শাহনাজ পলি, সিনিয়র সাংবাদিক, বাংলাদেশ:

করোনাকালে ঈদ উৎসবে নেই যে সেই পরিচিত খুশির জোয়ার। সারা বিশ্বের সঙ্গে কোয়ারেন্টাইনকে সঙ্গী করে এই এক পরিণতি যে আমাদের বাংলাদেশেও গ্রাস করেছে গতবারের মতো এবারেও।

বৈশ্বিক মহামারি করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে শোচনীয় পরিস্থিতি শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনীতি সবখানেই নাজুক পরিস্থিতি।

আর এরই মধ্যে এসেছে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর। অনিশ্চিত জীবন, বেকারত্ব, দারিদ্র্যতা চেপে বসেছে প্রায় ঘরে ঘরে। তারই মাঝে পর পর দুই বছর কোনওমতে উদযাপিত হচ্ছে বাঙালির প্রাণের উৎসব ঈদ। 

এক বছর প্রতীক্ষার পর অনাবিল আনন্দ নিয়ে আসে ঈদ। পরিবার, আত্মীয়, বন্ধু সবাই একে অন্যের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে ঈদ উৎসবকে রঙিন করে তোলে। পাড়া প্রতিবেশী ও বন্ধুদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয় ভালোবাসা-প্রীতি। আত্মীয়দের প্রতি তৈরি করে সহানুভূতি। সর্বোপরি মানুষের অন্তরে দয়া-অনুকম্পার বার্তা নিয়ে আসে দিনটি। ধর্মীয় এ ঈদ উৎসব অর্থ খুশি ও আনন্দ অন্যদিকে ত্যাগের মহিমা নিয়ে আসে।

ঈদের সকালে নতুন পোষাক পরে মানুষ ঈদগাহে মায়া-মমতা নিয়ে সমবেত হয়। ভুলে যায় ভেদাভেদ ও হিংসা-বিদ্বেষ। একে অপরের সঙ্গে হাতে হাত মেলায়। কোলাকুলি করে। এক কাতারে দাঁড়ায়। সামাজিক এই বন্ধন সুদৃঢ় করাই ঈদের মূল বার্তা। কিন্তু এবারেও তাই পালিত হচ্ছে সীমিত পরিসরে ঈদ আনন্দ উদযাপন।

করোনা দুর্যোগে ঘরবন্দী শ্রমজীবী মানুষ কর্মহীন হয়ে যখন কোনক্রমে জীবন যাপন করছে, স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য একে অন্যের থেকে তৈরি হয়েছে দূরত্ব। ঈদকে কেন্দ্র করে ঘরে ঘরে যে উৎসব আনন্দ বয়ে যায় তা থমকে গেছে অনেকটাই। কোভিডের আশঙ্কা আর আতঙ্কে মানুষ ভয়াবহ কষ্টে এক একটা দিন অতিবাহিত করছে। অসংখ্য পরিবারে কোভিডে আক্রান্ত ও মৃত্যু ঈদ আনন্দকে ছাপিয়ে দিয়েছে।

আত্মীয় প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে শহর ছেড়ে মানুষ গ্রামে যায় এক বুক আশা নিয়ে। গ্রামে থাকা বাবা-মা বা আত্মীয়-স্বজন একটি বছর তার সন্তান বা প্রিয়জনের জন্য অপেক্ষা করে। তাদের পদচারনায় মুখরিত হয় এক একটা বাড়ি, আঙিনা। পাড়া মহল্লায় উপচে পড়ে ঈদের খুশি। কিন্তু এ সময়ে তেমনটা আর নেই। করোনা সব লন্ডভন্ড করে দিয়েছে।

ঈদের সময় অসহায়-দরিদ্র পরিবারকে সহযোগিতার অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়। যাকাত, ফিৎরা অসহায় এতিম গরীবের মাঝে বিলি করা হয় আয়োজন করে কিন্তু এবারে আগের তুলনায় নিতান্ত কম। এমনকি প্রতিবেশীর খোঁজখবর রাখার সুযোগ হচ্ছে না।

সুখী-সমৃদ্ধ সমাজের চিত্র বদলে গেছে করোনার ভয়াল থাবায়। একজন মুসলিম ঈদের রাতে নিজের কথা ভাবার আগে পড়শির কথা ভাবে। নিজের সন্তানের পাশাপাশি অন্যের কথা ভাবে কিন্তু এবারে আর তার সুযোগ কই?

মহামারি নিয়ন্ত্রণ করতে সারা দেশে চলছে লকডাউন। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যাতায়াত বন্ধ। তবু বিপুলসংখ্যক মানুষ সব প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে। এ অবস্থায় বেড়ে গেছে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি।

প্রতিবেশী দেশ ভারতের করোনার ছোবলে নাজেহাল অবস্থা। প্রতিদিনই ছাড়িয়ে যাচ্ছে আক্রান্ত ও মৃতের রেকর্ড। দেশটিতে এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ২ কোটি ৩৭ লাখের বেশি মানুষ। মারা গেছেন ২ লাখ ৫৮ হাজারের বেশি। 

ভারতের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, ভারতে করোনা ভাইরাসের নতুন করে সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণ হলো বেশ কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও রাজনৈতিক দলগুলোর সমাবেশে সাধারণ মানুষের ব্যাপক উপস্থিতি।

বাংলাদেশেও লকডাউন উপেক্ষা করে ঈদযাত্রা ও কিছু আয়োজন ভারতের মতো অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর সারা দেশে ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। মাঝে কয়েকমাস করোনা নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও আবারও বেড়েছে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত করোনায় মোট মৃত্যু হয়েছে ১২ হাজার ৭৬ জনের আর মোট শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে ৭ লাখ ৭৮ হাজার ৬৮৭ জনে পৌঁছেছে।

করোনা আক্রান্ত ব্যক্তিদের থাকতে হবে ঘরে। সেই সঙ্গে সবার সুস্থতার জন্যও থাকতে হবে নিরাপদে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যাওয়া যাবে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সকলে সুস্থ থাকার চেষ্টাই এখন বিশেষ প্রয়োজন। পবিত্র এই ঈদের আহ্বান হোক, দূরে থাকি কিন্তু মনের ঘরে সকলে থাকি সহ-অবস্থানে, সবাই সুস্থ থেকে। ঈদ মোবারক।

(www.theoffnews.com - Eid-ul-Fitr)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours