তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

পুরোনো কলকাতার প্রাচীন রাস্তাগুলোর মধ্যে মুক্তরামবাবু স্ট্রিট হলো অন্যতম।

মুক্তরামবাবুর পুরো নাম মুক্তরাম দে। সেই কালে তিনি একজন প্রভাব প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি ছিলেন। মুক্তরামবাবু পলাশী আমলের মানুষ। মুক্তরামবাবুর নামে ছয়টি রাস্তা আছে। সেগুলি প্রাচীন কলকাতার শিমুলিয়া গ্রামের অন্তর্গত ছিল। এই মুক্তরামবাবু স্ট্রিটই প্রধান পথ। এই রাস্তাটি চিত্তরঞ্জন এভিনিউকে অতিক্রম করে চিৎপুরে এসে মিশেছে। এই মুক্তরামবাবু স্ট্রিটের বহু বাড়িতে ও মেসগুলিতে বহু গুণী ব্যক্তির সমাবেশ হয়। আসুন জেনে নেওয়া যাক কিছু মানুষের কথা।

১৩৪, মুক্তরামবাবু স্ট্রিটের ‘ক্ষেত্র কুঠি’। মানে মেস বাড়ি। তিনতলা বাড়ির পলেস্তারা খসে পড়েছে। বারান্দা উধাও। বেরিয়ে রয়েছে লোহার কাঠামো। বাড়িতে ঢুকে সামনেই রান্নার ঘর। চলছে রাতের রান্নার আয়োজন। একে একে কাজ থেকে ফিরতে শুরু করেছেন মেসবাড়ির বাসিন্দারা। এখানেই থাকতেন সাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তী। যে মেসবাড়ি সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, মুক্তারামে থেকে, তক্তারামে শুয়ে, শুক্তারাম খেয়েই তিনি শিবরাম হয়েছেন।

শিবরাম কোন ঘরে থাকতেন? প্রশ্ন করায় সোৎসাহে দোতলার একটি ঘর দেখিয়ে দেন সেখানকার সবচেয়ে প্রবীণ বাসিন্দা উত্তমকুমার পাল। আদতে বর্ধমানের বাসিন্দা, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার চাকুরে উত্তমবাবু ক্ষেত্র কুঠিতে আছেন ৩৫ বছর ধরে। বলেন, ‘‘এখানে আসা ইস্তক ওঁর সর্ম্পকে অনেক গল্প শুনেছি। দোতলার এই ঘরে উনি একলাই থাকতেন। খুঁজলে দেওয়ালে ওঁর লেখাও পাবেন।’’ দেওয়ালের সাদা রং যেখানে উঠে গিয়েছে, সেখানে সত্যিই পেনসিলে লেখা ঠিকানা, ফোন নম্বর মিলল। শোনা যায়, শিবরাম দেওয়ালে রং করতে দিতেন না। সেখানে লেখা থাকত জরুরি বহু জিনিস। কারণ, খাতার মতো দেওয়ালের হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই!

৭২, বনমালী নস্কর লেন থেকে ব্যোমকেশের হ্যারিসন রোডের (এখন মহাত্মা গাঁধী রোড) আস্তানা হয়ে সাড়ে চুয়াত্তর— বাঙালির সমষ্টিগত স্মৃতিতে মেসবাড়ির জায়গা পাকা হয়ে গিয়েছে কবেই। শুধু তো ব্যোমকেশ নয়, ব্যোমকেশের স্রষ্টাও থাকতেন একটি মেসে। সেখানে থেকেছেন জীবনানন্দ দাশও। এ ছাড়াও শহরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মেসবাড়িতে থেকেছেন বহু স্বনামধন্য ব্যক্তি। কিন্তু দ্রুত পাল্টাতে থাকা শহরে আজ মেস অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক। পুরনো বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে বহু মেস। আর এভাবেই একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছে কলকাতার মেসবাড়ির ইতিহাস।শিবরাম চক্রবর্তীর ঘরে আড্ডা আবাসিকদের।

সেই ইতিহাস কিছুটা হলেও ধরে রাখার আবেদন নিয়ে বছর দুয়েক আগে পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছিল হেরিটেজ ওয়াক ক্যালকাটা নামে একটি সংস্থা। ওই সংস্থার কর্ণধার তথাগত নিয়োগী জানান, কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মেসবাড়ি নিয়ে সঠিক তথ্যের অভাব রয়েছে। তথ্য মিললে বিষয়টি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা হবে। এরপরেই ওই সংস্থার ব্যবস্থাপনায় বর্ষণা বসু, আনমোল গ্রোভার এবং দীপান্বিতা পালের হাত ধরে শুরু হয় ‘মেসবাড়ি প্রজেক্ট’। বর্ষণা জানাচ্ছেন, গত শতকের গোড়ার দিকে কর্মসূত্রে শহরে আসা মানুষদের জন্যই গড়ে ওঠে মেসবাড়িগুলি। ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট আর্কাইভ এবং ১৯১৫ ও ১৯৩৫ সালের স্ট্রিট ডিরেক্টরি ধরে খোঁজ চালিয়ে তাঁরা দেখেন, ১৯৭০ সালের আগে খোলা মেসের মধ্যে এখনও চালু আছে ২৬টি। তাঁদের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চালু থাকা মেসবাড়ির মধ্যে সবচেয়ে পুরনো ১৯১১ সালে তৈরি হওয়া কলেজ স্কোয়ারের ব্যাপটিস্ট মিশন স্টুডেন্টস হল।

১৯২৯ সালে তৈরি হওয়া ক্ষেত্র কুঠির আবাসিকের সংখ্যা এখন ২১। প্রতি ঘরে তিন জ‌ন করে। সকলে ভাগ করে নেন বাজার করার দায়িত্ব। রান্নার জন্য রয়েছেন দুই কর্মচারী। খরচাপাতি চলে মেসের তহবিল থেকে। কেউ মেস ছেড়ে গেলে নতুন সদস্য আসেন চেনা কারও ‘রেফারেন্স’ নিয়ে। ফলে মেদিনীপুর ও বর্ধমানের বাসিন্দারাই মেস ভরিয়েছেন। সকালে খাওয়া সেরে সকলে বেরিয়ে গেলে খাঁ খাঁ করে মেস। সপ্তাহান্তে বা উৎসবেও ছবিটা একই। বাকি সময়ে সন্ধ্যার দিকে অবশ্য জমে আড্ডা বা তাসের আসর। বিভিন্ন পেশার, অসমবয়সী আবাসিকদের সেই আসরই মেসবাড়ির আসল মেজাজ। তবে বাড়ির জীর্ণ অবস্থার কথা উঠলে কিছুটা তাল কাটে সেই আসরের।

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের এককালের আস্তানা, ৬৬, মহাত্মা গাঁধী রোডের বাড়ির একতলায় রয়েছে একটি ভাতের হোটেল। বোর্ডে লেখা ‘প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং হাউস, স্থাপিত ১৯১৭’। জানা গেল, বোর্ডিং হাউস ঝাঁপ ফেলেছে বছর দুয়েক আগেই। শতাব্দী প্রাচীন বাড়ির দোতলার কয়েকটি ঘরে জ্বলছে আলো। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় কোন ঘরে থাকতেন প্রশ্ন করলে বাড়ি দেখভালের দায়িত্বে থাকা শেখ কাসেম আলি আঙুল দেখান তিনতলার দিকে— ভাঙাচোরা সিঁড়ি, ঘুটঘুটে অন্ধকার। যাওয়ার রাস্তা নেই।

বিশ্ব হেরিটেজ সপ্তাহ উপলক্ষে সম্প্রতি মেসবাড়ি প্রজেক্টের রিপোর্টটি জমা পড়েছে রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের কাছে। বিষয়টি নিয়ে কী ভাবছে কমিশন? চেয়ারম্যান শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘একাধিক বিষয় খতিয়ে দেখে তবেই কোনও বাড়ি হেরিটেজ বলে ঘোষণা করা যায়। মালিকদের সম্মতির বিষয়টিও রয়েছে। লন্ডনের ধাঁচে কোনও বাড়ির ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে প্লাক লাগানো সম্ভব সহজেই। তবে কমিশন নিজে থেকে এটা করতে পারে না। এর জন্য কমিশনে চিঠি লিখতে হবে কোনও উৎসাহীকে।’’

১৭৯২ সালে কর্নেল মার্ক উড কলকাতার যে মানচিত্র প্রকাশ করেন তাতে নামাঙ্কিত রাস্তার সংখ্যা ছিল মাত্র ২৬টি। এরমধ্যে ২০টি ইংরাজ রাজপুরুষদের নামে আর ৬টি ছিল বাঙালিদের নামে। তারা হলেন মদন দত্ত, প্রাণকৃষ্ণবাবু, নীলু দালাল, নারায়ণ চ্যাটার্জী, মুক্তরামবাবু ও বলরাম ঘোষ। (সূত্র– ঐতিহাসিক নিশীথরঞ্জন রায়/প্রাণতোষ ঘটকের ‘কলকাতার পথ ঘাট’ গ্রন্থের ভুমিকা) এখনও বলরাম ঘোষ স্ট্রিট ও মুক্তরামবাবু স্ট্রিট আমাদের খুব পরিচিত রাস্তা। বাকি রাস্তাগুলির পরিচয় ছিল পাড়ার নামে, যেমন ‘আহমেদ জমাদার স্ট্রিট’(এখন ইলিয়ট রোড),  ‘গোরস্তান চৌরঙ্গী কা রাস্তা’ (এখন পার্ক স্ট্রিট),  ‘ডুম টোলি’ (এখন এজরা স্ট্রিট), ‘পুরানা নাচঘরকা পূরব রাস্তা’ (এখন লর্ড সিনহা রোড), ‘পুরানা নাচঘর কা উধার রাস্তা’(পরে থিয়েটার রোড, এখন সেক্সপীয়ার সরণি), ‘হোগলকুড়িয়া গলি’ (এখন সাহিত্য পরিষদ স্ট্রিট), ‘রানী মুদি গলি’ (পরে বৃটিশ ইন্ডিয়ান স্ট্রিট (এখন আবদুল হামিদ সরণি)  এইরকম। এইসব রাস্তাগুলির ইতিহাস কলকাতার সামাজিক ইতিহাসেরই অঙ্গ। এইসব নামের মধ্যে লুকিয়ে আছে আদি কলকাতার বিন্যাস। বাদামতলা, বেলতলা, ঝামাপুকুর, পদ্মপুকুর,  নেবুতলা পটলডাঙ্গা ইত্যাদি কলকাতার নানান মহল্লা বা এলাকার নামের পেছনে নিশ্চিতভাবেই লুকিয়ে আছে স্থানিক ইতিহাস। মধ্য কলকাতায় এন্টালি নামটি এসেছে ‘হেন্তালি’’ গাছের নাম থেকে। কলকাতার নগরায়ন হবার আগে আদি কলকাতায় ওই অঞ্চলে হেন্তাল বা হেঁতাল গাছ প্রচুর হত এটা সহজেই অনুমান করা যায় এই নাম থেকে। হেঁতাল গাছ জন্মায় জোয়ারের জলের প্রভাবে। এখন যেমন সুন্দরবনে হেঁতাল গাছের জঙ্গল আছে।  একইভাবে ‘ট্যাংরা’, ‘তপসিয়া’, ‘চিংড়িঘাটা’ নামগুলি থেকে ঐতিহাসিকরা অনুমান করেন আদিতে এলাকাগুলি ছিল লবণ হ্রদের মধ্যে।

পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা একসময় পরিচিত ছিল প্রাসাদ-নগরী হিসেবে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনাকালে রাজধানী কলকাতায় ধনী জমিদার ও অভিজাত বাঙালিরা গড়ে তোলেন অসংখ্য ভবন, প্রাসাদ ও বাগান বাড়ি। এমনি একটি প্রাসাদ হলো মার্বেল প্যালেস। চোরবাগানের মল্লিক পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রামকৃষ্ণ মল্লিক, যিনি ব্যবসা করে প্রচুর অর্থের অধিকারী হন। ওনার এক বংশধর নীলমণি মল্লিক রাজেন্দ্র মল্লিককে শিশু বয়সে দত্তক নেন। রাজেন্দ্রর তিন বছর বয়সকালে প্রচুর সম্পত্তি রেখে নীলমণি মারা যান। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১৮৩৫ সালে তিনি এক ফরাসি স্থপতিকে দিয়ে এই ‘মার্বেল প্যালেস’ নির্মাণ শুরু করান। শেষ হতে সময় লাগে ৫ বছর (১৮৪০)। নিউক্ল্যাসিকাল স্থাপত্যরীতিতে গড়ে তোলা এই তিনতলা ভবনটির সামনে রয়েছে কোরিন্থিয়ান রীতিতে তৈরি স্তম্ভ এবং কারুকার্য করা বড় বারান্দা। চিনা প্যাভিলিয়নের ধরনে নির্মিত হয়েছে ঢালু ছাদ। নীলমণি মল্লিক উত্তর কলকাতার মুক্তরামবাবু স্ট্রিটে তাঁর বসত বাড়িতে জগন্নাথদেবের মন্দির নির্মাণ করেন। মার্বেল প্যালেসের অন্দর মহলের প্রাঙ্গণে মন্দিরটি এখনো রয়েছে। এই ৪৬ নম্বর মুক্তরামবাবু স্ট্রিটেই রাজেন্দ্র মল্লিক গড়ে তোলেন অসাধারণ সৌন্দর্যমন্ডিত মার্বেল প্যালেস (যেহেতু রাজার পরিবারের সদস্যরা এখনও এ বাড়িতে বাস করেন তাই দর্শনার্থীরা শুধু ভবনটির একটি অংশেই ঢুকতে পারেন। প্রাসাদের অন্দরমহলে এবং প্রসাদের ভিতরে অবস্থিত জগন্নাথদেবের মন্দিরে ঢোকার অধিকার তাদের নেই)। বিপুল সম্পত্তি ও আভিজাত্যর জন্য রানি ভিক্টোরিয়া তাকে রাজা উপাধি দেন।

(www theoffnews.com - Muktaram Babu street Kolkata)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours