তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

২৩ শে আগস্ট, ১৯৩৯ সালে মহাত্মা গান্ধি মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধায় তাঁর আশ্রম থেকে "প্রিয় বন্ধু" হিটলারের প্রতি লিখেছিলেন যে, "মানবতার জন্য" এই চিঠি লিখছেন তিনি। ... ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর, হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করেছিলেন, যার ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল এবং ইতিহাসের গতিপথকে পরিবর্তন করেছিল।

রবীন্দ্রনাথের সাথে গান্ধীজির মতবিরোধ কম ছিল না। কিন্তু গান্ধীজির অহিংসা পদ্ধতিতে বিরোধীতাকে রবীন্দ্রনাথ সন্মান করতেন। ব্যক্তি গত আক্রমণ নয় ,ব্যক্তিগত সৌজন্যের পথিকৃৎ উনি।

ইতিহাস বিখ্যাত চিঠি ,গান্ধীজি লিখলেন হিটলারকে।

প্রিয় বন্ধু!

আমি আপনাকে সৌজন্যের খাতিরে বন্ধু সম্বোধন করছি না। আমি আপনার শত্রু নই। আমি আমার জীবনের ৩৩ বছর ব্যয় করেছি ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে সব মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব সৃষ্টির প্রচেষ্টায়। আমি আশা করি, আপনার জানার সেই আগ্রহ আছে যে, সারা বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষ আপনাকে কীভাবে মূল্যায়ন করে। আপনার মাতৃভূমির প্রতি যে ভালোবাসা ও মমত্ব তাতে আমাদের কোনো অবিশ্বাস নেই এবং আমরা এও বিশ্বাস করি না যে, আপনি একজন দানব, যা আপনার প্রতিপক্ষ আপনার বিরুদ্ধে রটিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আপনার কিছু লেখা ও বক্তব্য এবং আপনার কাছের লোকেদের দেওয়া আপনার সম্পর্কে মন্তব্য আমার মতো যারা শান্তিতে বিশ্বাসী তাদের কাছে আপনাকে দানবরূপে উপস্থাপন করছে। যেমন- চেকস্লোভাকিয়ার ওপর আপনার চালানো নির্যাতন, পোল্যান্ডের নারীদের ধর্ষণ এবং ডেনমার্কের ওপর আগ্রাসন আপনার প্রতি এই ধারণারই জন্ম দিচ্ছে। আপনার নিষ্ঠুরতা দেখে মনে হচ্ছে, এই সমস্ত কাজকে আপনি ধর্ম বলে জ্ঞান করেন। কিন্তু আমি শৈশব থেকে শিখে এসেছি, যে কর্ম মানুষকে কষ্ট দেয় তা ধর্ম হতে পারে না। ফলে আমি এ ক্ষেত্রে আপনার সাফল্য কামনা করতে পারছি না।

ঠিক দুই মাস পরে ১৯৩৯ খ্রীস্টাব্দের জুলাই মাস নাগাদ (আষাঢ় ১৩৪৬) অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ মুসোলিনি এবং হিটলারকে ‘নরবলি সংগ্রহের কাপালিক’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। এই নরবলি সংগ্রহের কাপালিকরা তো স্বভাবতই কোনও গণতান্ত্রিকতা, নিয়মনীতি কিছু মানবেন না, যে মূল্যবোধ এবং নিয়মনীতি দ্বারা তাঁরা প্রাণিত এবং পরিচালিত হয়ে থাকেন তা তো ফ্যাসিস্ত দর্শন। সেখানে মানুষের ন্যায্য অধিকারের কোনও মূল্য নেই। অধিকার বিষয়টি একমাত্র নির্ধারিত হবে তাঁরা যা করছেন বা করছেন তার দ্বারাই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পূর্বোক্ত বক্তব্যের দু’বছর আগে ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে ‘প্রচলিত দণ্ডনীতি’ শীর্ষক একটি লেখায় ‘দণ্ডপ্রয়োগের অতিকৃত রূপকে’ বর্বরতা আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি স্পষ্টভাবেই জানিয়েছিলেন যে তিনি কোনও অপরাধীর ‘নির্জন কারাকক্ষবাস’-এর দণ্ড সমর্থন করেন না। শাসকেরা এধরনের অপকর্ম করলে তিনি একাজের প্রতিবাদ করবেন বলে জানিয়ে ছিলেন।

ফ্যাসিবাদের কর্মপদ্ধতি ও নীতি সমগ্র মানবজাতির উদ্বেগের বিষয়। যে আন্দোলন নিষ্ঠুরভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে দমন করে, বিবেকবিরোধী কাজ করতে মানুষকে বাধ্য করে এবং হিংস্র রক্তাক্ত পথে চলে বা গোপনে অপরাধ সংঘটিত করে-সে আন্দোলনকে আমি সমর্থন করতে পারি এমন উদ্ভট চিন্তা আসার কোনো কারণ নেই। আমি বারবারই বলেছি, পশ্চিমের রাষ্ট্রগুলো সযত্নে উগ্র জাতীয়তাবাদ ও  সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব লালন করে সারা পৃথিবীর সামনে ভয়াবহ বিপদের সৃষ্টি করেছে।” (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সি এফ এন্ড্রুসকে লেখা চিঠি। ‘ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান’, লন্ডন, ৫ই আগস্ট ১৯২৬ ইং)

১৯৩০ সাল থেকে ১৯৪০ সাল, এই সময়কালের মধ্যে গোটা ভারত জুড়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিরাট আন্দোলন দেখা যায়। এইসব আন্দোলনে সরাসরি যোগদান না করলেও তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে তিনি ক্রমাগত সারা বিশ্বের বুকে গজিয়ে উঠা ফ্যাসিবাদের সমালোচনা করে গেছেন। ইতালির আবিসিনিয়া আক্রমণের প্রেক্ষিতে তিনি রচনা করেন ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি। এই কবিতার প্রায় প্রতিটি স্তবক ফ্যাসিবাদের হাতে নিপীড়িত মানবসভ্যতার হাহাকারের চিৎকার,

“আজ যখন পশ্চিম দিগন্তে

প্রদোষকাল ঝঞ্ঝাবাতাসে রুদ্ধশ্বাস,

যখন গুপ্ত গহ্বর থেকে পশুরা বেরিয়ে এল

অশুভ ধ্বনিতে ঘোষণা করল দিনের অন্তিমকাল,

এসো যুগান্তের কবি,

আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মিপাতে

দাঁড়াও, ওই মানহারা মানবীর দ্বারে;

বলো ‘ক্ষমা করো’

হিংস্র প্রলাপের মধ্যে

সেই হোক

তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।”

১৯৩৭ সালের ১৫ই ডিসেম্বর নানকিং-র পতনের পর ২৫শে ডিসেম্বর তিনি ‘যেদিন চৈতন্য মোর’ কবিতায় লিখছেন,

"… মহাকাল সিংহাসনে –

সমাসীন বিচারক, শক্তি দাও, শক্তি দাও মোরে,

কন্ঠে মোর আনো বজ্রবাণী, শিশুঘাতী নারীঘাতী

কুৎসিত বীভৎসা পরে ধিক্কার হানিতে পারি যেন

নিত্যকাল রবে যা স্পন্দিত লজ্জাতুর ঐতিহ্যের হৃৎস্পন্দনে,

রুদ্ধ কন্ঠ ভয়ার্ত এ শৃঙ্খলিত যুগ যবে

নিঃশব্দে প্রচ্ছন্ন হবে আপন চিতার ভস্মতলে।”

প্রসঙ্গ ক্রমেই উল্লেখ্য যে, কবি শুধুমাত্র আক্রমণকারী ফ্যাসিবাদের নিন্দা করেই ক্ষান্ত হননি, ধিক্কার জানিয়েছেন লীগ অব নেশনস তথা বিশ্বশান্তির বরকন্দাজের ভূমিকায় অবতীর্ণ শক্তির উদাসীনতা ও নির্বীর্যতাকেও। সচেতন পাঠক স্মরণ করতে পারেন কবির ‘ন্যায়দণ্ড’ কবিতাটি

‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে

তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।’

(www.theoffnews.com - Gandhiji Rabindranath Hitler)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours