তৃপ্তি মিত্র, লেখিকা ও আবৃত্তিকার, কলকাতা:

গ্রাম পাল্টে শহরকে ছুঁয়েছে বহু দিন। কিন্তু রেখে গেছে কিছু স্মৃতি৷ কলকাতা শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণে চলে গেছে ১১৭ নং ন্যাশনাল হাইওয়ে৷ যা ডায়মন্ড হারবার রোড নামে পরিচিত৷ ডায়মন্ড হারবার রাস্তার সমান্তরালে চলে গেছে এখনকার ব্যস্ততম রাস্তা "জেমস লং সরণি"লোকমুখে যে রাস্তাটি রেল লাইন বলে অধিক পরিচিত৷

আমার মতো অনেকেরই মনে প্রশ্ন জাগতে পারে রেলের নাম নেই গন্ধ নেই খামোখা কেনই বা এমন নাম৷ যদিও আমি আমার সন্দেহ দূর করে ফেলেছি শৈশবেই৷ ঠাকুরমার সঙ্গে জেমস লং সরণি ধরে যেতে যেতে একদিন আবিস্কার করে ফেললাম৷ পিচ ঢালাই রাস্তার পাশের ভাঙ্গা অংশ থেকে বেরিয়ে আছে বহু যুগ আগের পুরনো রেল লাইনের সেই পাত৷ এরপর প্রশ্নবানে অতিষ্ট ঠাকুরমা একে একে সব বুঝিয়ে দিলেন৷ যা আজও ছবির মতো পরিস্কার৷ জেমস লং সরণি লাগোয়া বাসস্থান থাকায় বড়োদের নিষেধ এবং সাবধান বানী উপেক্ষা করার উপায় ছিল না৷ তবুও কৌতুহলী মন বারবার এই রাস্তার দিকে চলে আসতো৷ শৈশবেই আমাদের সতর্ক করে দেওয়া হত যেখানেই খেলাধুলা করিনা কেন, জেমস লং সরণি অর্থাৎ রেললাইনে যাওয়া একদম বারন৷ এই রাস্তার অশেপাশে নাকি এক সময় অনেক কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে৷ অতএব এই রাস্তায় ভূত থাকাটা অমুলক কিছু নয়৷ আজও সেই স্মৃতি মনে পড়লে ভয়ে কুঁকড়ে যাই৷ সেকি ভয়ংকর শূন্যতা, চারদিক শুনসান, জনমানুষ শূন্য, কালো কুচকুচে দীর্ঘ সাপের মতো এক রাস্তা৷ যে রাস্তাকে বয়সের সাথে সাথে মাড়িয়েই বড়ো হয়েছি৷ শৈশব, কিশোরীবেলা, যৌবনবেলা কত না স্মৃতির সাক্ষী এই রাস্তা৷

এখনও ঠাকুরমার সেই কথাগুলি আনমনে আওড়ানোর চেষ্টা করি৷ সত্যি ভাবতেই অবাক লাগে এখানে নাকি এক সময় বিস্তৃত ছিল আদিগন্ত ধানখেত, জলাভূমি, ঝোপঝাড় আর ছিল বাংলার বট, পাকুড়, শিরীষ, বকুলের ছায়ায় ঘেরা প্রান্তর৷ এই গ্রাম বাংলাতেই নাকি উৎপন্ন হত কয়েক শো প্রজাতির ধান৷ ছিল নানা লতা-গুল্ম, ওষধি ভেষজ উদ্ভিদ ও নানা প্রজাতির ফুল ও ফল৷ এখন সেই পল্লী বাংলাকে খোঁজার চেষ্টা বৃথা৷ এখনের জেমস লং সরণির দুই পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে আকাশ ছোঁয়া বিশাল বিশাল ফ্লাট বাড়ি, শপিং মল, পার্লার, সরকারি বেসরকারি স্কুল, অফিস, ফায়ার বিগ্রেড, স্টেডিয়াম, কল-কারখানা, পার্ক আরও কত কি৷ সেই আকাশ ছোঁয়া ফ্লাট বাড়ির কোন ভিন রাজ্যের বাসিন্দা ভাবতেই পারেন৷ কে এই জেমস লং? আর কেনই বা জেমস লং সরণি?

ফাদার রেভারেন্ড জেমস লং যিনি ছিলেন আইরিশ৷ তিনি ১৮৫০ সালে ঠাকুরপুকুরে আসেন৷ অবশ্য খৃষ্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ১৮৪০ সালে তিনি ভারতে আসেন৷ ওনার মতো ভারত বন্ধু খুব কম আছেন৷ যদিও উইলিয়াম জোন্স, বেথুন সাহেব, ডেভিড হেয়ার, আলেকজেন্ডার ডাফ প্রমুখ প্রাতঃস্মরণীয় বঙ্গবন্ধুরা কোন অংশে কম ছিলেন না৷ তবে ফাদার লং ছিলেন সকলের উর্ধ্বে৷ তিনি ছিলেন বঙ্গজীবনের প্রকৃত প্রাণ৷ বঙ্গ জীবনে তাঁর অবদান অপরিসীম এবং অবিস্মরণীয়৷ তিনি এই জনপদের শিক্ষাবিস্তারে যেমন অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তেমনি এখানকার জনজীবনের সঙ্গে ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠযোগ৷ তিনি কেবল খৃষ্টধর্ম প্রচারক হিসেবে সীমাবদ্ধ ছিলেন না৷ ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি বাংলার সমাজ জীবন, সমাজ বিজ্ঞান, লোকসাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা ভাষা, ইতিহাস চর্চা, কৃষিবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা এবং পুরাতত্ব প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল অগাধ৷ তাঁর কর্মধারা ছিল বহুমুখী ও বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ৷

বেথুন সাহেব একদা কলকাতায় মেয়েদের স্কুল গড়ে তুলছেন, হেয়ার সাহেব যখন হিন্দু কলেজ গড়ে তুলছেন৷ ফাদার লং এবং তাঁর সহধর্মিনী এমিলি ওর্মে প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে ঘুরে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করছেন সেই সব মানুষদের যারা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত এবং যেখানে শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি সেখানে গড়ে তুলেছেন বিদ্যালয়। যে বিদ্যালয়ে সব ধর্মের, সব স্তরের ছেলে মেয়েরা পড়ার সুযোগ পেত৷ তখনকার সমাজে মেয়েদের অক্ষর জ্ঞানকে পাপ কাজের সমান বলে গণ্য করা হত। একটু স্বচ্ছল ঘরের মেয়েরা পড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে ছিল সমাজের চোখ রাঙানি৷ তবুও অনেক মেয়েরা সব কিছু উপেক্ষা করে এমিলি ও লং সাহেবের স্কুলে পড়তে যেত৷ লং সাহেব মেয়েদের পড়াশুনার পাশাপাশি হাতের কাজের শিক্ষাতেও পারদর্শী করে তুলতেন৷ ঠাকুরপুকুর, জোকা, কেওড়াপুকুর, সরশুনা, হাঁসপুকুর প্রভৃতি অঞ্চলে জেমস লং এবং তাঁর স্ত্রী দুজনে মিলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে অপরিসীম পরিশ্রম করেছিলেন৷ সে সময় ছোট ছোট নদী পথ ছাড়া যাতায়াতের তেমন কোন ব্যবস্থা ছিল না৷ সালতী বা ডোঙ্গা চেপে পৌঁছে যেতেন সেই সব প্রত্যন্ত গ্রামে৷ বর্তমানে ঠাকুরপুকুরে "এপিফ্যানি চার্চ" সংলগ্ন বিদ্যালয়টি অতীত দিনের লং সাহেবের কীর্তির সেই নস্টালজিক নিদর্শন৷

তিনি সর্বদা মানুষের মানবিক গুনের প্রতি শ্রদ্ধাবান ছিলেন৷ সেখানে ধর্ম, জাত-পাত কোনও কিছুই ঠাঁই পেত না। এজন্য তিনি সবার প্রিয় পাত্র ছিলেন৷ এছাড়া মানুষের প্রতি ছিল তাঁর অনাবিল ভালোবাসা৷ যে ভালোবাসার সাক্ষী ছিলেন স্বয়ং বিদ্যাসাগর মহাশয়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশব চন্দ্র সেন, রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র, প্যারীচাঁদ মিত্র, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ প্রমুখ প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিগন৷

বিদেশি হয়েও বাংলা ভাষার প্রতি ছিল তাঁর সাবলীল আধিপত্য। "নীলদর্পণ" নাটকটি তিনি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। ( অবশ্য শোনা যায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত অনুবাদক হিসাবে তাঁকে সহযোগীতা করেছিলেন)। এর জন্য তাঁকে একমাস কারাবাস ও এক হাজার টাকা জরিমানা দিতে হয়েছিল৷ এছাড়া তিনি "সত্যার্ণব" নামে একটি পত্রিকার সম্পাদনার কাজে নিযুক্ত ছিলেন৷ যেখানে সব ধর্মের প্রতি সম্মান জানিয়ে সাহিত্য চর্চা করার সুযোগ পেতেন বহু মানুষ৷ তাঁর অনেক চিঠি পত্র এবং বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত লেখায় ভারতের অতীত ইতিহাসের সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণ আছে৷ যেখানে ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের হাস্যকর অজ্ঞতা প্রমানিত হয়েছে৷ তাঁর চেষ্টাতে প্রথম বাংলা বইয়ের ক্যাটালগ তৈরী সম্ভব হয়েছিল৷ এই ক্যাটালগে ১৮৫২ সাল অবধি বাংলা বই এর তালিকা লিপিবদ্ধ করা ছিল৷ যা না থাকলে বহু প্রচীন বাংলা বই হারিয়ে যেত৷ এই ক্যাটালগে ১০৪৬টি বইয়ের পাশাপাশি রাখা ছিল পাঁচশো জন সাহিত্যিকের সংক্ষিপ্ত পরিচয়৷ এছাড়া তিনি আইন করে বন্ধ করে দেন অশ্লীল বই ছাপানো৷

জেমস লং এর অবদানের কথা বলে শেষ করা যাবে না৷ সর্বপরি স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারে ফাদার লং এবং তাঁর স্ত্রী এমিলি ওর্মের অবদানের কথা বাংলার মানুষ কোন দিনই ভুলতে পারেনি। তাই ১৮৭২ সালে তিনি যখন ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যান। তখন আঞ্চলিক সভ্যরা সমবেত ভাবে একটি মানপত্রে ফাদার লং এর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন - আপনি এই অঞ্চলের মঙ্গলের জন্য যা যা করেছেন এবং তার জন্য যে মানসিক ও শারীরিক ভাবে যে শ্রম স্বীকার করেছেন। তা কখনওই মুছে যাবার নয়৷ তাই তাঁর নাম চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য কেএফআর রাস্তার পরিবর্তিত নামকরণ করা হয় জেমস লং এর নামে।

নিশ্চয়ই ভাবছেন, এই কেএফআর রাস্তা আবার কোনটি? তাই তো? এবার আরও একটি পুরনো ইতিহাসের অবতারনা করতেই হয়৷ লন্ডনের ম্যাকলয়েড কোম্পানির সৌজন্যে ১৯১৭ সালের ২৮ শে মে দীর্ঘ ২৬.৯৫ মাইল কেএফআর লাইনটির উদ্ভোধন করেন৷ যে লাইনটি প্রথমে বেহালার ঘোলসাহাপুর থেকে ফলতা পর্যন্ত প্রসারিত ছিল৷ পরে অবশ্য মাঝের হাট পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয়। যার নাম ম্যাকলয়েড রেলওয়ে হলেও লোক মুখে কালীঘাট ফলতা রেলওয়ে (কেএফআর) নামে অধিক পরিচিত ছিল৷ যদিও রেলগাড়ি কিন্তু কালীঘাট পর্যন্ত যেত না৷ মাঝের হাট পর্যন্তই ছিল শেষ স্টেশন৷ তাই মাঝের হাটে নেমে গরুর গাড়ি বা পায়ে হেঁটে মন্দিরে পৌঁছাতে হত৷ মাঝের হাট থেকে ফলতা পর্যন্ত মোট তেতাল্লিশ কিলোমিটার রাস্তায় আঠেরোটি স্টেশন ছিল৷ অবশ্য তাতে অসুবিধার কিছু ছিল না৷ হাঁক দিয়ে থামিয়ে দেওয়া হত রেলগাড়ি৷ ভাবতেও দারুণ লাগে কি সুন্দর সহজ সরল জীবন যাপনে একসময়ে আমরা অভ্যস্থ ছিলাম৷

ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে ম্যাকলয়েড কোম্পানি ভারতবর্ষ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে চলে যায়। কিন্তু কেএফআর নামটি রয়ে যায় যা লোকমুখে পরিবর্তিত হতে হতে রেল লাইন হয়ে যায়৷ যার ফলে কেএফআর নামটি ম্লান হয়ে যায়। অবশেষে ১৯৫৭ সালে কালীঘাট ফলতা লাইনটি বন্ধ হয়ে যায়৷ পরে নব নির্মিত ভারতবর্ষ ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার রেলের সমস্ত জমি পুনরুদ্ধার করে নেন৷ যে পথে এই রেলওয়ে ট্রাক প্রসারিত ছিল (কালীঘাট থেকে ফলতা) অর্থাৎ অতীতে যাকে কেএফআর বলা হত৷ কালক্রমে সেটি একটি রাস্তায় রূপান্তরিত হয়৷ রেভারেন্ড জেমস লং এর প্রতি শ্রদ্ধার কথা স্মরণ করে বেহালা ও ঠাকুরপুকুরের আঞ্চলিক সভ্যরা ফাদার লং এর অবদানের কথা মাথায় রেখে নবনির্মিত রাস্তাটির নাম করন করেন তাঁরই নামে। যে রাস্তাটি আজ আমাদের কাছে বেহালা জেমস লং সরণি নামে খ্যাত।

তথ্যসূত্র:

বেহালা জনপদের ইতিহাস—সুধীন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

বঙ্গ জীবনে জেমস লং—স্বপন মুখোপাধ্যায়

এবং বিভিন্ন পত্র পত্রিকা

(www.theoffnews.com - James Long Sarani)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours