সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার ও শিক্ষিকা, শিবপুর, হাওড়া:

একসময় যে নারীসমাজকে প্রতিনিয়ত সমাজের যূপকাষ্ঠে মাথা দিতে হত; অন্ধকূপে যাদের দিন কাটত সেই নারী সমাজ আজ অনেক আধুনিক। আধার মুক্ত হয়ে তারা এখন আলোকজ্জ্বল। কিন্তু কার জন‍্য এই আলোর বুকে পথ চলা? আধুনিক  নারীসমাজ কি মনে রেখেছে তাঁকে? তারা তো অমাবস্যা,পূর্ণিমা উপোস তাপোসে রত। এখনও অনেকেই ধর্মের প্রকৃত অর্থ খুঁজে পাননি। ধর্মের গোঁড়ামি এখনও ঘিরে রেখেছে তাদের। 

তিনি রাজা কিন্তু তার রাজ‍্য নেই, প্রজা নেই। মন্ত্রী নেই, সেনা নেই, অস্ত্র নেই। খাজনা নেই, কর নেই।   তবু তিনি আজও রাজা। না না, কোনও রূপকথার রাজার কথা বলছি না। 

শেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ্ তাঁকে "রাজা" উপাধিতে ভূষিত করেন। সেই থেকেই তিনি "রাজা"। আমরা রাজা রামমোহন রায়ের কথা বলছি। এই তো সদ্য তাঁর আড়াইশোতম জন্মদিন পেড়িয়ে এলাম। এবার নিশ্চয় মগজের প্রোফাইলে 'রাজা' নোটিফিকেসনটি টুং করে আওয়াজ দিয়ে উঠল।

সত্যিই এই রাজা সৈন্য বা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেননি ঠিকই কিন্তু জীবনটা ছিল মহাযুদ্ধের। সেই অবোধ শিশু বয়স থেকেই শুরু। প্রথাগত ঠাকুর পুজোর নামে মুর্তি পুজো তার কাছে ছিল পুতুল খেলা। শিশু মনও চাইত পুতুল খেলতে তাই মাতামহের ঠাকুর ঘরে ঢুকে শুরু হত খেলা। মানে পুজোর উপাচার সব লন্ডভন্ড করে দিত শিশু রামমোহন। দিদিমার ঠাকুর পুজো ছিল শিশু রামমোহনের পুতুল খেলা। রোজ রোজ এই পুতুল খেলা দিদিমার রাগের কারণ হয়ে উঠল। ধর্মের গোঁড়ামিতে অন্ধ দিদিমা পাপের ভয়ে শিশুটিকে শাপশাপান্ত করতেন।

শেষমেষ বাবা রামকান্ত পাঠিয়ে দিলেন টোলে, সুদূর কাশীতে। অচিরেই সংস্কৃত শিখে রামমোহন হলেন পন্ডিত। সংস্কৃত পন্ডিত হয়ে গ্রামে ফিরতেই শুরু হল সেই ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কিন্তু নবীন কিশোর পন্ডিতকে কেউ পাত্তা দেয় না। বরং অনাচার ভেবে পুরোহিতের দল ক্ষিপ্ত হয়ে উঠত। আবার বাবা পাঠিয়ে দিলেন পাটনায়। ফার্সি শেখাতে। ফার্সিও শিখলেন এমন নিঁখুত সাধারণ মানুষ ভাবতে শুরু করল রামমোহন একজন মৌলবি।

কিশোর এখন একটু বড় হয়েছে। কুসংস্কার গোঁড়ামি দেখলেই তর্কাতর্কি শুরু করত মাতব্বরদের সাথে। প্রতিদিন নালিশ শুনতে শুনতে অতিষ্ঠ হয়ে বাবা তাড়িয়ে দিলেন বাড়ি থেকে। কোথায় যাবে কোথায় থাকবে কি করবে সবকিছুই অসহায় অনিশ্চিত। তবু সে মেনে নিল। তখন ১৫ বছর বয়স তাঁর।

ওই বয়সেই পরিব্রাজক হয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায় আর লক্ষ্য করে ধর্মের অনাচার কুসংস্কার, মানুষে মানুষে বৈষম্য আর হানাহানি। সবথেকে বিচলিত করে নারীর প্রতি চরম অবিচার। যারা না থাকলে সংসার সচল থাকত না, সেই নারীকেই স্বামীর চিতায় জোর করে পুড়িয়ে মারা? এ কোন ধর্ম! 

পথে পথে ঘুরতে একদিন ইংরেজ সিভিলিয়ান ডিগবি সাহেবের সাথে পরিচয় হয়। রামমোহনকে খুব পছন্দ হয় সাহেবের। নিয়োগ করলেন দেওয়ান পদে। নিজেই তাকে শেখালেন ইংরেজি ভাষা। 

ধীরে ধীরে তার উপার্জনের উন্নতি হয়েছে। কিন্তু নাস্তিক বিধর্মী অনেক শিরোপাও জুটেছে কপালে। যার জন্য বাবার মৃত্যুর পরও গর্ভধারিণী মাও তাঁকে পর করে দিলেন ওই শোকের দিনে। চিরদিনের মত ছিন্ন হল সম্পর্ক। 

অসম্ভব এক দুঃখ তাঁর মনে। একদিন শুনল বড়দা মারা গেছেন। বড় বৌঠানকে পাঠানো হচ্ছে সহমরণে। গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল সেই খবর। হাজার হাজার মানুষ পৈশাচিক উল্লাসে করতাল কাঁসর ঘন্টা বাজাতে বাজাতে ছুটছে বাড়ির অভিমুখে। মমতাময়ী বৌদির অসহায়ত্ব তাকে বিচলিত করল। সব অপমান ভুলে ছুটে গেল সে। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। তার চিতার সামনে প্রতিজ্ঞা করল এই বর্বরতা সে বন্ধ করবেই।

সেই কাজ মোটেও সহজ ছিল না। যুগ যুগ ধরে  অত‍্যাচারী সমাজপতিদের দাঁত নখ উপরে ফেলা মুখের কথা নয় মোটেও। কিন্তু দমবার পাত্র সে নয়। 

সাথে কতিপয় সহৃদয় ব‍্যক্তিকেও সাথে পেলেন। যদিও তাঁর নামে কুৎসা ছড়িয়ে পড়ল। লেখা হল কদর্য গান। একসময় প্রাণ সংশয় পর্যন্ত দেখা দিল। 

অনেক লড়াই করে সতীদাহ প্রথা বেআইনি ঘোষণা করা হয় ১৮২৯ সালে। ওই আইনের বিরুদ্ধে মামলাও হয়। ১৮৩০ সাল। দিল্লির সর্বশেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর শাহের আর্থিক সহায়তায় পাড়ি দিলেন ইংল্যান্ড। সেখানকার পার্লামেন্টে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে জোর সওয়াল করলেন।

১৮৩২ সালে প্রিভি কাউন্সিল পূর্বের সিন্ধান্ত বহাল রাখে। অবশেষে ১৮৩২ সালে আইন করে বন্ধ করা হল সতীদাহ প্রথা। রাজার হল জয়।

এরপর ব্রিটেনের ব্রিস্টলে এক বাড়িতে আতিথ‍্য গ্রহণ করেছিলেন। অত‍্যধিক পরিশ্রমে ১৮৩৩ সালে সেপ্টেম্বর মাসে মেনেনজাইটিস থাবা বসায় রাজার দেহে। রাজাকে হার মানতেই হল। ২৭শে সেপ্টেম্বর রাজা চলে গেলেন না ফেরার দেশে। কিন্তু তাঁর শেষ বিদায় কিন্তু রাজকীয় মর্যাদায় হল না। ইচ্ছানুযায়ী  ব্রিস্টলের ওই বাড়ির কাছে নির্জন একটি স্থানে সমাধিস্থ করা হয় তাঁকে। এর ঠিক দশ বছর পর ১৮৪৩ সালে তাঁর প্রিয়বন্ধু প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর বিলেতে যান। তিনি রামমোহনের শবাধারটি ওখান থেকে তুলে পুনরায় সমাধিস্থ করেন "আর্নেস্ট ভেল"-এ। সমাধির ওপর সুন্দর মন্দির তৈরি করেন। 

হে মহাজীবন, শতকোটি প্রণাম তোমায়। প্রকৃত অর্থে তিনি ছিলেন অন্ধকারে নিমজ্জিত নারী সমাজের এক অনন্ত আলোকদূত।

(www.theoffnews.com - Raja Rammohan Roy)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours