সুমিত তালুকদার, সিনিয়র জার্নালিস্ট, নৈহাটি, উত্তর ২৪পরগনা:

শব্দ, জল, বায়ু আগেই দূষিত হয়েছিল। আর্সেনিক দূষণও মারাত্মক প্রাণহানিকর আকার ধারণ করেছিল। পরিবেশ দূষণ নিয়ে আজও সচেতনতা ও চর্চা অব্যাহত। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনে মেধা পটেকার ও গ্রেটা থুনবার্গ-এর অবদান অনস্বীকার্য। তৈরি হয়েছে গ্রীন বেঞ্চ, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। অনিয়ন্ত্রিত পরিবেশ দূষণের ফলে আজ বিপন্ন মানবসমাজ ও বন্য প্রাণী। বিনষ্ট প্রাকৃতিক ভারসাম্য। এতসব দূষণ সামলাতেই জেরবার, হিমশিম খাচ্ছে গোটা বিশ্ব। তার মধ্যে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে করোনা সংক্রমণ ও দূষণ। এই ভয়ঙ্কর অতিমারীর দাপটে ও প্রভাবে মানবসমাজ কেবলমাত্র আক্রান্ত হচ্ছে না, লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ, প্রাণহানির মতো নিষ্ঠুর ঘটনা। পাশাপাশি করোনার ফলে ছড়াচ্ছে মাত্রারিক্তভাবে সংক্রমণ ও দূষণ। ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আজ এই ভাবনাটাই নিয়মিত আলোচনার এবং আশঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশেষত দূষণের ক্ষেত্রে প্রথমে বলা যায়, করোনা বর্জ্য দূষণ। এখনও যত্রতত্র ব্যবহৃত, পরিত্যক্ত মাস্ক পড়ে থাকতে দেখা যায়। এছাড়া পিপিই, ফেস শিল্ড, গ্লাভস, অক্সিজেন মাস্ক, ইনজেকশন সিরিঞ্জ, বিছানার চাদর, বিশেষত হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে কোভিড বর্জ্যের স্তূপীকৃত আবর্জনা লক্ষ্য করা যায়। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ভারতে শুধু করোনা পরীক্ষাতেই দৈনিক ১৪.৫ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে। আরও ১০১ টন বর্জ্য কোভিড চিকিৎসা সংক্রান্ত। এ রাজ্যে পরিমাণ ছিল ৬.৫ টন। এ পরিসংখ্যান গত বছরের। কিন্তু এবারের করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গের বিশালতা আর ভয়াবহতা প্রথম তরঙ্গের প্রায় ৪ গুণ বেশি। তাই আশঙ্কা যে, এই বর্জ্যের পরিমাণ আরও ভয়ংকর আকার ধারণ করবে ২০২১'এর শেষে। সাধারণত এসব বর্জ্য পুড়িয়ে বা মাটিতে গর্ত করে পুঁতে ফেলার নিয়ম।

ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, প্রতি মাসে বিশ্বে কয়েক হাজার কোটি মাস্ক ও গ্লাভস ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রতি মিনিটে ৩০ লক্ষ মাস্ক বর্জ্যে পরিণত হচ্ছে যার ৭৫% যাচ্ছে মাটির নিচে অথবা সমুদ্রে।মাস্কগুলো প্রায় সবই বিভিন্ন পলিহাইড্রো কার্বন দিয়ে তৈরি যা মাটিতে ও জলে নির্গত করে প্রচুর পরিমাণে মাইক্রো প্লাস্টিকস। এগুলো সম্পূর্ণভাবে পরিবেশে মিশে যেতে ৪৫০ বছর সময় লাগতে পারে বলে অনুমান। যেহেতু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোভিড বর্জ্য বিনষ্ট করার বৈজ্ঞানিক উপায় অবলম্বন করা হয় না, তাই সৃষ্টি হতে পারে পরিবেশ দূষণের মতো জটিল অনভিপ্রেত সমস্যা। এছাড়া প্লাস্টিক ব্যাগে বেঁধে করোনা রোগীর মৃতদেহ সৎকারের ফলেও হচ্ছে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ। প্লাস্টিক আগুনে পুড়ে বায়ু প্রদুষিত হচ্ছে। প্লাস্টিক গলে গিয়ে বৈদ্যুতিক চুল্লিরও যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করছে। চুল্লির কর্মক্ষমতা বসে যাওয়ার জন্য সৎকারে বিঘ্ন ঘটছে, অচল হয়ে পড়ছে। শ্মশানে মৃতদেহের লাইন পড়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি প্লাস্টিক ব্যাগের পরিবর্তে সুতির ব্যাগের ব্যবস্থা করে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। সর্বোপরি করোনা দূষণের ফলে মারাত্মক ভাবে দূষিত হচ্ছে গঙ্গা নদী। আমরা জানি, গঙ্গাকে দূষণের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য কানপুর আইআইটি—র অধ্যাপক স্বামী জ্ঞানস্বরূপ সানন্দ ১১১ দিন টানা অনশন করে মৃত্যু বরণ করেন।  পতিতপাবনী গঙ্গা আজ পারুল কাক্কার—এর বিতর্কিত কবিতা শববাহিনী গঙ্গায় পরিণত। গঙ্গা দূষণের ফলে তোলপাড় আজ কেন্দ্র— রাজ্য রাজনীতি। উত্তরপ্রদেশ, বিহার থেকে মালদহের মানিকচক হয়ে রাজ্যের গঙ্গায় ভাসছে শতাধিক লাশ। শ্মশানে জায়গা নেই, দাহ করার কাঠ নেই, অন্তেষ্টি সম্পন্ন করার অর্থ নেই অসহায় মানুষের। তাই বাধ্য হয়ে এই কোভিড বিসর্জন। এছাড়া চুপিসারে ডাবল ইঞ্জিন সরকারের বেওয়ারিশ লাশ ভাসিয়ে দেওয়ার দুষ্কর্ম তো আছেই। উত্তরাখন্ড প্রদেশের ভাগীরথীর তীরে কুকুরে খুবলে খাচ্ছে বেওয়ারিশ মৃতদেহ, এ দৃশ্যও দুর্লভ নয়। নির্মল গঙ্গা ও পরে নমামী গঙ্গের দূষণমুক্ত করার উদ্দেশ্য আজ ব্যর্থতায় পর্যবসিত। করোনা দূষণের ফলে এভাবেই দূষিত হচ্ছে আমাদের পরিবেশ অলক্ষ্যে, অগোচরে। আমাদের ও সরকারের তরফে আরও সচেতন ও সতর্ক হতে হবে। উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

(www theoffnews.com - corona pollution)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours