মল্লিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার ও লেকচারার, আহমেদাবাদ:

গুজরাটের চারণ সম্প্রদায়ের মানুষদের আরাধ্য দেবতা এই খোদিয়ার মাতা। কর্তার অফিসের একটি ছেলে একবার আনন্দ থেকে এসেছিল আমাদের বাড়ীতে, তারই হোয়াটসঅ্যাপে প্রথম দেখি এই কুমির বাহিনী মাতৃমুর্তি। এরপর ওর মুখেই জানতে পারি গুজরাট রাজস্থান বর্ডারে থাকা চারণ সম্প্রদায়ের সব মনষ্কামনা পূরণ করেন এই খোদিয়ার মাতা। নিজেও হাঁটতে গিয়ে সবসময়  খোঁড়াই তাই খোঁড়া দেবীকে দেখে তাঁর ইতিহাস নিয়েও একটু খোঁড়াখুঁড়ি করতে সাধ হল---উঠে এল সপ্তম শতাব্দীর এক উপকথা। তবে আমি উপকথা বা রূপকথা যাই বলি না কেন ভাবনগর, জামনগর, মটেল সব জায়গায় এনার বিশাল মন্দির, গোটা সৌরাষ্ট্র আর কাথিয়াবাড়ে ওনার ভক্তরা ছড়িয়ে আছেন। তাদের মনের বড় কাছের এই মা, ডাকলেই যে তিনি সাড়া দেন। ভক্তদের বিশ্বাস তাড়াতাড়ি আসতে গিয়ে চোট পেয়েই তো মা খুঁড়িয়ে চলেন, তাই ভক্তের ডাক উপেক্ষা করেন না। আর কুমিরের যেহেতু জলে স্থলে দুটোতেই অবাধ বিচরণ তাই মা নিজের বাহন হিসেবে বেছে নিয়েছেন কুমিরকে।এবার আসি খোদিয়ার মাতার জন্ম গাথায়। সপ্তম শতাব্দীতে ভাবনগরের ভল্লবীপুর প্রদেশের মহারাজা ছিলেন রাজা শীলভদ্র। সেই রাজ্যের রোহিশালা গ্রামে থাকতেন মামানিয়া গাধবী নামে এক ভারী সৎ, বুদ্ধিমান, শিবভক্ত চারণ সম্প্রদায়ের  মানুষ। মহারাজের সাথে তার ছিল ভারি সুসম্পর্ক, প্রায় সমবয়সী হওয়ায় সে মহারাজের বড় কাছের মানুষ হয়ে যায়। মহারাজ শীলভদ্র অনেক  সময়ই রাজ্যের বড়সড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় মামানিয়াকে ডেকে পাঠাতেন। বুঝতেই পারছেন বাকি মন্ত্রীরা হিংসের চোটে জ্বলে পুড়ে মড়ছিল----তাই তারা দল বেঁধে মহারানীর কান ভাঙ্গাতে শুরু করলেন। মামানিয়ার মত ভাল মানুষের বিরুদ্ধে বলার মত আর কিছু না পেয়ে মন্ত্রীরা মিলে রানীকে বোঝালেন মামানিয়া নিঃসন্তান, তার স্ত্রী বাঁজা ---তাই তাদের অশুভ ছায়া পড়ে মহারাজ শীলভদ্রও আজও সন্তান সুখ পাননি। অতএব বিনাদোষে মামানিয়ার রাজপ্রাসাদে প্রবেশ নিষিদ্ধ হল। 

সৎ নিঃস্বার্থ ভাল মানুষ মামানিয়া বড় মনঃকষ্ট পেলেন, ভারি অপমানিত বোধ করলেন এভাবে বন্ধু বিচ্ছেদ হওয়ায়। শুকনো মুখে বাড়ী ফিরতেই স্ত্রী মিনাল্ডির জেরার মুখে সব কথা খুলে বলতে বাধ্য হলেন----এরপর স্ত্রীর পরামর্শে শুরু করলেন কঠোর তপস্যা। আত্মবলি দিতে উদ্যত মামানিয়াকে আটকালেন মহাদেব। তুষ্ট হয়ে শিব ঠাকুর বর দিতে চাইলে সন্তান কামনাই করেন এই চারণ দম্পতি।কিন্তু দেবাদিদেব জানান মামানিয়ার ভাগ্যে সন্তান যোগ নেই, তবে পারলে নাগলোকে গিয়ে একবার প্রার্থণা করা যেতে পারে। এরপর নাগরাজের কন্যা নাগ পুত্রী দয়াপরবশ হয়ে বর দিলেন মামানিয়াকে--- সাতটি কন্যা আর এক পুত্রের জনক হবেন তিনি। বাড়ী ফিরে ছোট ছোট আটটি দোলনা বানিয়ে রাখলেন মামানিয়া আর তাঁর স্ত্রী মিনাল্ডি। 

ওমা! কোথা থেকে আটটা সাপের বাচ্ছা এসে গুটিশুটি মেরে দোলনায় শুয়ে পড়ল আর খানিক পরে তারা শিশুতে রূপান্তরিত হল। গাঁয়ের লোক দেখেছে মিনাল্ডি গর্ভবতী হয়নি, তাই রটে গেল কালা যাদু করেছে মামানিয়ারা। কোথায় যেন হালকা মিল আমাদের চাঁদ সদাগরের সাথে---দুজনেই শৈব আর মনসা বা নাগকন্যার আশীর্বাদে পুত্রলাভ।

এদিকে খবর পৌঁছল রাজা শীলভদ্রের কানে, আর তো তাঁর বন্ধু নিঃসন্তান নয়---আকুল হয়ে ছুটলেন বন্ধুকে দেখতে। এদিকে এতদিন পরে বাবা হয়ে মামানিয়া সারা গাঁয়ে মিষ্টি বিতরণ করছেন। মন্ত্রীরা ভাবল এই সুযোগ। লোক লাগিয়ে বিষাক্ত মিষ্টি খাইয়ে রাজাকেই মেরে ফেলার প্ল্যান করল। লোকে জানবে মামানিয়া কালা জাদু করেই রাজাকে মেরেছে---এক ঢিলে দুই পাখী মারা যাবে। কিন্তু ততক্ষণে জানবাই জন্ম নিয়ে নিয়েছেন (ইনিই পরে খোদিয়ার মাতা), তাকে মহারাজ কোলে নিতেই হাতের এক ঝটকায় ফেলে দিলেন রাজার জন্য আনা সেই বিষাক্ত মিষ্টান্নের থালা টি,আর যেন গায়েব হয়ে গেল মিষ্টান্ন গুলি। এবার মহারাজের সন্দেহ হয় নিশ্চয় কোনো কালা যাদু আছে! সঙ্গে সঙ্গে রাজার আদেশে আটটা বাচ্ছাকে আটটা লোহার বাক্সে, শিকল ঝুলিয়ে জলে ছুঁড়ে ফেলা হল। অবাক হয়ে সবাই দেখল লোহার বাক্স ভাসছে, আর বাচ্ছাদের কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।এরপর সকলে বুঝে নেয় দৈবশক্তির অধিকারী মামানিয়ার সন্তানরা। 

সাত ভাই চম্পা আর পারুল বোনের ঠিক উল্টো এখানে—মামানিয়ার সাত কন্যা হলেন আভাল, জোগাল, টোগাল, জানবাই, হোলবাই, সোসাই আর এক পুত্র মেহেরক। বড় আদরের ভাই মেহেরকিয়াকে খেলার মাঠে একবার বিষাক্ত সাপে কাটল।  সবাই জানে নাগলোকে আছে “আমি” (গুজরাটি শব্দ মানে অমৃত)। সবার আগে ছুটল জানবাই, জলের তলা থেকে অমৃত নিয়ে আসার পথে পাথরে ঠোক্কর খেল জানবাই, তলিয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাল একটি কুমির। সেই কুমিরের পিঠে চেপেই জলের ওপর অমৃত হাতে ভেসে উঠলেন জানবাই একটু খুড়িয়ে হাটছিলেন পায়ে চোট পেয়ে তাই দেখে কে যেন বলে ওঠে- “খোদাতি  আবেচে” মানে খুঁড়ী আসছে। সেই থেকে জানবাই এর অপর নাম খোদিয়ার মাতা আর বাহন হল কুমির। এরপর রাজা শীলভদ্রও সন্তান সুখ পান।ভাবনগর থেকে সিন্ধ অবধি ছড়িয়ে পরে খোদিয়ার মাতার কাহিনী।

দশম শতাব্দীতে জুনাগরের নিঃসন্তান মহারানীকে তার পারিষদরা নানান  কুমন্ত্রণা দিতে শুরু করেন, তাদের কথায় কিছু অশুভ কালা জাদুর সাহায্যে তিনি গর্ভবতী তো হন কিন্তু নমাস পরেও বাচ্ছা হয় না। দেখতে দেখতে আরও ন মাস কেটে যায়, শুরু হয় অসহ্য প্রসববেদনা কিন্তু বাচ্ছা বের হয় না।বুঝতে পারেন অশুভ শক্তির সাহায্য নেওয়ার ফলভোগ করছেন। উপায়ান্তর না পেয়ে খোদিয়ার মাতাকে মন থেকে ডাকলে তবেই মুক্তি পান সেই মর্মান্তিক যন্ত্রণা থেকে। জন্ম দেন এক সুন্দর পুত্রসন্তানের—নাম নবগাহন। এই শক্তিশালী অপরাজেয় রাজা নবগাহনের রথের ওপর নাকি ছোট্ট চড়ুইপাখি রূপে দেবী সদাসর্বদা যুদ্ধের সময় উপস্থিত থাকতেন। গিরের কাছে এক জলাশয়ের কাছে ঘোড়াকে চান করানোর সময় খোদিয়ার মাতার দর্শন পান মহারাজ নবগাহন। প্রতিষ্ঠা হয় সবচেয়ে প্রাচীন খোদিয়ার মাতার মন্দির—গালধারাতে। সিন্ধের শক্তিশালী রাজা সুমরাকে মাতাজীর কৃপাতেই হারান নবগাহন আর তারপর সুদূর সিন্ধ থেকে ইঁট এনে পালিতানার কাছে মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এই ইঁট আনতে নিমরাজি হওয়ায় সেনাপতির মুন্ডু কেটে মন্দিরের দেওয়ালে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন রাজা নবগাহন।

এমন অনেক উপকথা ছড়িয়ে আছে খোদিয়ার মাতাকে নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন শতাব্দীতে, মায়ের মন্দিরও ছড়িয়েছে গুজরাটের নানান জায়গায়। কোথাও মিল পাই সাক্ষী গোপালের মত পথ চলতে চলতে পিছু ফিরে তাকাতেই মা সেখানে দাঁড়িয়ে গেছেন।কোথাও দেখছি গরু চরাতে গিয়ে জলের নীচে স্বর্ণ মন্দির দেখেছে রাখাল বালক। ছুটে গিয়ে সে রাজাকে জানিয়েছে মন্দিরের সন্ধান--- ওদিকে মায়ের দেওয়া আশীর্বাদী পাতা ফেলে দিয়েছে সেই  অবোধ বালক, মাথায় লাগা দু একটা পাতা বাড়ী এসে দেখেছে সোনার পাতা হয়ে গেছে। মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের কৃপণ কবিতার সেই লাইনটি— “তোমায় কেন দিইনি আমার সকল শূণ্য করে।“  হয়ত গরিব যাযাবর এই চারণ সম্প্রদায় নিজেদের উজার করেই ভালবাসে তাদের এই খোদিয়ার মাতাকে---অসীম বিশ্বাস তাদের যে সব ধরণের  বিপদে পাশে তাদের খোদিয়ার মা আছেন।

(www.theoffnews.com - Khodiyar Mata)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours