সুমিত তালুকদার, সিনিয়র জার্নালিস্ট, নৈহাটি, উত্তর ২৪পরগনা:
আশ্রয়স্থল হিসেবে বিদ্যালয়ের অবদান ও ভূমিকা সুবিদিত। শিক্ষাদানের পাশাপাশি যে কোনও আশু বিপর্যয়, সমস্যা, স্থানাভাবের সমাধানের জন্য চটজলদি বিদ্যালয়গুলিকে বেছে নেওয়া এবং ব্যবহার করা হয়। যেহেতু রাজ্যে সরকারি, সরকার পোষিত ও সাহায্যপ্রাপ্ত প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, মাদ্রাসা প্রভৃতি বিভিন্ন স্তরের বিদ্যালয়ের সংখ্যা বেশ কয়েক হাজার, সুতরাং সেগুলোকে সময় ও প্রয়োজনমতো পাইকারি হারে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে আপত্তি থাকার কথা নয়। সর্বোপরি বাধ্যতামূলক সরকারি নির্দেশ, ফরমান তো আছেই। সরকারি নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করলে, পূর্ণ সহযোগিতা না করলে সেই স্কুলগুলিকে অবিলম্বে ব্ল্যাক লিস্টেড, শো কজ করা হবে, সরকারি সাহায্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করা হবে। এতে বিদ্যালয়ের সুনাম নষ্ট হবে, প্রধান বা ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে এসআই আর শিক্ষা দপ্তরে জবাবদিহি করার জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে হবে। পঠন পাঠন বিঘ্নিত হবে। সর্বাপেক্ষা বিপদে পড়বে ছাত্রছাত্রীরা। লক্ষণীয় বিভিন্ন সরকারি অনুদান, সর্বশিক্ষা মিশন প্রকল্পের এবং গ্রাম পঞ্চায়েত, বিধায়ক প্রমুখ নেতাদের অর্থানুকূল্যে এবং পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয়ের উন্নতিকল্পে প্রদেয় অর্থে রাজ্যের অধিকাংশ স্কুল আর আগের মতো জরাজীর্ণ অবস্থায় নেই। একতলা থেকে দোতলা হয়েছে, শ্রেণিকক্ষের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে, নীল সাদা রঙের প্রলেপে সুসজ্জিত করা হয়েছে, পর্যাপ্ত পানীয় জলের ব্যবস্থা আর টয়লেটের সুবন্দোবস্ত করা হয়েছে। এছাড়া প্রাকটিক্যাল ক্লাস বাড়ানো, কোএড, কিছু কিছু স্কুলকে ইংরেজি মাধ্যমে উন্নীত করা হয়েছে। এক কথায় বলা যায় কপাল ফিরেছে, ভোল পাল্টেছে একাধিক স্কুলের। এই ঈর্ষণীয় আকর্ষণে যেমন কতিপয় স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা হু হু করে বেড়েছে, তেমনি আবার অনেক স্কুলে ছাত্র সংখ্যা প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। ছাত্র শূন্যতা ব্যাধিতে আক্রান্ত আজ বহু স্কুল। শিক্ষকরা আসেন আর মাসে মাসে বেতন পান। ইতিমধ্যে ছাত্রাভাবে ঝাঁপ ফেলেছে রাজ্যের একাধিক স্কুল। অবিলম্বে এই অসাম্য দূর করতে হবে। এলাকা ভিত্তিক নিঃস্বার্থভাবে সমবন্টন এবং সমানুপাতিক হারে করতে হবে ছাত্র শিক্ষক সংখ্যা। সব মিলিয়ে রাজ্যের মধ্যে চালিকা শক্তি হিসেবে বিদ্যালয়গুলি বড় ভূমিকা পালন করে থাকে।
এবার আসা যাক, আশ্রয়দাতা হিসেবে বিদ্যালয়গুলির ভূমিকা ও অবদান প্রসঙ্গে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয় কালে বিশেষত ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ, বন্যাদুর্গত শরণার্থীদের জন্য অবারিত দ্বার এবং অবাধ বিচরণ স্থলে পরিণত হয় স্কুলগুলো। ছিন্নমূল, গৃহহীন, অসহায় মানুষগুলো সপরিবারে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। কমিউনিটি কিচেন করে ঢালাও অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থাও করা হয়। সরকারি নির্দেশে আর আপৎকালীন জরুরি ভিত্তিতে অধিকাংশ স্কুল হয়ে ওঠে যেন এক একটি চ্যারিটেবল সেন্টার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। একসময় আমরা দেখেছি বিশেষ করে বিগত সরকারের আমলে বিদ্যালয়গুলো প্রায় পার্টি অফিসে রূপান্তরিত হয়েছিল। নানারকম মিটিং, পার্টি কংগ্রেসের বাৎসরিক সমাবেশ অনুষ্ঠান, দলীয় কার্যালয়ের নানাবিধ কর্মকান্ডের জন্য স্কুলগুলোকে পাইকারি হারে ব্যবহার করা হতো। এখনও অনেক ক্ষেত্রে নানারকম জাকজমক পূর্ণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিয়ে বাড়ি ভাড়া দেওয়ার জন্যও ব্যবহৃত হচ্ছে। সম্প্রতি নির্বাচনের সময় কেন্দ্রীয় বাহিনীর মোতায়েন ও আশ্রয়স্থল হিসেবে প্রধানত স্কুলগুলোকেই বেছে নেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ দিন বিদ্যালয় বন্ধ রাখতে হয়েছে, পঠন পাঠন প্রায় শিকেয় উঠেছিল বলা যায়। বাহিনী চলে যাবার পর তাদের অনেক অত্যাচারের নমুনা স্কুল কর্তৃপক্ষকে অম্লানবদনে সহ্য করতে হয়েছে। নির্বাচন কেন্দ্র হিসেবেও ব্যাপক হারে স্কুলগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে। করোনা সংক্রমণের সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়েছে। গত বছর কিছু কিছু স্কুলকে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার করে পরিযায়ী শ্রমিকদের ১৪ দিনের নিভৃতবাসে রাখা হয়েছিল। এবার সাম্প্রতিক অতিমারী পরিস্থিতিতে স্কুলগুলোকে সেফ হোমে পর্যবসিত করা হবে। অবশ্যই সাধু উদ্যোগ। এই জাতীয় বিপর্যয় ও চরম সঙ্কটকালীন মূহুর্তে যেখানে কোভিড রোগীর নূন্যতম বেড পাওয়া, অক্সিজেন পাওয়া, সেবা পাওয়া মারাত্মক সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে সেখানে স্কুলগুলোতে সেফ হোমের ব্যবস্থা করলে রোগীরা যেমন উপকৃত হবে, তেমনি হাসপাতালগুলোর স্বাস্থ্য পরিষেবার চাপও কমবে। বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও নূন্যতম মেডিকেল ট্রেনিং দিয়ে এই মহান পরিষেবার কাজে যুক্ত করা যেতে পারে। প্রাক্তন ছাত্ররাও দায়িত্ব ভাগ করে নিলে কাজে আরও গতি আসবে। স্কুলগুলো এখন বন্ধ। পরীক্ষাও পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। যতদিন পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয় স্কুলগুলোকে সেফ হোম হিসেবে ব্যবহার করা যেতেই পারে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন ক্লাব সংগঠন তাদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাকে সম্বল করে, স্টেডিয়ামে সেফ হোমের ব্যবস্থা করে করোনা রোগীর সেবাব্রত অব্যাহত রাখা হয়েছে। সম্প্রতি স্কুলগুলোকে এর আওতায় এনে মানব সেবার মহৎ কর্মকান্ডে সামিল করা হলো।
(www.theoffnews.com - school corona)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours