পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
আমার বাবা এক মফঃস্বল শহরের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। অন্য সকলের মত অল্প বয়সে বাবারও সিনেমা দেখার ঝোঁক ছিল, ভালবাসতেন ফুচকা খেতে, রেস্তোরাঁতে ভাল মন্দ খেতে। এ শখের অনেকটাই তিনি পূরণ করেছেন কলকাতায় গিয়ে, মাকে সঙ্গে নিয়েই। কিন্তু নিজের শহরে কোনওদিন তাকে কেউ রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খেতে বা সিনেমা হলে ঢুকতে দেখেননি। একটু বড় হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম বাবাকে। কেন সিনেমা দেখা বা ফুচকা খাওয়া কি অপরাধ, অশ্লীল? তাহলে তুমি এটা এখানে করতে পারো না কেন? প্রায় বছর পয়ত্রিশ আগেকার কথা হলেও স্পষ্ট মনে আছে বাবার উত্তর। তিনি বলেছিলেন “পরিচয়ের একটা মান্যতা থাকে। তার মর্যাদা দিতে হয়। আমি এখানে শিক্ষক, আমাকে অনুসরণ করবে আমার ছাত্র ছাত্রীরা, তাই আমার প্রতিটা পদক্ষেপ হওয়া উচিৎ সতর্ক, শোভন এবং দিশাযুক্ত।“
তখন খুব ভাল করে বুঝিনি। আজ বুঝি, কথাটা কতটা দায়িত্ববোধ থেকে এসেছিল। শুধু আমার বাবা কেন, আমি অন্য শিক্ষক শিক্ষিকাদেরও আমার শহরে এমন আত্মশাসনে থাকতেই দেখেছি। কিন্তু এই পরিচয়ের মান্যতার সংজ্ঞাটাই এখন কেমন যেন ধোঁয়াশাময় হয়ে যাচ্ছে। যেমন ধরা যাক একজন রাজনৈতিক নেতা এবং এক কলেজ শিক্ষিকার কথা। রাজনৈতিক নেতা হওয়ার সুবাদে তিনি সুপরিচিত। এছাড়াও তিনি মেয়র থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছেন। অর্থাৎ রাজনৈতিক জীবনের বহু অভিষ্টলাভই তার হয়েছে। প্রচুর গুণগ্রাহী, অনুগামী, অনুসারী। এমতাবস্থায় গোল বাঁধাল তার চিত্তচাঞ্চল্য। না সেটা সব বয়সেই, সব ক্ষেত্রেই হতে পারে, প্রেমে কোনও দোষ নেই। কিন্তু এক্ষেত্রে সেই চিত্তচাঞ্চল্যের কারণ একজন বিবাহিতা, মধ্যবয়স্কা নারী। যিনি একজন কলেজ শিক্ষিকাও বটে। এ পর্যন্ত হয় তো ঠিকই ছিল। অনেকেই বলতে পারেন যে ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে যে কেউ যা খুশি করতে পারেন তা নিয়ে বলাটা অশোভন। আমিও মানি। কিন্তু মনে পড়ে বাবার কথাটা। পরিচয়ের মান্যতা, আত্মশাসন। এই কঠিন বাংলাগুলি ওই নেতা বা শিক্ষিকা জানেন না তা কিন্তু নয়, মানেন না।
যে কোনও মানুষের একটা ব্যক্তিগত পরিসর থাকা উচিৎ নিশ্চয়। কিন্তু সেই মানুষটি বিখ্যাত বা সুপরিচিত হলে তার সেই পরিসর কিন্তু অনেকটাই কমে আসে। বিখ্যাত হওয়ার সেই মাশুলটুকু তাকে দিতেই হয়। যেমন ধরুন আপনি আমি করোনার টিকা নিয়েছি, সে খবর অনেকেই জানে না। কিন্তু অমিতাভ বচ্চন বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন টিকা নেন সেটা তখন খবর। কারণ টিকা নেওয়াটা ব্যক্তিগত লাভের জন্য হলেও তাদের খ্যাতি সেটাকে আরও মান্যতা দেয়, অন্যকে উদ্বুদ্ধ করে। তাই খ্যাতিলাভের আগেই এই সমস্যাগুলি সম্বন্ধে সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
এখন তো সংবাদ মাধ্যম অতি সক্রিয়, তাই চাপও বেড়েছে প্রচুর। সম্প্রতি নেতা এবং শিক্ষিকার করা একটা ভিডিও সামনে এসেছে। তাতে তারা নেতার স্ত্রীর নামে অভিযোগ করেছেন ব্যভিচারের। কিন্তু সেই অভিযোগ করছেন যারা তারা গত কয়েক বছর ধরে ঘোষিত, প্রকাশ্য ব্যাভিচারে লিপ্ত। সংবাদ মাধ্যমে তাদের কীর্তি দেখে আমরা লজ্জা পাই, কিন্তু তাদের সে সবের বালাই আছে বলে তো মনে হয় না। আমাদের ছেলেমেয়েরা এই খবর তো নিশ্চয় পড়ে, জানে। এই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে একজন শিক্ষিকা বা রাজনৈতিক নেতার ভাবমুর্তিটা কি দাঁড়াচ্ছে ভাবুন তো।
এ প্রসঙ্গে একজন অভিনেত্রীর নাম না করলে লেখাটি অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। বিদেশে গিয়ে অতি ঘটা করে বিয়ের পরে তার ঘোষণা সেটা নাকি লিভ ইন ছিল। সিঁদুর পরা, পুরুত ডেকে মন্ত্রোচ্চারণ, নিজের পদবীর সঙ্গে স্বামীর পদবী জুড়ে দেওয়া ইত্যাদি সবই নাকি নাটক ছিল। ভাবুন কি উচ্চ মানের অভিনেত্রী তিনি। আমাদের তো গর্ব হওয়া উচিৎ। কিন্তু এখানেও সেই এক সমস্যা, অভিনেত্রীর পাশাপাশি তিনি আবার সাংসদও। ব্যাস ব্যক্তিগত পরিসরের দফারফা। সন্তান সম্ভবা অভিনেত্রীর সেই সন্তানের পিতা কে, তাই নিয়ে চলছে নাচে গানে মনমাতানো এক ছবি। এখনকার সংবাদমাধ্যমগুলি তাতে আরও সস ঢেলে, মশলা ছড়িয়ে রগরগে করে পরিবেশনে ব্যস্ত। তা অভিনেত্রী কি নেত্রী হওয়ার আগে এটুকুও বোঝেননি, জননেত্রী হতে গেলে তার পরিচয়ের একটা মান্যতা থাকা দরকার। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এসবই দেখছে বড় হওয়ার মাঝে।
অভিনেতারা স্বপ্নের জগতের মানুষ। তাদের নিয়ে নানান রঙিন কাহিনী ভাসে। কিছু সত্যি, কিছু মিথ্যা। কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা তো মাটির পৃথিবীতে থাকেন, থাকা উচিৎ। তাদের সরাসরি যোগাযোগ থাকে মানুষের সঙ্গে। তাদের কথা শোনার জন্য বসে থাকে লক্ষ লক্ষ মানুষ। তাদের যে কোনও আদেশ বা অনুরোধ পালনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন অনুগামীরা। সেই তাদের ব্যক্তিগত পরিসর যদি এমন লজ্জাজনক বা অস্বস্তিকর হয় তবে তার প্রভাব জনমানসে পড়বে অনিবার্যভাবেই। সেটা বিলক্ষণ জানা আছে বলেই ওই নেতা ও শিক্ষিকাকে ধীরে ধীরে ছেঁটে ফেলেছে তাদের পুরনো দল। নতুন দলেও গিয়ে তারা সেভাবে পাত্তা পাননি, নিজেদের কীর্তির জন্যই। এবার অভিনেত্রীর ক্ষেত্রে কি করবে তার বর্তমান দল, সেটাই এখন দেখার। শুধু করোনা রোধেই নয় সামাজিক অবক্ষয় রোধেও তাই প্রয়োজন আত্মশাসন।
(www.theoffnews.com - Baishakhi Banerjee Sovan Chatterjee Nusrat)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours