প্রচলিত।

জয়রামের চার পুত্র— আনন্দীরাম, নীলমণি, দর্পনারায়ণ, গোবিন্দরাম। এক কন্যা, সিদ্ধেশ্বরী। প্রথম পুত্র আনন্দীরাম নাকি অতিরিক্ত মদ্যপান করে কুলগুরুকে অপমান করেছিলেন, তাই জয়রাম তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করে তাড়িয়ে দেন। ১৮১৩ সালে আনন্দীরামের পৌত্র রাধাবল্লভ অবিভক্ত সম্পত্তির ভাগ পেতে সুপ্রিম কোর্টে যে মামলা করেন, সেখানে এক সাক্ষী জানিয়েছিলেন, স্বয়ং জয়রামের নাকি পুত্র-জামাতা সমেত একত্রে বসে মদ্যপানের অভ্যেস ছিল। তাই ঠিক কী কারণে আনন্দীরাম ত্যাজ্য হন, তা বলা মুশকিল। জয়রামের দ্বিতীয় পুত্র নীলমণি ঠাকুর ক্লাইভের আমলে ওড়িশায় কালেক্টরের অধীনে সেরেস্তাদার ছিলেন। নীলমণির পরের ভাই দর্পনারায়ণ ছিলেন ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান, এ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য সূত্রেও তিনি প্রভূত বিত্তের অধিকারী হয়েছিলেন।

জয়রাম ঠাকুরের সবচেয়ে ছোট ছেলে গোবিন্দরাম। তিনিও এক জন কৃতী পুরুষ ছিলেন। রামপ্রিয়া ঠাকুরানি ছিলেন তাঁরই স্ত্রী। সম্পত্তির অধিকার ফিরে পেতে তিনি তৎকালীন সুপ্রিম কোর্টে যে মামলা করেন, সেখানে গোবিন্দরামের ব্যবহৃত জিনিসের একটি তালিকা ছিল। এই অপ্রকাশিত তালিকাটিতে অন্যান্য নানা জিনিসের সঙ্গে ২৯টি ইংরেজি বইয়ের কথাও জানা যায়। এ থেকে অনুমান করা যায়, কৃতবিদ্য গোবিন্দরাম শুধু ইংরেজি বলতে পারতেন তা-ই নয়, ইংরেজি বই পড়তেও রীতিমতো অভ্যস্ত ছিলেন।

পলাশির যুদ্ধের আগের বছর, ১৭৫৬ সালে জয়রাম ঠাকুরের মৃত্যু হয়। তিনি এখনকার ধর্মতলা অঞ্চলে বাড়ি, বৈঠকখানা, জমাজমি নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু সে বছরই সিরাজউদৌল্লার কলকাতা আক্রমণের সময় পরিবারটির সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরের বছর পলাশির যুদ্ধে সিরাজ হেরে যান। মিরজাফর নবাব হওয়ার পর কলকাতা জয়ের ক্ষতিপূরণ হিসেবে কোম্পানিকে যে টাকা দেন, নীলমণি ঠাকুর তা থেকে ১৮ হাজার টাকা পান, এবং ডিহি কলকাতা গ্রামে জমি কিনে বসবাসের ব্যবস্থা করেন। এই ভাবেই ১৭৬৫ সাল নাগাদ পাথুরিয়াঘাটায় ঠাকুরদের বসবাসের সূত্রপাত। সিরাজউদ্দৌলার আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যাওয়া কলকাতার পুরনো ফোর্ট উইলিয়াম পলাশির যুদ্ধের পর আবার নতুন করে তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। গোবিন্দরাম এই নতুন কেল্লা নির্মাণের পরিদর্শক নিযুক্ত হয়েছিলেন। জানা যায়, এ কাজে তিনি ভাল অর্থ উপার্জন করেছিলেন। গোবিন্দরামের মৃত্যু হয় ১৭৭৭ সালের ২৫ মে। তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই ঠাকুর পরিবারের পারিবারিক বন্ধন আলগা হতে থাকে। সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে গোবিন্দরাম ঠাকুরের স্ত্রী ও ভাইপোদের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে মামলা শুরু হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আদালতে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলেছিল এই মামলা।

সম্প্রতি এই মামলা বিষয়ক বেশ কিছু অপ্রকাশিত নথি প্রকাশ্যে এসেছে, যা আমাদের বহু অজানা তথ্যের সন্ধান দেয়। ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’ গ্রন্থে নগেন্দ্রনাথ বসু ও ব্যোমকেশ মুস্তাফী এই মামলা প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে ঠাকুর পরিবারের প্রথম বিভাজনকারী হিসেবে রামপ্রিয়া ঠাকুরানির দিকেই আঙুল তুলেছিলেন। তাঁরা লিখেছেন, রামপ্রিয়াই সম্পত্তির ভাগ আদায় করতে তাঁর দুই ভাশুর নীলমণি ও দর্পনারায়ণ ঠাকুরের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করেন। তাঁরা আরও বলেন, জয়রামের ত্যাজ্যপুত্র আনন্দীরামের বড় ছেলে রামতনু ঠাকুর কাকিমাকে হিন্দু বিধবার অধিকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে নাকি এই মামলা করতে প্ররোচিত করেছিল। ঠাকুরবাড়ির আদি পর্বের গল্প শোনাতে গিয়ে সব লেখকই কমবেশি নগেন্দ্রনাথদের কথিত ইতিহাসকেই অনুসরণ করেছেন। কিন্তু আসল কাহিনী এই তথাকথিত ইতিহাসের থেকে অনেকটাই আলাদা। (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - Rampriya Tagore)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours