তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

কলকাতার ইতিহাসে বিডন স্ট্রিট নানা কারণে বিখ্যাত।

এই পথটি পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে প্রসারিত হয়ে একদিকে চিৎপুর রোড অন্য দিকে আপার সার্কুলার রোডকে সংযুক্ত করেছে।

বাংলা তথা ভারতবর্ষের রংগমঞ্চের ইতিহাসে বিডন স্ট্রিট একটি বহুল প্রচারিত নাম। আধুনিক নাট্যশালার ইতিহাসে কলকাতার দাবি প্রথম ও প্রধান। তিনটি নাট্যশালা স্থাপিত হয়েছিল এই রাজপথটির ধারে। তারা হলো বেঙ্গল থিয়েটার, স্টার থিয়েটার ও মিনার্ভ থিয়েটার। প্রথম দুটি কালের বিস্মৃতির গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। শেষেরটি আজও টিকে আছে। এইখানে যে সব নট নটী অভিনয় করে গেছেন তাঁরা আজও ইতিহাসের পাতায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এরা হলেন, গিরিশ ঘোষ, অমৃতলাল বসু, দানী ঘোষ, শিশির ভাদুরী, অহিন্দ্র চৌধুরী, বিনোদিনী ও তারা সুন্দরী।

সেকালের গুণী, জ্ঞানী ও ধনী ব্যক্তিদের বাস ছিল এই বিডন স্ট্রিটের দুই ধারে। যেমন প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী রামদুলাল সরকার, অধ্যাপক আলেকজান্ডার টমরি, অনুশীলন সমিতির বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ শেঠ, কবি কাশী প্রসাদ ঘোষ, কবিরাজ যামিনী রঞ্জন রায় প্রমুখ বিডন স্ট্রিটে বসবাস করে কলকাতার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে গেছেন।

জাতীয় কংগ্রেসের অনেকগুলি সভা ও অধিবেশন এই বিডন উদ্যানে হয়েছিল। এই বিডন উদ্যান অনেক ঐতিহাসিক সভা সমিতির সাক্ষী। ভারতীয় কংগ্রেসের দ্বাদশ অধিবেশন হয়েছিল এই উদ্যানে।এইখানে উপস্থিত ছিলেন গোখলে, বাল গঙ্গাধর তিলক, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী প্রমুখ। এই অধিবেশন আর একটি কারণে স্মরণীয় কারণ রবীন্দ্রনাথ এই সভায় তাঁর সুমিষ্ট কণ্ঠে উদ্ভোধন সংগীত গাইলেন।কবি কন্ঠ প্লাবিত করলো এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত।১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বাংলার ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় দিন।

কার্জনের বঙ্গ ভঙ্গ আদেশের বিরুদ্ধে সারা দেশ সোচ্চার হয়ে উঠে। দলে দলে যুবক ও বৃদ্ধরা গঙ্গা স্নান করে নগ্ন পদে পদচারীদের হাতে রাখি বন্ধন করতে করতে  বিডন উদ্যানে সমবেত হলেন।চতুর্দিক মুখরিত ছিল বন্দে মাতরম সংগীতে। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি বক্তৃতা করেছিলেন এবং গানও গেয়েছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে টালা ট্যাঙ্কে বোমা পড়ার আশঙ্কায় এই বিডন উদ্যানে একটি জলাধার নির্মাণ করা হয়, পরে যুদ্ধ থেমে গেলে এটা আবার ভরাট করে দেওয়া হয়।

কলিকাতায় প্রথম বাংলা নাটক মঞ্চস্থ করার কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন হেরাসিম (রুশ নাটিমদী) লেবেদফ (১৭৪৯-১৮১৮) ২৫ নম্বর ডুমতলায় বর্তমানে এজরা স্ট্রিটে বেঙ্গল থিয়েটারে ১৭৯৫ সালে বাংলা নাটক মঞ্চস্থ করেন। মুদ্রিত বাংলা নাটকের মধ্যে নন্দ কুমার রায়ের অভিজ্ঞান শকুন্তলা প্রথম মঞ্চস্থ করা হয় সিমলার সাতু বাবুর বাড়িতে। তারিখটা ছিল ১৮৫৭ সালের ৩০ জানুয়ারি। এই বেঙ্গল থিয়েটার প্রতিষ্টিত হয় ৯৯ নম্বর বিডন স্ট্রিটে। এই জমিটির মালিক ছিলেন ছাতু বাবু বা সাতু বাবু (আশুতোষ দেব)। এই রঙ্গালয় নির্মিত হয় ১৮৭৩ সালে। মাইকেল মধুসূদন ও নাট্য কার বিহারিলাল চট্টোপাধ্যায় গোড়া থেকেই এই রঙ্গালয়ের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৮৭৩ সালে ১৬ আগস্ট মাইকেলের শর্মিষ্ঠা মঞ্চস্থ করে বেঙ্গল থিয়েটার যাত্রা শুরু করে। ১৮৯৩ সালে ৬ নম্বর বিডন স্ট্রিটে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার এর জমিতে মিনার্ভা থিয়েটার নির্মিত হয়। আবার স্টার থিয়েটারের পত্তন হয়েছিল ৬৮ নম্বর বিডন স্ট্রিটে।

মারোয়ারী ধনী গুরমুখ রায় এই জমিটি বাগবাজার এর কীর্তিচন্দ্র মিত্রের কাছ থেকে লিজ নিয়ে থিয়েটার বাড়ি তৈরির কাজ শুরু করেন। শুধু মাত্র বিনোদিনীর জন্য তিনি এই ব্যবসায় নেমেছিলেন।১৮২৩ সালের ২১ জুলাই গিরিশ চন্দ্র রচিত দক্ষযজ্ঞ নাটক দিয়ে স্টার থিয়েটারের যাত্রা শুরু হয়। ১৮৮৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর শ্রী রামকৃষ্ণ আসেন গিরিশ ঘোষের চৈতন্য লীলা দেখতে। এটাই তাঁর সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রথম প্রবেশ। তাঁর আশীর্বাদে ধন্য হয় বিনোদিনী ও গিরিশ ঘোষ। এইখান থেকে গিরিশ ঘোষের সাথে রামকৃষ্ণের পরিচয়ের সূত্রপাত হয়, বাকিটা তো ইতিহাস। গুরমুখ রায়ের পর এই থিয়েটারের মালিক হন অমৃত লাল বসু, দাসুচরণ নিয়োগী ও হরিপ্রাসাদ বসু। এরপর প্রচুর থিয়েটার কোম্পানি তৈরি হয়। যেমন এমরেন্ড থিয়েটার, কোহিনুর থিয়েটার, ক্লাসিক থিয়েটার এবং মনমোহন থিয়েটার। এইভাবে বিডন স্ট্রিট নাটকের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠে। নাটক ছাড়াও সাহিত্য ও পত্র পত্রিকায় উল্লেখ যোগ্য অবদান রাখে। এই বিডন স্ট্রিটের এক বাড়িতে শুরু হয় রবিবাসর সাহিত্য সভা। এইখানেই আসতেন রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এই রবিবাসর সাহিত্য সভা বিভিন্ন সাহিত্যিকদের বাড়িতে হতে শুরু করে।

৮৩ নম্বর বিডন স্ট্রিটে চৈতন্য লাইব্রেরি স্থাপিত হয়।এই লাইব্রেরিটি তৈরি করেন আহিড়িতলার সুবর্নবনিক পরিবারের গৌরহরি সেন। বাংলায় এটাই প্রথম রেজিস্ট্রি ভুক্ত লাইব্রেরি। সেকালের বিখ্যাত পত্রিকা ছিল সংবাদ ভাস্কর। এটি শিমুলিয়ার আশুতোষ দেবের বাড়ি থেকে প্রকাশিত হতো। এই পত্রিকাটি সতীদাহর প্রথার বিরুদ্ধে ও স্ত্রী শিক্ষার সপক্ষে প্রচার চালিয়েছিল। বসুমতি পত্রিকা প্রকাশিত হয় ৯৬ নম্বর বিডন স্ট্রিট থেকে। অনাথবাবুর বাজার বিডন স্ট্রিটের ওপর অবস্থিত। এইখানে একটা বিরাট মাঠ ছিল। এই মাঠে বুলবুলির লড়াই হত। ছাতু বাবু ১৫০টি বুলবুলি নিয়ে আসতেন এবং এরকম অনেকেই নিয়ে আসতেন। উভয় দলের মাঝখানে কিছু খাদ্যদ্রব্য ছড়িয়ে দেওয়া হতো এবং সেই খাবার নিয়ে বুলবুলিদের লড়াই বেঁধে যেত। লড়াইয়ে হেরে গেলে পাখিরা উড়ে যেত।

২০ নম্বর বিডন স্ট্রিটের বাড়িটি ঐতিহাসিক ভাবে স্মরণীয়। এই বাড়িতেই সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র  ভাবি বিশ্বকবিকে নিজ কণ্ঠের মালা দিয়ে বরণ করেছিলেন। এই ঘটনাটা ঘটেছিল ১৮৮২ সালে শ্রাবণ মাসে রমেশ দত্তের জেষ্ঠা কন্যা কমলা দেবীর সাথে প্রমথনাথ বসুর বিবাহের দিনে। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন 'রমেশ দত্ত মহাশয়ের জেষ্ঠা কন্যার বিবাহ সভার দারের কাছে বঙ্কিমবাবু  দাঁড়াইয়া ছিলেন। রমেশবাবু বঙ্কিমবাবুর গলায় মালা পরাইতে উদ্যত হইয়াছেন। এমন সময়ে আমি সেখানে উপস্থিত হইলাম। বঙ্কিমবাবু তাড়াতাড়ি সেই মালা আমার গলায় দিয়া বলিলেন, এই মালা ইহারই প্রাপ্য, রমেশ তুমি সন্ধ্যা সংগীত পরিয়াছ?' (জীবন স্মৃতি, রবীন্দ্রনাথ)। আজকের প্রজন্মের কোনও আগ্রহী জীবন স্মৃতি পাঠক ওই ঐতিহাসিক ঘটনা স্থলের ঠিকানা খুঁজে পাবেন না। কারণ রাস্তার নাম ও বাড়ির নম্বর দুই পরিবর্তন হয়ে ১, অভেদানন্দ রোড হয়েছে।

২০ নম্বর বিডন স্ট্রিটের বাড়িটি বিখ্যাত শিল্পপতি ও কর্মবীর স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের (১৮৫৪ -১৯৩৬)।  তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে তিন বছর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে স্বাধীন ব্যবসার উদ্দেশ্যে ঠিকাদারি শুরু করেন। তিনি বহু জন হিতকর কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। পাশেই ২১ বিডন স্ট্রিটের বাড়িতে থাকতেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিচারক ডা:রাধা বিনোদ পাল। তিনি ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত কলকাতা হাইকোর্টের বিচারক ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জাপানি যুদ্ধ বন্দিদের বিচারের জন্য তাঁকে আন্তর্জাতিক সামরিক আদালতের বিচারক নিযুক্ত করা হয়।জাপান সম্রাট তাঁকে First order of sacred treasures উপাধি প্রদান করেন।

২৪ নম্বর বিডন স্ট্রিটের বাড়িটি খ্যাতনামা চিত্র শিল্পী হেমেন্দ্রনাথ মজুমদারের অমর চিত্রকর্মের সাক্ষী। এই বাড়িতেই তাঁর স্টুডিও ছিল। পরবর্তী কালে শিল্পী ও সাহিত্যিকদের মিলন মন্দিরে পরিণত হয়েছিল এই স্টুডিও ভবন। পরে চলে আসেন ২৪ নম্বর বিডন স্ট্রিটের বাড়িতে। আর এই বাড়িতে ১৯১৯ সালে ইন্ডিয়ান একাডেমি অফ ফাইন আর্টস স্থাপিত হয়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মেল বন্ধনে বিদেশী মিশনারী বাংলায় এসেছিলেন তাদের মধ্যে আলেকজান্ডার টমরি অন্যতম। (১৮৬২-১৯১০) বাংলার শিক্ষা আন্দোলনে তাঁর অবদান স্মরণীয়। তিনি বাঙালিকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসতেন। তিনি থাকতেন ৩২/৬ বিডন স্ট্রিটের বাড়িতে। তিনি ডাফ কলেজের অধ্যাপক ছিলেন।

১৮১৮ সালে ডাফ কলেজে প্রথম হিন্দু হোস্টেল স্থাপিত হয়। ডাফ কলেজ এবং জেনারেল এসেম্বলিইজ ইনস্টিটিউশন ১৯০৮ সালে মিলিত ভাবে স্কটিশ চার্চেস কলেজ নাম গ্রহণ করে। তিনি অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন, কিন্তু বাংলা সাহিত্যে সুপন্ডিত ছিলেন। চৈতন্য লাইব্রেরির প্রতিষ্টা কাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সভাপতির পদ অলংকৃত করেন।তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের সদস্য ছিলেন এবং ইংল্যান্ডের রয়েল ইকোনোমিক সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হয়েছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের রাজসিংহ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন।

হিন্দু কলেজের কৃতি ছাত্র বাংলার শিক্ষা ক্ষেত্রে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক তথা ফার্স্ট বুক অফ রিডিং প্রণেতা প্যারিচরণ সরকার (১৮২৩-১৮৭৫) ৩০/১০ বিডন স্ট্রিটের বাড়িতে বসবাস করতেন। সমাজ কল্যানে প্যারিচরণের দান কম নয়। দুটো পত্রিকা তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। একটি ওয়েলউইসার অন্যটি হিতসাধন পত্রিকা। প্যারিচরণ সরকার ছিলেন বিদ্যাসাগরের অন্তরঙ্গ বন্ধু। তাঁর বৈঠক খানায় বিদ্যাসাগর ছাড়া দীনবন্ধু মিত্র, কালী প্রসন্ন সিংহ প্রমুখ জ্ঞানী গুণী ব্যক্তিরা আসতেন আড্ডা দিতে। বিদ্যাসাগর লিখলেন বর্নপরিচয় প্রথম ভাগ আর প্যারিচরণ লিখলেন ফাস্টবুক অফ রিডিং। এইখানেই শেষ নয় তিনি বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলনে অকৃপণ ভাবে সাহায্য করেছিলেন। বাংলার শিক্ষা ও সমাজ সংস্কৃতিতে  অনবদ্য অবদানের জন্য তাঁকে আর্নল্ড অফ দি ইস্ট আখ্যা দেয়া হয়েছিল। (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - Beadon street)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours