সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার ও শিক্ষিকা, শিবপুর, হাওয়া:
"নিশি অবসান, ওই পুরাতন বর্ষ হয় গত,
আমি আজি ধূলিতলে এ জীর্ণ জীবন করিলাম নত।
বন্ধু হও, শত্রু হও, সেখানে যে কেহ রও, ক্ষমা কর আজিকার মতো,
পুরাতন বছরের সাথে পুরাতন অপরাধ যত।"
সত্যি কি তাই হবার মত? পুরাতন অপরাধে আর ক্ষমা প্রার্থী হবার যোগ্যতা কি আছে? বৈশাখ তখনও একলা ছিল আজও একলা। পুরো একটা বছর কেটে গেলেও আজও আমাদের করোনা মুক্তি হলো না। রোগের টীকা আবিষ্কার হলেও তা কিন্তু সম্পূর্ণ রোগ মুক্তির উপায় নয়। রোগের কারণ এখনও অজানা। অজানা হলেও একেতো আমাদের প্রকৃতির ওপর যথেচ্ছাচারের ফলও তো ভাবতে পারি। যদি বলি এই মহামারী আজ প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধ; তবে কি খুব ভুল বলব?
আফ্রিকার উবুন্টু সম্প্রদায়ের কথাটা বড়ো সুন্দর "আমি আছি কারণ তুমি আছ তাই।" কিন্তু কোথায়? নিজের স্বার্থে প্রকৃতিকে কাজে লাগিয়েছি। গাছ কেটে ধ্বংস করেছি; দূষণে ভরিয়ে ফেলেছি। নিত্যনূতন প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে গিয়ে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করেছি। প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করেছি, আরও কত যে অপরাধ করেছি! আজ পৃথিবীর জলবায়ুও ভীষণ ভাবে খামখেয়ালী। কালবৈশাখীর আগমনও খুব বিরল হয়ে দাঁড়িয়েছে এই বাংলায়।
২০২১য়ে নববর্ষ এক অদ্ভুত পালাবদলের মুখোমুখি। অভূতপূর্বও বটে! প্রথমত করোনা ভাইরাসের আক্রমণ যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আর এই ভাইরাসের দাপটে বাঙালির চিরাচরিত বছরের প্রথমদিনে পুজোপাঠ করে যে হালখাতার সূচনা হয় এবার যেন তা আরও বেশী বেহাল।
দ্বিতীয়ত বাংলার বিধানসভা নির্বাচন। এবারের নির্বাচনে হিন্দি বলয়ের প্রভাব উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন হিন্দি ভাষী নেতা মন্ত্রীদের অস্বাভাবিক বাংলা প্রীতি প্রকৃত বঙ্গভাষীদের কাছে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি শোনা গেল এক নেতার বিকৃত উচ্চারণে বাংলা ভাষণ। এতে তাঁর বক্তব্যের প্রকৃত অর্থটা অশালীন রূপ পেয়েছে। যা অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক। যা বাংলার কাছে অপমানজনকও বটে। তাই এবছরের নববর্ষে বাঙালির আশা ভরসার সাথে বাংলা ভাষারও পুনরুজ্জীবন হোক। এ ভাষাতেই মাইকেল; রবীন্দ্রনাথ; নজরুল; জীবনানন্দ; সুনীল; সমরেশ; কালকূট; শামসুর রহমান; জসীমুদ্দীন লিখে গেছেন তাঁদের অসামান্য কালজয়ী উপন্যাস বা কাব্য গাঁথা। নেতাজী, ক্ষুদিরাম বিনয়, বাদল, দীনেশ সবাই বাংলায় কথা বলতেন। স্বর্ণকুমারী দেবী বেগম রোকেয়া; কিম্বা রাধারাণি দেবী সবাই কলম তুলে ছিলেন এই বাংলায়। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু মেঘনাদ সাহা প্রমুখ বিজ্ঞানীরা ছিলেন আদ্যপান্ত বাঙালী। বিজ্ঞানী প্রফুল্ল চন্দ্র রায় একজন উদ্যোগপতিও ছিলেন; যার ফল হল বেঙ্গল কেমিক্যাল। সত্যজিত রায় অস্কার পেলেন পথের পাঁচালি সিনেমার জন্য সেও তো বাংলা তে। পথের পাঁচালির রচয়িতা শ্রী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে তিনিও একজন বাঙালি।
ঔপনিবেশিক সময়ে সিরাজকে পরাস্ত করতে মীরজাফর ছাড়াও জগৎশেঠ; উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ এদের বিশ্বাস ঘাতকতার কলঙ্কময় কাহিনী ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়ে আছে। আজ আবার এক সঙ্কটের মুখোমুখি! বাংলায় কি তবে হিন্দি আবহ বিরাজ করবে?
ইতিহাসে পড়া ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের কাহিনী মনে পড়ছে। কবি পথে নেমেছিলেন এর বিরুদ্ধে। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবার হাতে রাখি পড়িয়ে গেয়েছিলেন "বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল--
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।"
আমাদের এই নববর্ষে হোক আমাদের ঐতিহ্য পরম্পরা বাঁচিয়ে রাখার শপথ। বাঙালি কি খাবে? কি পড়বে? বাঙালির ধর্ম কি হবে? তা যেন রাষ্ট্র ঠিক না করে। "আপনি আচরি ধর্ম"এই সত্য বাংলায় বেঁচে থাক। নববর্ষ আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা ভাবনাকে অপরাজেয় ও মহিমান্বিত করুক। নববর্ষ শুভ হোক, শুভ চেতনা জাগরিত হোক সমাজের প্রতিটি স্তরে।
রোগ মুক্তি হোক বাংলা তথা সারা দেশে তথা সারা বিশ্বে। হালখাতার পালে অর্থনৈতিক পুনুরুজ্জীবনের বাতাস লাগুক। শ্রী গোপাল কৃষ্ণ গোখেল বলে ছিলেন "what Bengal thinks today, India thinks tomorrow." তাই নববর্ষ ১৪২৮ হোক আগামীতে পথচলার প্রস্তুতির পদক্ষেপ। সেই সাথে ভুললে চলবে না ঠাকুরের চিরন্তন বাণি "যত মত তত পথ"। এই আপ্তবাক্যে ভর করে বাঙালি এগিয়ে চলেছে এবং এগিয়ে যাবে।
কবিগুরুর ভাষাতেই শেষ করি "বাঙালির পণ, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা-- সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক হে ভগবান।
বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন-- এক হউক এক হউক হে ভগবান।"
ভুলে গিয়ে জীর্ণ কালিমার শোক
১৪২৮ নববর্ষে সবার মঙ্গল হোক।
(www.theoffnews.com - Bengali nababarsha)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours