তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

আধ্যাত্মিক সাধনা কখনই রূপের সাধনা হইতে পারে না। তাহা সমস্ত রূপের ভিতর দিয়া চঞ্চল রূপের বন্ধন অতিক্রম করিয়া পরম সত্যের দিকে চলিতে চেষ্টা করে। সীমা থেকে অসীমের দিকে যাত্রা। খন্ড সত্তা থেকে অখন্ডকে বোঝা।

তিনি রূপ থেকেই অরূপের দিকে ছুটে চলেছেন। ইন্দ্রিয় গোচর যে কোনও বস্তু আপনাকেই চরম বলিয়া স্বতন্ত্র বলিয়া ভান করিতেছে, সাধক তাহার সেই ভানের আবরণ ভেদ করিয়া পরম পদার্থকে দেখিতে চায়।’ (রূপ ও অরূপ)

অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে ‘আধ্যাত্মিক সাধনা’ অরূপের সাধনা; সাধকরা বস্তু পৃথিবীর বাইরে অতীন্দ্রিয় জগতের অনুসন্ধান করেন সেই সাধনায়। ‘আধ্যাত্মিকতা’ আমাদের চেতনাকে ঈশ্বরের সঙ্গে সংযুক্ত করে। এর মাধ্যমে তাঁর আনন্দরূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সন্ন্যাসী কিংবা সাধক ছিলেন না। তিনি সুফিধারাসহ অন্য মরমিয়াদের মতো অধ্যাত্ম সাধনায় নিমগ্নও হননি। তিনি ছিলেন কবি। তবে তাঁর সমগ্র চেতনার মধ্যে একটা নিগূঢ় অধ্যাত্ম-অনুভূতি ছিল। সেই অনুভূতিই তাঁর শিল্প চেতনার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কাব্যরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। তাঁর খেয়া-গীতাঞ্জলি- গীতিমাল্য- গীতালি কাব্য এবং অন্যান্য রচনায় অধ্যাত্ম চেতনা প্রকাশিত হয়েছে। কবির অধ্যাত্ম সাধনা নিঃসন্দেহে সার্বজনীন চেতনা দ্বারা পরিশুদ্ধ।

অরূপ, তোমার বাণী

অঙ্গে আমার চিত্তে আমার মুক্তি দিক্‌ সে আনি॥

নিত্যকালের উৎসব তব বিশ্বের দীপালিকা--

আমি শুধু তারি মাটির প্রদীপ, জ্বালাও তাহার শিখা

নির্বাণহীন আলোকদীপ্ত তোমার ইচ্ছাখানি॥

যেমন তোমার বসন্তবায় গীতলেখা যায় লিখে

বর্ণে বর্ণে পুষ্পে পর্ণে বনে বনে দিকে দিকে

তেমনি আমার প্রাণের কেন্দ্রে নিশ্বাস দাও পুরে,

শূন্য তাহার পূর্ণ করিয়া ধন্য করুক সুরে--

বিঘ্ন তাহার পুণ্য করুক তব দক্ষিণপাণি॥

এটাই তাঁর ছিল আধ্যাত্মিকতার স্বরূপ।

কবিগুরুর কবিতার ভাষাতেই আবারও বলা যায়,

মহাবিশ্বজীবনের তরঙ্গেতে নাচিতে নাচিতে

নির্ভয়ে ছুটিতে হবে, সত্যেরে করিয়া ধ্রুবতারা৷

….কে সে৷ জানি না কে৷ চিনি নাই তারে৷

শুধু এইটুকু জানি, তারি লাগি রাত্রি অন্ধকারে

চলেছে মানবযাত্রী যুগ হতে যুগান্তর পানে,

ঝড়ঝঞ্ঝা-বজ্রপাতে, জ্বালায়ে ধরিয়া সাবধানে

অন্তর প্রদীপ-খানি৷

কে সে, চিনি নাই তারে...৷

এইরকম প্রচুর গান আছে। যেখানে প্রতিফলিত হয়েছে তারই ইঙ্গিত।

আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহ-দহন লাগে

তবুও শান্তি তবু আনন্দ তবু অনন্ত জাগে।

স্বামী মেধসানন্দ রবীন্দ্রনাথের

আধাত্ম সাধনা ও শ্রী রামকৃষ্ণ প্রসঙ্গে একটি অসামান্য লেখা লিখেছিলেন। এটি বর্তমান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল অনেক বছর আগে।

একটা আধাত্মবাদীর মুখে শুনুন রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে বর্ণনা।

যাই হোক, ‘শান্তিনিকেতন’ পাঠে মনে হয় রবীন্দ্রনাথ সেই ধরণের সন্ন্যাসকে সমালোচনা করেছেন যার পরিণাম তাঁর ভাষায় ‘নিরতিশয় নৈষ্কর্ম্য ও নির্মমতায়’। যে ত্যাগ ‘নিজেকে রিক্ত করাভর জন্যে নয়, নিজেকে পূর্ণ করবার জন্যেই’, যেখানে ‘আংশিককে ত্যাগ সমগ্রের জন্য, ক্ষণিককে ত্যাগ নিত্যের জন্য, অহঙ্কারকে ত্যাগ প্রেমের জন্য, সুখকে ত্যাগ আনন্দের জন্য’ সে ত্যাগকে তিনি শ্রদ্ধার উচ্চাসন দিয়েছেন।

তাই দেখা যাবে পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকানন্দ-প্রচারিত কর্মযোগের আদর্শ, যা শ্রীরামকৃষ্ণ-নামাঙ্কিত সন্ন্যাসিসঙ্ঘ কার্যে পরিণত করেছিলেন, তার বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব রবীন্দ্রনাথ যখন উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তখন তার ভূয়সী প্রশংসা করতে কুণ্ঠিত হননি।

তাঁর ধারণায় বৈরাগ্য কী ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘…একথা আমি বারবার বলেছি আবার বলি, আমি বৈরাগ্যের নাম করে শূন্য ঝুলির সমর্থন করি না…। অন্তরে প্রেম বলে সত্য পদার্থটি যদি থাকে তবে তার সাধনায়, ভোগকে হতে হয় সংযত, সেবাকে হতে হয় খাঁটি।’

বস্তুত বৈরাগ্য বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে নেতিবাচক মনে হলেও তার মধ্যে নেতিবাচক ও ইতিবাচক দুটি দিকই আছে। শ্রীরামকৃষ্ণের ব্যাখ্যায় তা হল সংসারে বিরাগ, যা নেতিবাচক এবং ঈশ্বরে অনুরাগ, যা ইতিবাচক। সংসার বিরাগের যথার্থ অর্থ সংসারের প্রতি আসক্তি ত্যাগ। কারও ক্ষেত্রে সেই ত্যাগ বাহ্যিক ও মানসিক উভয়ই, কারও ক্ষেত্রে তা কেবল মানসিক।

শক্তিসন্ধানী মানুষের পক্ষে উপরোক্ত বৈরাগ্যের চর্চা পরিহার করা সম্ভব নয়। কারণ, শান্তিলাভের বিকল্প অন্য কোনও পথ নেই বললেই চলে। উপরোক্ত ব্যাখ্যা অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথ সঙ্কীর্ণ অর্থে বৈরাগ্যের চর্চা না করলেও তাঁর ঈশ্বরপ্রেম ও অনাসক্তি সাধনার মধ্য দিয়ে বৈরাগ্যের অন্তরঙ্গ সাধনা করেছিলেন।

মায়াবাদ অদ্বৈত বেদান্তের অন্যতম তত্ত্ব-যা নিয়ে কম বিতর্ক নেই এবং সে বিতর্কের মূল কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘মায়াবাদ’ সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণা রবীন্দ্রনাথ মায়াবাদের বিরূপ সমালোচক হলেও মায়াবাদ প্রসঙ্গে তাঁর এই মন্তব্যটি অনুধাবনযোগ্য-যা তাঁর আত্ম-উন্মোচকও বটে: ‘আমি যে অনুভব করছি, মিথ্যার বোঝায় আমার জীবন ক্লান্ত। আমি যে দেখতে পাচ্ছি, যে পদার্থটাকে আমি বলে ঠিক করে বসে আছি তারই থালা ঘটি বাটি, তারই স্থাবর অস্থাবরের বোঝাকে সত্যপদার্থ বলে ভ্রম করে সমস্ত জীবন টেনে বেড়াচ্ছি- যতই দুঃখ পাই কোনও মতেই তাকেই ফেলতে পারি নে।'

অথচ, অন্তরাত্মার ভিতরে একটা বাণী আছে, ও-সমস্ত তোমাকে ত্যাগ করতেই হবে।… এই বৈরাগ্য যে সমস্ত উপকরণের ধাঁধার মাঝখানে পথভ্রষ্ট বালকের মতো থেকে থেকে কেঁদে উঠছে। তবে আমি মায়াবাদকে গাল দেব কোন্‌ মুখে! আমার মনের মধ্যে যে এক শ্মশানচারী বসে আছে, সে যে আর- কিছুই জানে না, সে যে কেবল জানে-একমেবাদ্বিতীয়ম্‌।’

পরোক্ষে হলেও অদ্বৈত বেদান্তের চরম অনুভূতিবান পুরুষ সম্পর্কে তাঁর সশ্রদ্ধ মন্তব্যও কম প্রণিধানযোগ্য নয়: ‘যিনি খণ্ডকালের সমস্ত খণ্ডটা সমস্ত ক্রমিকতার আক্রমণ থেকে ক্ষণকালের জন্যও বিমুক্ত হয়ে অনন্ত পরিসমাপ্তির নির্বিকার নিরঞ্জন অতলস্পর্শ, মধ্যে নিজেকে নিঃশেষে নিমজ্জিত করে দিয়ে সেই স্তব্ধ শান্ত গম্ভীর অদ্বৈতরসসমুদ্রে নিবিড়ানন্দের নিশ্চল স্থিতি লাভ করেছেন তাঁকে আমি ভক্তির সঙ্গে নমস্কার করি।

এখানে উল্লিখিত ‘অদ্বৈতসমুদ্রে নিশ্চল স্থিতিলাভের নিবিড়ানন্দ’ আর নির্বিকল্প সমাধির তথা অদ্বৈতসিদ্ধির ঘনীভূত দিব্যানন্দ এক নয় কি-যার অভিজ্ঞতা ঈশ্বরকোটি মহাপুরুষদের জীবনে হয়ে থাকে?

এতদ্‌সত্ত্বেও সামগ্রিক বিচারে সৌন্দর্যের পূজারি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মূলত প্রবৃত্তিমার্গের আদর্শে বিশ্বাসী। বহিঃসৌন্দর্যের পূজারি রবীন্দ্রনাথ মূলত প্রবৃত্তিমার্গের আদর্শে বিশ্বাসী। বহিঃসৌন্দর্যের দ্বারপথ দিয়ে অন্তঃসৌন্দর্যের অন্তঃপুরে অভিসার, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আনন্দের মধ্য দিয়ে ইন্দ্রিয়াতীত আনন্দের অভীপ্সা, বন্ধনের মধ্য দিয়ে বন্ধনাতীতের স্বাদলাভ-এই তাঁর ভাব ও সাধনা।

নিবৃত্তিমার্গের সাধনার মতো কঠিন না হলেও এই ভাবের সাধনাও কম দুরূহ নয়। কারণ, এই সাধনায় যেমন প্রয়োজন ঈশ্বরের প্রতি সুগভীর বিশ্বাস ও ভালবাসা তেমনই প্রয়োজন সংযম ও অনাসক্তি।

চিত্ত রবে পরিপূর্ণ অমত্ত গম্ভীর হৃদয়হীন শুল্ক আধ্যাত্মিক জ্ঞানকে রবীন্দ্রনাথ যেমন মেনে নিতে পারেননি তেমনই ভক্তির আবেগে হৃদয়বৃত্তির সাময়িক উদ্বেলতা তথা ভাবোচ্ছ্বাসকেও তিনি সমর্থন জানাননি। ভাবপ্রকাশের ক্ষেত্রে, লোকব্যবহারের ক্ষেত্রে ঠাকুরবাড়ির যে পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল তা হল: ভাব বা ব্যবহার হবে সংযত, মার্জিত ও পরিশীলিত। রবীন্দ্রনাথ শুধু সে ধারা অনুসরণ করেননি, তাঁর ব্যক্তিপ্রকৃতি ও যুক্তিও তার পক্ষে ছিল। তিনি লিখেছেন-

যে ভক্তি তোমারে লয়ে ধৈর্য নাহি মানে

মুহূর্তে বিহ্বল হয় নৃত্যগীতগানে

ভাবোন্মাদমত্ততায়, সেই জ্ঞানহারা

উদ্ভ্রান্ত উচ্ছ্বল ফেন ভক্তি মদধারা

নাহি চাহি নাথ।

{স্বামী মেধসানন্দের ‘রবীন্দ্রনাথের অধ্যাত্মচেতনা ও শ্রীরামকৃষ্ণ-প্রসঙ্গ’ বর্তমান পত্রিকা থেকে সংকলিত}

(www.theoffnews.com - Rabindranath Tagore Medhsananda)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours