শেখ ফরিদ, প্রগতিশীল লেখক, বাংলাদেশ:

শুভ নববর্ষ, আজ পহেলা বৈশাখ, ১৪২৮। বাংলাদেশ সরকার, ২০১৫ সালে বাংলা নববর্ষ ভাতা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন থেকে বাংলাদেশের সকল সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা মূল বেতনের ২০%  বাংলা নববর্ষের উৎসব ভাতা পেয়ে আসছেন। 

যশোহরে প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয় ১৯৮৫ সালে। তারপর থেকে ঢাকার  চারুকলার ছাত্রদের উদ্যোগে ১৯৮৯ সাল থেকে নিয়মিত মঙ্গল শোভাযাত্রা পালিত হয়ে আসছে। যা এখন  ইউনেস্কো দ্বারা স্বীকৃত। সারা দেশব্যাপী পহেলা বৈশাখে মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। (করোনা মহামরির কারণে স্থগিত করা হয়েছে। কোথাও কোথাও সীমিত আকারে হয়তো চলবে।)  মেলায় নাচগান, পতুল নাচ, কুস্তি, নৌকা বাইচ, কবুতর বাজি, ঘোড়দৌড়, মইদৌড়, প্রভৃতির আয়োজন হয়ে থাকে।

ভারতেও বাংলা ভাষাভাষীরাও নববর্ষ পালন করে থাকে। তবে ভারতের ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গে  বাংলা নববর্ষ পালিত হয় একদিন পরে। ভারত ও বাংলাদেশ সময়ের ৩০মিনেটের ব্যবধান থাকলেও, কেন একদিন আগে ও পরে পহেলা বৈশাখ পালন করা হয়। তা এক মস্তবড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে আছে।

পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ পালনের ইতিহাস নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে৷ কোন কোন ঐতিহাসিক, মোঘল বাদশা আকবরকে এর কৃতিত্ব দিতে চান। আকবর নাকি ফসলের খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য তার রাজজোতিষী ফতুল্লা সিরাজীকে নির্দেশ দেন নতুন কেলেন্ডার বানানোর জন্য। সিরাজী হিন্দু ও মুসলিম কেলেন্ডার অনুসরন করে নয়া পদ্ধতি আবিস্কার করেন। আবার কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন, মোঘল গভর্নর মুর্শীদ কূুলি খাঁ পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ পালন শুরু করে। কোন কোন ঐতিহাসিক আকরবের আগেই আলা উদ্দিন হুসেন শাহ পহেলা বৈশাক প্রবর্তন করে বলে, মনে করেন। আবার কোন কোন ঐতিহাসিক ৭ম শতকের রাজা শশাঙ্ককে পয়লা বৈশাখের প্রবর্তণকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার  দুইটি পুরাতন শিব মন্দিরে বঙ্গাব্দের উল্লেখ করা আছে বলেও দাবি করে থাকেন কেউ কেউ। এ ছাড়ার পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীন জনপদের মানুষেরা মনে করেন, মহারাজা বিক্রমাদিত্যের কাল থেকেই এর উৎপত্তি। ইতিহাসে বাংলা নববর্ষ নিয়ে বহু বিতর্ক রয়েছে। তবে বাংলা মাসের নামগুলো অনেক প্রাচীন গ্রন্থগুলোতেও উল্লেখ করা হয়েছে, তা সত্য।

তার চেয়েও বড় সত্য অনেক আগে থেকেই বাংলা বর্ষ উদযাপন করে আসছে বাংলাভাষী হিন্দু ও মুসলিম উভয়, সম্প্রদায়ের মানুষজন। যা ব্যতিক্রমও বটে। কেন না, হিন্দু মুসলিম মিলে মিশে কোন অনুষ্ঠান পালন করার সুযোগ খুব কম। কিছু কট্টর হিন্দুরা মনে করেন পয়লা বৈশাখ হিন্দুদের সৃষ্ট উৎসব। আবার মুসলিমরাও মনে করে পহেলা বৈশাখ মুসলিমদের দ্বারা প্রচলিত। কেন না সন ও সাল শব্দ দুটি, আরবি ও ফার্সি। প্রকৃত সত্য হচ্ছে। পয়লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ না হিন্দুর, না মুসলমানদের। বাংলা নববর্ষ সকল বাঙালির উৎসব। আবার আরেক শ্রেনী রয়েছে, যারা বাংলা নববর্ষ পালন করাকে "না-জায়েজ" মনে করে থাকেন। তারা, আবার অনেকেই নিজেদের বাঙালিই  করে না। তারা নিজেদের আরব, তুর্কি ও পাকিস্তানের উত্তরসূরী মনে করেন! তারা এও মনে করে, কোন মুসলমান যদি বাংলা নববর্ষ পালন করে, তবে সে আর "মুসলমান থাকে না।"  বাংলা নববর্ষ পালন করাকে "অনৈসলামিক" মনে করে! তুর্কি,মালয়শিয়ান, ইন্দোনেশিয়ানদের নববর্ষ রয়েছে। সকলে পালনও করে। ইরানিদেরও নতুন বর্ষ  উৎসব "নওরোজ"  মহাধূমধাম করে পালন করা হয়। নওরোজ উৎসব পালন করা হয়, আফগানিস্তান, পাকিস্তান আজারাবাইজান, প্রভৃতি দেশ, সহ খোদ বাংলাদেশও। কানাডাতেও নওরোজ উৎসব রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। 

নববর্ষ পালনের এই বিরোধীতা আজকের নয়। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী অনেক ভাবেই বাংলা, বাংলার মানুষ, বাংলা সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষাকে হেয় করার অপপ্রয়াস চালিয়েছে। প্রধানত  বাংলার সকল কিছুই দাবিয়ে রাখার জন্য সব সময় ধর্মকেই তারা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। যারা এ কাজে পাকিস্তানি শাসকদের সহযোগিতা করতো। তাদের উত্তরসূরীরাই এখন, সেই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিরোধী কর্মকান্ড নামে, বেনামে চালিয়ে যাচ্ছে। এই সকল বাংলা সংস্কৃতি বিরোধীরা ধর্মের সকল "ফতোয়া", কেবল, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বিরুদ্ধেই খুঁজে পায়। তারা, ভূমি দখল, খুন, ধর্ষন -বলৎকার, ছিনতাই, চুরি ডাকতি, ছিনতাই দূর্নীতির বিরুদ্ধে "ফতোয়া" খুঁজে পায় না। ড্রাগ গ্রহন, কেনা-বেচার বিষয়ে এই "ফতোয়াবাজেরা" রহস্যজনক ভাবে নীরব। তাদের ধর্মের নামে যত আক্রমণ সব মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা শহীদ মিনার, জাতীয় সঙ্গীত, বাংলাভাষা ও সংস্কৃতিকে ঘিরে। কেবল পাকিস্তানপন্থী ও উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী নয়, এই দলে অনেকেই আছে। এমনকি, যারা বাংলা নববর্ষের উৎসব ভাতা নিচ্ছেন, তারাও অনেকই মনে করেন, বাংলা নববর্ষ উৎসব পালন করা "পাপ"!  যদিও ভাতা নেওয়ার বেলার সেটা, বেমালুম ভুলে থাকেন। সে জন্যই বোধ হয় খাঁটি বাংলা প্রবাদে আছে "পয়সা দেখলে, পাথরের পুতুলও ঠ্যাং "আলাদা" করে ধরে!" আবার একদল রয়েছে, যারা আরো বিচিত্র মানুষ, তারা বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানানোকে "গুনাহের কাজ" মনে করে থাকেন, তারাই আবার ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা জানায়!  যারা নিজেদের বাঙালি মনে করেন, পৃথিবীর সে সব বাঙালিকে, বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা। (www.theoffnews.com - Bangladesh Bengali nababarsha)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours