পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
দুপুরে খাওয়ার পাতে শাক সুক্তোর পরে আমডাল বা টক ডালটা পড়তেই মনে পড়ে গেল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। কি, চোখ কপালে উঠল তো? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আবার আম ডালের কি সম্পর্ক! আছে, আমার ক্ষেত্রে একটা সম্পর্ক আছে বৈকি। সেই গল্পই করব এবারের ভোট কথায়।
২০০১ সাল। আমি তখন দুর্গাপুরে। লাল সমুদ্রের মাঝে কোথাও যেন একটা সবুজ চোরা স্রোত বইছে। আসলে অবিভক্ত বর্ধমান জেলা জুড়ে সেই সময় বামেদের একছত্র আধিপত্য। সেই সঙ্গে বাম নেতাদের অহংকার এবং ঔদ্ধত্যের চরম সময়। বিরুদ্ধে সামান্য টু শব্দটি করবার উপায় নেই, নেতা ক্যাডারদের শাসানি, সামান্য ব্যাপারেই দলের ক্ষমতা দেখানোর স্পৃহা, মানুষকে কিছুটা বিরক্ত তো করেছেই। যেটা এখন তৃণমূলের আমলেও দেখা যাচ্ছে। শিল্পাঞ্চলে সেই সময়েই পরিবর্তনের আভাষ পাচ্ছি আমরা। তৃণমূল দল তখন শিশু। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধী নেত্রী হিসেবে অসম লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। এমন রক্তিম আবহে থেকে ঘুণাক্ষরেও কেউ কল্পনা করতে পারছেন না যে আর দশ বছরের মধ্যে বাংলা থেকে বামেদের অস্তিত্বই মুছে যেতে পারে। যাই হোক বিধানসভা ভোটে তৃণমূল প্রার্থীদের হয়ে প্রচারে এলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দুর্গাপুর এবং আসানসোলে সভা করবেন তিনি। তখন কিন্তু মমতা বাদ দিয়ে তৃণমূলের অন্যতম প্রধান মুখ পঙ্কজদা, পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি ঠিক করলাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলাদা করে একটা সাক্ষাৎকার নেব। কথা হল স্থানীয় প্রার্থী অপূর্ব মুখোপাধ্যায় ওরফে অপুদার সঙ্গে। অপুদা বললেন আমি বলে রাখব।
মমতা সেই সময় দেরি করে ঘুম থেকে উঠতেন। অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করে ঘুমোতে যেতেন, তাই তার উঠতে উঠতে বেলা হয়ে যেত। সেই অভ্যাস অবশ্য পরে বদলে যায়। যাই হোক দুর্গাপুর হাউজে মমতা উঠেছেন রাতে। আমি এবং আমার চিত্রগ্রাহক সহকর্মী দুজনে সকাল দশটা নাগাদ গিয়ে অপেক্ষা করছি। প্রায় পৌনে বারোটা বাজে, কিন্তু মমতার দেখা নেই। জিজ্ঞাসা করলেই বলছে ঘুমোচ্ছে। স্থানীয় তৃণমূল নেতারাও দেখলাম উসখুস করছেন। গল্প করছি দুর্গাপুর এবং হিরাপুর কেন্দ্রের প্রার্থী অপূর্ব মুখোপাধ্যায় এবং মলয় ঘটকের সঙ্গে। এমন সময় হাজির আসানসোল কেন্দ্রের প্রার্থী কল্যান বন্দ্যোপাধ্যায়। পেশায় আইনজীবী হলেও কল্যানদার কথাবার্তা কোনওদিনই সুবিধার না। ঢুকেই আমাকে দেখে তার কথা – “কি ব্যাপার?” বললাম দিদির সঙ্গে কথা বলব। হঠাৎ কল্যানদা বলে বসল “এখন হবে না, তাছাড়া মমতাকে ইটিভি অনেক পেয়েছে। আর কি হবে?” বোঝো কথা, সিপিএমের ওই আমলে ভোটের আগে এক প্রার্থী সেই সময়ের সব চেয়ে বড় এবং জনপ্রিয় টিভি মিডিয়াকে বলছে বিরোধী নেত্রীকে নাকি প্রচুর পেয়েছি আমরা তাই আর দরকার নেই! শুনেই তো মেজাজ চড়ে গেল, আমার থমথমে মুখ দেখেই অপুদা এবং মলয়দা বুঝল কল্যান সব্বোনাশ করে দিয়েছে। ক্যামেরাম্যানকে বললাম চল, বাড়ি যাই। অফিসে বলে দেব মমতাকে অনেক পেয়েছি আমরা আর দরকার নেই এটা তৃণমূল বলে দিয়েছে।
কিন্তু অপুদা এবং মলয়দা দুজনেই আমাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে বললেন “আমাদের কথা ভেবে যেও না। দিদি এখুনি আসবে আমরা কথা বলাবই তোমার সঙ্গে।” আমার সঙ্গে দুজনের সম্পর্কই খুব ভাল ছিল, দুজনের অনুরোধ তাই ফেলতে পারলাম না। এর মধ্যেই দিদি তৈরি হয়ে বেরিয়ে এসেছেন। কেউ বোধ হয় দিদিকে আগেই কল্যান কীর্তির কথা লাগিয়ে দিয়েছে। দেখলাম খুব প্রসন্ন মুখ, ডেকে আগে জলখাবার খাওয়ার জন্য জোরাজুরি করলেন। বললাম খেয়ে এসেছি দশ মিনিট কথা বলব দিদি। তা বললে হয় একটু কিছু খাও। খেতে খেতেই প্রায় এক ঘন্টা কথা হল। মমতা সরাসরি জানালেন আমাদের নতুন দল, দারুণ কিছু হবে এ কথা বলছি না, কিন্তু একটা লড়াই আমরা দেব। আমার কাছ থেকে শুনলেন শিল্পাঞ্চলের কি অবস্থা? বললাম বিরোধীতার চোরা স্রোত আছে, সুযোগ নিতে পারলে হয়ে যেতেও পারে। বেশ উৎসাহ পেলেন মনে হল। আরও অনেক গল্প করলেন, কেন রাতে দেরী হয়েছিল, তার গাড়িকে কোথায় আটকে দেওয়া হয়েছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনকি বসিয়ে রাখার জন্য দুঃখ প্রকাশও করলেন। অপুদা পাশ থেকে বলল দিদি পলাশ কিন্তু কলকাতার ছেলে, তবে আমাদের সঙ্গে খুব ভাল সম্পর্ক। বললাম কলকাতা নয় আমার বাড়ি গোবরডাঙ্গায়। শুনে আবার দিদির মত জিজ্ঞাসাও করলেন বাড়িতে কে কে আছে? এখানে আমার সঙ্গে কে থাকে? একা থাকি রান্না করি শুনে জিজ্ঞাসা করলেন কি খাওয়া দাওয়া করি। ডাল আলুভাতে আর ডিমের ঝোল দিয়ে চলে যায় শুনে মমতা সুলভ ভঙ্গীতে মমতা আমায় আম ডাল রান্নার রেসিপি বলে দিলেন। গরমে নাকি আমডাল খাওয়া খুব ভাল। পান্তার নাম শুনলেও জল ঢালা ভাতের কথা মমতার কাছ থেকেই প্রথম শুনি। তখনই জানলাম ওনার মামাবাড়ি বীরভূমে। নিজের ফোন নম্বরও দিয়ে বলে দিলেন প্রয়োজনে যেন ফোন করি। সেই নম্বরটি আজও আমার কাছে আছে। বিকেলে প্রচার সভাতেও যেন থাকি অনুরোধ করলেন। বললাম সে তো থাকবই। আসার আগে আরও একবার মনে করিয়ে দিলেন আম ডালে একটু মিষ্টি দিতে ভুলো না কিন্তু।
পরেও অনেক বার দেখা হয়েছে, জনসভায় দেখা হলে দূর থেকেই হাত নেড়ে ইশারা করতেন। বীরভূমে নানুরে শহিদ দিবসে এসেছিলেন, আমায় দেখতে পেয়ে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। বদলি হয়ে বীরভূমে আছি শুনে আশিসদা মানে আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের (তখনও কেষ্টা অনুব্রত মণ্ডল হয়ে ওঠেননি) সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। উনি যখন মুখ্যমন্ত্রী হন তখন আমি অবশ্য কলকাতায় চলে এসেছি। কিন্তু অফিসেই বিভিন্ন দায়িত্ব নিয়ে থাকতে হত বলে আর মাঠে ময়দানে দেখা হত না। তবে রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হলে তার স্বাভাবিক স্বভাব, অভ্যাস এবং পরিচিতির পরিমণ্ডল তো বদলে যায়ই। প্রবল চাপে বদলে যায় আরও অনেক কিছুই।
ও হ্যা একটা কথা তো বলাই হয়নি। দুর্গাপুর হাউজে আমাকে ওই কথা বলবার পর কিন্তু আমি আর কল্যান বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখতেই পাইনি। কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিলেন কে জানে? পরে নির্বাচনী ফলাফলে অবশ্য ২০০১-এ বর্ধমান শিল্পাঞ্চলে তৃণমূল চারটি আসন পেয়েছিল। তার মধ্যে আসানসোল থেকে কল্যান বন্দ্যোপাধ্যায়ও জিতেছিলেন। জিতেছিলেন অপুদা এবং মলয়দাও। (ক্রমশঃ)
(www.theoffnews.com - West Bengal politics Mamata Banerjee)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours