শ্রীজীতা ঘোষ, ফিচার রাইটার, দুর্গাপুর:

একটি ছাত্রের মা শৈশবেই মারা গেছেন। বাবা দেশের বাড়িতে খামার কাজে কোনওমতে দিন গুজরান করেন। শিল্পশহরের এক আত্মীয়ের বাড়িতে থেকেই স্কুলের পড়াশোনা। এমন অসহায়তা শুনে স্কুল কর্তৃপক্ষ তার লেখাপড়ায় যাবতীয় সহায়তা করে চলেছেন দরাজ হস্তে। কারণ ছাত্রটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময়।

এখানেই শেষ নয়। একটি ছাত্রীর বাবা টোটো চালিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলছেন দিবারাত্রি। কিন্তু পড়ুয়াটি যে খুবই মেধাবী। অগত্যা মুশকিল আসান সেই স্কুল কর্তৃপক্ষ। ছাত্রীর স্কুল ফিজে ঢালাও ছাড়।

কি ভাবছেন? এ আর এমনকি! এরকম দুই চারটে উদাহরণ মোটামুটি ভাবে সব ইংরাজি মাধ্যম বেসরকারি স্কুলে মিলবেই মিলবে। একদম সঠিক। কিন্তু যদি দেখা যায়, হাজার তিনেক ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রতিবছর তিনশোর বেশি পড়ুয়ার আর্থিক ফিজের ক্ষেত্রে নানা পর্যায়ে শিথিল করে চলেছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ ধারাবাহিক ভাবে, তবে! শুধুমাত্র স্কুল কর্তৃপক্ষই বা কেন, স্কুলে কর্মরত শ'খানেক শিক্ষক শিক্ষিকারা সমবেতভাবে সারা বছরভর তাঁদের বেতন থেকে টাকা জমান নিয়মিত। কারণ একটাই। স্কুলে যে এমন অনেক ছাত্র ছাত্রী আছে যাদের স্কুল ড্রেস কেনার সামর্থ্যও থাকে না একেক সময়ে। তাতে কি হয়েছে? সমস্যা মোকাবেলায় তখন খুশি মনে সেই সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করেন গুরুকুল। এমনই এক আত্মিক সম্পর্কের পীঠস্থান এই স্কুল। প্রশ্ন উঠবেই, তাহলে এটা কোন স্কুল? আসলে আমজনতার মুখে মুখে ঘুরতে থাকা এহেন স্কুলের নাম 'গুরু তেগ বাহাদুর পাবলিক স্কুল'। পশ্চিম বর্ধমান জেলার দুর্গাপুরে স্কুলটি স্থাপিত হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। লোয়ার কেজি থেকে দ্বাদশ শ্রেণির এই বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলটি সিবিএসসি'র অনুমোদিত।

এমনই এক সুপরিচিত স্কুলে সম্প্রতি একদল স্থানীয় লোকজনের মদতে পরিস্থিতি ক্রমেই ঘোরালো হয়ে উঠেছে। যে কারণে ক্ষুব্ধ সংশ্লিষ্ট শিক্ষকমন্ডলী থেকে বৃহত্তর অংশের অভিভাবকেরা। কিছু অভিভাবকের দাবি, "আমরা তো স্কুলের নিয়মকানুন জেনেই আমাদের বাড়ির সন্তানকে এই স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। স্কুল কর্তৃপক্ষ কখনই উপযাজক হয়ে এখানে কাউকে ভর্তি করা নিয়ে বাধ্য করায় না। বরং লকডাউনের মধ্যেও স্কুল ফিজ নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট শিথিলতা দেখিয়েছেন।" তাঁদের মন্তব্য, এই শিথিলতার পড়েও অনেক অভিভাবক আর্থিক সমস্যা এড়াতে পারেননি করোনা মহামারীর মধ্যে। স্কুল থেকে সেই অভিভাবকদের কাছ থেকে আবেদনপত্র চেয়ে পর্যায়ক্রমে তা যথাসম্ভব সুরাহার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের হল একদল মানুষ স্কুলের গেটের সামনে অরাজক পরিবেশ তৈরি করছে পরিকল্পিত ভাবে। যা তাঁরা কাম্য করেন না বলেই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় মন্তব্য করেছেন।

সম্প্রতি অভিভাবকদের একটা বড় অংশ পড়ুয়াদের রিপোর্ট কার্ড সংগ্রহ করতে স্কুলে এসেছিলেন। কোনও কোনও অভিভাবক সেশন ফিজ জমা দেবার উদ্দেশ্যে স্কুলে ঢুকতে চান। তাঁদের স্কুলের ভিতরে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। সেই অভিভাবকেরা ক্ষোভের সঙ্গে সাফ বলেন, "আদালতের নির্দেশ মেনে স্কুল থেকে সেশন ফিজ নেওয়া হচ্ছে। আমরা তা দিতে রাজি এবং তার জমানো দিতে চাই। আমাদের মধ্যে কেউ সমস্যায় পড়লে আমরা লিখিত ভাবে স্কুলকে জানাচ্ছি এই বিষয়ে। স্কুলও যথারীতি আদালতের রায় মেনে নির্ধারিত সেশন ফিজ দেওয়ার বিষয়ে নানা বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এরপরেও কেন এসব ঘেরাও হচ্ছে গেটে?" আরও কিছু অভিভাবকের বক্তব্য, "যাঁরা স্কুল গেট ঘেরাও করে স্কুলের সামনে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবেশ তৈরি করছেন তাঁদের মধ্যে জনা কয়েক বাদ দিলে অধিকাংশই এই স্কুলের অভিভাবক পর্যন্ত নন। তাই তাঁদের কোনও দাবি মানার দায় আমাদের নেই। তাঁদের বেঁধে দেওয়া ফিজ আমরা কেন মানতে যাব? তাঁদের তো কোনও বৈধতাই নেই এবিষয়ে। এতো গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল'এর মতো আচরণ।"

স্কুলের প্রিন্সিপাল সুতপা আচার্য বলেন, "স্কুল গেটের সামনে এইসব ঘেরাও করে যে যা খুশি দাবি করবে, তা মেনে নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমরা আবার বলবো কোনও অভিভাবক সমস্যায় পড়লে তিনি অবশ্যই আমাদের জানান লিখিত ভাবে। আমরাও চেষ্টা করবো নানা বিকল্প নিয়ে আলোচনা করার। কিন্তু যাঁরা এই স্কুলের অভিভাবক নন তাঁদের সম্পর্কে একটাই বক্তব্য, স্কুলগেট স্বাভাবিক রাখুন।" তিনি আরও জানান, "গেট অবরুদ্ধ করেছিল বলে আমাদের এক শিক্ষিকা জখম পর্যন্ত হয়েছেন। আমরা পুলিশকে জানালে পুলিশ এসে পরিস্থিতি সামাল দেয়। এই ঘটনা অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক।"

এই ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন একাংশ স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁদের মতামত, এই স্কুল তো বরাবরই পড়াশোনার মান ও পরিবেশ ভালোভাবে বজায় রেখেছে। এমনকি করোনার আবহে প্রশাসন ও আদালতের নির্দেশ মেনে অভিভাবকদের পাশে এখনও যথাসম্ভব থাকছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। তাহলে সংশ্লিষ্ট স্কুল সম্পর্কহীন মানুষের জমায়েত গেটের সামনে কোন বৈধতায় কেন সংগঠিত হচ্ছে। আর মহকুমা প্রশাসনইবা কি করছে বলে তাঁদের সম্মিলিত প্রশ্ন এখন ভেসে বেড়াচ্ছে এখন দুর্গাপুর শহরের অলিতে গলিতে।

(www.theoffnews.com - Guru Teg Bahadur Public School Durgapur agitation)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours