পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

ক্ষমতায় এলে সোনার বাংলা গড়বে বিজেপি। দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও সব চেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের সভাপতি সকলেই উচ্চস্বরের বারংবার জানিয়েছেন সে কথা। তাদের বিচিত্র উচ্চারণে বাংলা সোনার বা সুনার হবে কিনা সে প্রসঙ্গ এখানে থাক। এখানে বরং কিছু অপ্রিয় কথা আলোচনা করা যাক। বাংলা নামেই যাদের আপত্তি, বাংলা নামটি যারা অনুমোদনই করে না তারা কি করে সোনার বাংলা গড়বার ঘোষণা করে তা নিয়ে আমার বেশ খটমটই লাগছে। 

২০১৬-র অক্টোবরে রাজ্যের নাম বদল করার প্রস্তাব গৃহীত হয় বিধানসভায়। সর্বদলমত নির্বিশেষে রাজ্যের 'পশ্চিমবঙ্গ' নাম বদলে নতুন নাম রাখার বিষয়ে সম্মতি জানায় সকলেই। বাংলা, ইংরেজি ও হিন্দি তিনটি ভাষায় তিনটি নাম বাছা হয়- বঙ্গ, বেঙ্গল ও বঙ্গাল। কিন্তু রাজ্যের সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় কেন্দ্র। পৃথক পৃথক নাম নয়, তিনটি ভাষাতেই এক নাম হতে হবে বলে রাজ্যকে জানায় কেন্দ্র। এরপরই রাজ্য সরকার রাজ্যের নাম ৩ ভাষাতেই 'বাংলা' রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে বিধানসভায় সর্বসম্মতভাবে রাজ্যের নাম ‘বাংলা’ রাখার সিদ্ধান্ত পাশ হয়। সর্বসম্মতির ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়ে নাম বদলের সেই প্রস্তাব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কাছে পাঠায় রাজ্য। কিন্তু সেখানেও না করে দেয় কেন্দ্র তথা বিজেপি সরকার। ৩ বার রাজ্যের নাম বদলের প্রস্তাব ফেরায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। 

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের যুক্তি ছিল রাজ্যের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ। সেখানেও নামে 'বাংলা' রয়েছে। ফলে তা নিয়ে জটিলতা হতে পারে। সেই সময়েই পঞ্জাবের উদাহরণ তুলে ধরে পাল্টা সওয়াল করে রাজ্য সরকার। রাজ্যের যুক্তি ছিল, পাকিস্তানেও 'পঞ্জাব' নামে একটি প্রভিন্স রয়েছে। আবার এদিকে ভারতেও 'পঞ্জাব' নামে রাজ্য রয়েছে। তাতে যদি কোনও সমস্যা না হয়ে থাকে, তবে এক্ষেত্রে সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা অযৌক্তিক। কারণ পড়শি দেশের সম্পূর্ণ নাম বাংলাদেশ।

যাই হোক এ গল্প অনেকেরই জানা। কথা হচ্ছে এর আগে বেশ কিছু রাজ্যের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। বিজেপি সরকারে থাকাকালীন বহু জায়গার বা বড় শহরের নাম পরিবর্তন করেছে। ইলাহাবাদের নাম তারা প্রয়াগরাজ করেছে। পাল্টে দিয়েছে বহু পরিচিত মুঘলসরাই নামটিও। দিন দয়াল উপাধ্যায়ের নামে মুঘলসরাই স্টেশনের নাম হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের নাম বদলের ক্ষেত্রে তাদের এই কাঠিন্য বেশ অবাক করে আমাদের। 

এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অতীতে বামেরা পশ্চিমবঙ্গের নাম বদলাতে চাইলেও এ বিষয়ে তীব্র বিরোধিতা রয়েছে গেরুয়া শিবিরের। কিন্তু হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি এ রাজ্যের বেশ কিছু এলাকার নাম পরিবর্তন করতে চাইছে। সে বিষয়ে বিজেপি নেতাদের প্রত্যক্ষ সমর্থন রয়েছে।  উদাহরণে বলা যেতে পারে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কথা। ভিএইচপি প্রশাসনিক স্তরে পত্র বিনিময়ের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই রাজ্যের বেশ কিছু জায়গার নাম বদল করে ফেলেছে। যেমন, পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুককে ‘তাম্রলিপ্ত’, উত্তরদিনাজপুরের ইসলামপুরকে ‘ঈশ্বরপুর’, মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জকে ‘বালুচর’, বহরমপুরকে ‘ব্রহ্মপুর’, বীরভূমের মহম্মদ বাজারকে ‘মহাদেবপুর’, নামেই সাংগঠনিক কাজে মান্যতা দিচ্ছে তারা। তালিকা এখানেই শেষ নয়, রাজ্যের আরও বেশ কিছু এলাকার নাম পরিবর্তনের দাবি রয়েছে এই হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির। একটি সাক্ষাৎকারে দেখছিলাম রাজ্য বিজেপির এক নেতা বলছিলেন তারা এ বিষয়কে সমর্থন করেন, রাজ্যে ক্ষমতায় এলে এ ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়ে ভাববেন। 

অর্থাৎ রাজ্যের নাম বাংলা হলে বিজেপির আপত্তি আছে। কিন্তু রাজ্যের অন্য যে কোনও জায়গার নাম বদল হলে তাদের আপত্তি তো নেইই, বরং তারা সেই চেষ্টাই করবেন। এ এক অদ্ভুত যুক্তি। অথবা কোনও যুক্তিই নেই। আমার প্রশ্ন, তাহলে সোনার বাংলার কথা তোলা হচ্ছে কেন? সোনার পশ্চিমবঙ্গ বললেও তো হত। রাজ্য সরকার কিন্তু তাদের চিঠিতে বিশ্বকবির সোনার বাংলার উল্লেখ করেছিল। সেই চিঠি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকে পাঠানো হয়, সেখান থেকেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হয়তো সোনার বাংলার উল্লেখ পেয়ে থাকবেন। তাই তো বাংলাতে তার বা তাদের আপত্তি থাকলেও ভোট প্রচারে সোনার বাংলা কথাটি খুব মনে ধরেছে তাদের। ভোট প্রচারে বিজেপির স্লোগানে “সোনার বাংলা” তো হিট, এবার কি তবে বাংলার জন্য বাংলা শব্দটিতে তাদের আপত্তি মিটবে? কে জানে। খেলা শেষের পরে তো আর মাঠে কেউ থাকে না। শূন্য মাঠ পড়ে থাকে জয় পরাজয়ের সাক্ষী হয়ে, খেলোয়াড়দের পদদলনে মুহ্যমান ঘাসগুলি পড়ে থাকে নতুন বৃষ্টির আশায়। ভোট প্রচারে কাজে এলেও, বাংলার বোধহয় আর বাংলা হওয়া হল না।

(www.theoffnews.com - West Bengal change name Bangla sonar bangla)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours