পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

মানুষের কথা ভেবে এক মহান সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিজেপি। বলা ভাল বিজেপির দুই নব নির্বাচিত বিধায়ক। সংবাদ মাধ্যমের দৌলতে সকলেই জেনে গিয়েছেন বিজেপির দিনহাটার বিধায়ক নিশীথ রঞ্জন প্রামাণিক এবং শান্তিপুরের বিধায়ক জগন্নাথ সরকার বিধায়ক পদে ইস্তফা দিয়েছেন। তারা ফের সাংসদ পদেই থেকে যেতে চান। সত্যিই তো একই ব্যক্তি দুটি পদে তো থাকতে পারেন না। মানুষের কথা ভেবেই ওরা সাংসদ থেকে বিধায়ক হয়েছিলেন। এবারের সিদ্ধান্তও মানুষের কথা ভেবেই। বিধায়ক হলে সাংসদ পদে ফের নির্বাচন হত। তাতে ফের অনেক খরচ, অনেক সমস্যা। বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দিলে বিধানসভা নির্বাচনটা সংসদ ক্ষেত্রের তুলনায় কম হবে। তাই জনকল্যাণেই এই সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়াটাই মঙ্গল। 

সাধারণ মানুষের চোখ বুজে থাকা বা প্রকারান্তরে অসহায়তার সুযোগ বার বার নিয়েছেন শাসকেরা। বলা রাজনৈতিক শাসকেরা। শাসক না বলে শোষক বলাটাই ভাল বলে মনে হয়। এই শাসনের নামে শোষণের ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। তবে সেগুলি ছেড়ে হাল আমলে একটি পরোক্ষ শোষণের কথাই বলা যাক। সম্প্রতি বহু রক্ত, অর্থ, শক্তি এবং ধৈর্য ক্ষয়ের পর বিধানসভা নির্বাচন শেষ হয়েছে। ফল প্রকাশের পর বিজয়ী তৃণমূল, সরকারও গড়ে ফেলেছে। কিন্তু শেষ হয়েও হয় না আমাদের নির্বাচন। আমরা আগেই জানি দুটি আসনে প্রার্থীর মৃত্যু হওয়ায় ভোট হয়নি, ভোট হয়েও প্রার্থীর মৃত্যুতে ফের নির্বাচনের মুখে খড়দা বিধানসভা। আরও একটি অবশ্যম্ভাবী নির্বাচন হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্যও। তিনি নন্দীগ্রামে হেরে যাওয়ায় ফের তাকে জিতে আসতে হবে। সে ক্ষেত্রে তিনি খড়দাতে দাঁড়ালে অবশ্য একটি আসনে ভোট কমে। এগুলি কিন্তু অনিচ্ছাকৃত। অর্থাৎ এই কেন্দ্রগুলিতে আবার ভোট হওয়াটা কারোর ইচ্ছার উপরে নির্ভর করেনি, পরিস্থিতির শিকার।

কিন্তু বিজেপির দুই প্রার্থীর জন্য ফের নির্বাচন হওয়াটা কিন্তু মানুষের তৈরি করা সমস্যা। অতি লোভের ফল। তবু ভাল বিজেপির আরও তিন সাংসদ ভোটে জিততে পারেননি। তা হলে তো আরও দুটি আসনে ভোট হত আবার (একজন রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন)। বিজেপি নেতৃত্ব তো আগে থেকেই জানত এই পাঁচ সাংসদকে প্রার্থী করা হল মানে এরা জিতলেই ফের ওই আসনে ভোট হবে। সে লোকসভাই হোক, বা বিধানসভা। তাহলে? তারা জেনেই প্রার্থী করেছিলেন এই সাংসদদের। বিজেপি রাজ্যে ক্ষমতায় এলে হয় তো এই সাংসদেরা মন্ত্রী হতেন এই ভেবেই বিজেপির এই সিদ্ধান্ত। কিন্তু ক্রমাগত ভোটের জন্য যে খরচ তার দায় তো বহন করতে হয় সাধারণ নাগরিকদেরই। সেক্ষেত্রে বার বার নির্বাচন করানোর এই অসাধু সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একবারও ভেবেছিলেন বিজেপি নেতৃত্ব? মনে হয় না।

এমনিতেই করোনার কারনে আমাদের অর্থনীতি প্রায় শেষ পর্যায়ে। গরীব মানুষের হাতে টাকা নেই, চাকরি চলে গিয়েছে প্রায় এক কোটি মানুষের। সেই অবস্থায় ফের অহেতুক একটা নির্বাচনের জন্য খরচ কে যোগাবে? বিজেপি সরকার কি ওই নির্বাচনের সব খরচ দেবেন? এই দুই কেন্দ্রে নির্বাচন তো সম্পূর্ণ তাদের হঠকারী সিদ্ধান্তের জন্যই, তাই তাদের দায় নেওয়াটা কি আবশ্যক নয়? তা তারা নেবেন না, কেউই নেয় না। শুধু মানুষকে কলুর বলদের মত মেনে নিতে হয় রাজনৈতিক দলগুলির চাপিয়ে দেওয়া এই অত্যাচার বা শোষণকে। এতগুলি বছরে বাংলায় মন্ত্রী করবার জন্য বিজেপি তেমন কাউকে তৈরি করে উঠতে পারেনি তার দায় কি জনগন নেবে? পাশাপাশি এটাও মনে করিয়ে দেওয়া দরকার এখন ভোট মানে শুধু অর্থের অপচয় নয়, অশান্তি, প্রাণহানিরও সমূহ সম্ভাবনা। সে ক্ষেত্রেও সাধারণ মানুষেরই ক্ষতি সব চাইতে বেশি। 

না না, শুধু বিজেপিকে দোষ দিলে কিন্তু চলবে না। তৃণমূলও এই উদাহরণ আগে রেখেছে। ২০০৯ এবং ২০১৪ সালে পরপর দু’বার শুভেন্দু অধিকারী তমলুক লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ হন। ২০১৬ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনে হয় শুভেন্দুকে মন্ত্রী করতে হবে। ব্যাস নন্দীগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রের প্রার্থী হিসেবে তাঁকে টিকিট দেন তৃণমূল নেত্রী। তারপরই সাংসদ পদে ইস্তফা দিয়ে নন্দীগ্রামের বিধায়ক হন শুভেন্দু এবং রাজ্যের মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পান। শুভেন্দুর ছেড়ে যাওয়া লোকসভা কেন্দ্রে ফের ভোট হয়, সেখানে তার ভাই ভোটে জেতেন। তাহলেই বুঝুন কেউই ধোয়া তুলসী পাতা নয়।

আমাদের সংবিধান বা নিয়ম কানুনও বলিহারি। এ তো সেই লিয়েন নিয়ে গিয়ে অন্য চাকরি করে আসার মত ব্যাপার। সে ক্ষেত্রে সরাসরি অন্যের আর্থিক ক্ষতি হয় না। কিন্তু এক্ষেত্রে তো মানুষের ক্ষতি। বিধায়ক কেউ হতেই পারেন, কিন্তু সে জন্য কেন সাংসদ পদ থেকে তাকে পুরোপুরি ইস্তফা দিয়ে আসতে হবে না? বিধায়ক পদে হেরে গেলে কেন আবার তার সাংসদ পদে ফেরার রাস্তা রাখা হবে? কেন বার বার এই নির্বাচনের গেরো চাপিয়ে দেওয়া হবে? কেন এমন কোনও আইন থাকবে না, যেখানে বলা হবে কোনও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ফের নির্বাচনে লড়বেন শুধুমাত্র তার দায়িত্বকাল শেষ হলে। না এসব কোনওদিন হবে না। আসলে আমাদের দেশে আইন তৈরি করেন আমাদেরই পাঠানো কিছু অসাধু রাজনৈতিক নেতা। যারা নিজেদের সমস্যা হতে পারে এমন কোনও আইনই কোনওদিন তৈরি করবেন না। অন্তত এই দেশে। তাই নির্বাচন আর নির্বাচন, মেগা সিরিয়ালের মত আমাদের দেশে নির্বাচন চলতেই থাকবে, চলতেই থাকবে…

(www.theoffnews.com - re-election India West Bengal)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours